যারা গুজব রটনা করে তাদের ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কতটা কঠোর তা পবিত্র কোর’আনের সুরা আহযাবের এই আয়াতগুলো পড়লেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, ব্যাখ্যার কোনো প্রয়োজন পড়বে না। গুজব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে আল্লাহর এই ঘোষণাটি জেনে নিই। আল্লাহ বলেন, মোনাফেকগণ এবং যাদের অন্তরে ব্যাধি আছে এবং যারা নগরে গুজব রটনা করে তারা বিরত না হলে আমি নিশ্চয়ই তাদের বিরুদ্ধে তোমাকে প্রবল করব, এরপর তারা এ নগরীতে অল্প দিনই তোমার প্রতিবেশীরূপে থাকবে। অভিশপ্ত (লানতপ্রাপ্ত) অবস্থায় তাদেরকে যেখানেই পাওয়া যাবে, ধরা হবে এবং নির্দয়ভাবে হত্যা করা হবে। যারা পূর্বে অতীত হয়ে গেছে, তাদের ব্যাপারে এটাই ছিল আল্লাহর রীতি (সুন্নাত)। আপনি আল্লাহর রীতিতে (সুন্নাতে) কখনও পরিবর্তন পাবেন না (সুরা আহযাব: ৬০-৬২)।
উক্ত আয়াতে পরিষ্কার গুজব রটনাকারীদের উপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হয়েছে। তারা যা রটনা করে তা যখন মানুষের সামনে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন হয়ে যাবে, মানুষ যখন আসল সত্যটা জানতে পারবে তখন গুজব রটনাকারীরা এতটাই হীনতাগ্রস্ত, অপমানিত, লাঞ্ছিত হবে যে পালানোর পথ পাবে না। যেখানে পাওয়া যাবে সেখানেই তারা পাকড়াও করে দণ্ডিত করা হবে। এটা যে শুধুমাত্র নবী করিম (সা.) ও তাঁর পরিবারের বিষয়ে গুজব রটনা সম্পর্কে তা নয়, অতীতেও যখন কেউ গুজব রটনা করেছে এবং ভবিষ্যতেও যারা করবে তাদের সবার বেলায় এই রীতি (সুন্নাত) প্রযোজ্য হবে- সেটাও আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে- আল্লাহর এ সুন্নাতের কোনো পরিবর্তন নেই।
বাংলা ভাষায় একটা বাগধারা প্রচলিত আছে – কান নিয়েছে চিলে। এটা গুজব শুনে প্রভাবিত হওয়া অর্থে ব্যবহার করা হয়। আর বাঙালি জাতিকে আখ্যায়িত করা হয় হুজুগে বাঙালি বলে। কিন্তু গুজবে কান দিয়ে হুজুগে মেতে ওঠা কোনো সভ্য জাতির কাজ নয়, বরং বর্বর বন্য জঙলিদের জন্য এসব ক্রিয়াকলাপ মানানসই। কিন্তু বাঙালি তো কোনো জঙলি জাতি না, আমাদের সভ্যতার ইতিহাস বিশ্বের অনেক সভ্যতার চাইতে প্রাচীন। উপরন্তু বহু শতাব্দী থেকে এখানে ইসলামের চর্চা করা হচ্ছে। তথাপি এদের মধ্যে গুজব সৃষ্টিকারী দল কীভাবে বাসা বাঁধল তা চিন্তার বিষয়। আজ কেন হুজুগে মাতাল হয়ে এ জাতির অন্তর্ভুক্ত এক শ্রেণির লোক গণপিটুনি দিয়ে নির্দোষ মানুষ পর্যন্ত হত্যা করে ফেলে, নিরপরাধ মানুষের বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে সব ভস্মীভূত করে দেয়?
পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে এমন গুজব শুনে যেভাবে বিগত এক মাস ধরে গণপিটুনি দিয়ে নরহত্যার চিত্র আমরা দেখলাম তাতে নিজেদের চোখের উপরই অবিশ্বাস এসে যায়। এটা কি একবিংশ শতক নাকি মধ্যযুগ তা ভেবে মন বিভ্রান্ত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে বিভিন্ন স্থানে অন্তত ১০ জন নারী ও পুরুষকে হত্যা করা হলো। শতাধিক মানুষকে আহত পঙ্গু বানিয়ে ফেলা হলো। কিন্তু পুলিশ প্রধান ঘোষণা করলেন, নিহতদের মধ্যে একজন ব্যক্তিও ছেলেধরা ছিলেন না (বিবসি)। যখন কোনো গণ-আন্দোলন গড়ে ওঠে সেটা রাজনৈতিক হোক বা অরাজনৈতিক, সেটাকে জোরদার করার জন্য সকলেই প্রায় গুজব আর হুজুগের পন্থা অবলম্বন করে। কিছুদিন আগেও নিরাপদ সড়কের জন্য যে ছাত্র আন্দোলটি হলো সেটাও শেষভাগে এসে হুজুগ আর গুজবের উপর ভর করল। এ বিষয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী একটি ভাষণে বলেন, “গুজব ছড়ালেই তা বিশ্বাস করতে হবে কেন, কিছু শুনলে আগে বুদ্ধির প্রয়োগ করে তা বিচার বিবেচনা করতে। ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি সুশিক্ষার জন্য, গুজব ছড়াতে নয়।”
আমরা সবচেয়ে বেশি হুজুগ আর গুজবের ব্যবহার লক্ষ করে থাকি ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টির কাজে। ফেসবুকে কোনো ছবি বা লেখাকে পুঁজি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা সহিংসতা সৃষ্টির বেশ কয়েকটি ঘটনা আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখেছি। রামুর বৌদ্ধমন্দির গুড়িয়ে দেওয়া, রসরাজ আইডি থেকে একটি ঘৃণাত্মক ছবি প্রচারের অভিযোগে নাসিরাবাদের হিন্দু পল্লীতে আক্রমণ করা ইত্যাদি ঘটনা এর উদাহরণ। অমুককে চাঁদে দেখা গেছে এমন গুজব রটিয়ে দিয়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে দেওয়া হলো, তাতে বহু লোক মারা গেল, বহু গাড়ি পোড়ানো হলো, বহু রাস্তা ধ্বংস করা হলো।
গুজব রটিয়ে সহিংসতা ঘটানোর এমন একটি উদাহরণ আছে যা সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায় কিন্তু সেই উদাহরণ কোনো অজানা কারণে কেউ দিতে চান না। সেটা হচ্ছে ১৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির সেই জোড়া খুনের ঘটনা। হেযবুত তওহীদের এমামের বাড়ির আঙিনায় একটি মসজিদ নির্মাণ চলছিল। ২০০০ সন থেকে একটি ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী সেখানে হেযবুত তওহীদের ঘোর বিরোধিতায় লিপ্ত ছিল। তারা চায় না সেখানে হেযবুত তওহীদের মসজিদ হোক। তো কী করা যায়? সবচেয়ে সহজ বুদ্ধি হলো একটা গুজব রটিয়ে ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টি করে দেওয়া। এই কাজটা খুব ভালোই পারেন ধার্মিকতার বেশধারী ভণ্ড ধর্মজীবীরা। তারা মসজিদের মাইকে, ওয়াজে, খোতবায় এবং হ্যান্ডবিল লিখে প্রচার করে দিল যে হেযবুত তওহীদ খ্রিষ্টান, আর যেটি তৈরি হচ্ছে সেটি মসজিদ নয়, গির্জা। আরো বলল যে, হেযবুত তওহীদের লোকেরা নাকি দশজন আলেমকে হত্যা করে বাড়ির ভিতরে মাটির নিচে পুতে রেখেছে। ব্যাস, আর যায় কোথায়? হাজারে হাজারে ধর্মোন্মাদ মানুষ আর দলীয় সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র আর লাঠিসোটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পশুর মতো। মসজিদে স্বেচ্ছাশ্রম দিতে আসা শতাধিক হেযবুত তওহীদ সদস্যকে হত্যা করার জন্য দিনভর চেষ্টা করে তারা খোকন আর রুবেল নামের দুই জন সদস্যকে পিটিয়ে, হাত পায়ের রগ কেটে, চোখ তুলে, অতঃপর গরু জবাই করা ছুরি দিয়ে জবাই করে হত্যা করতে সমর্থ হলো। তারপর তাদের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিল। আর সেই জবাইকৃত জ্বলন্ত লাশের সঙ্গে সেলফি তুলে প্রচার করা হলো। পুরোটা সময় ফেসবুকে ছবি শেয়ারিং আর গুজব ছড়ানোর মহোৎসব করা হলো। ফেসবুকে প্রচার করল যে দুইজন খ্রিষ্টানকে জবাই করা হয়েছে। বাকি খ্রিষ্টানদেরকেও হত্যা করার জন্য এগিয়ে আসুন। ফলে আশপাশের জেলা থেকে সন্ত্রাসীরা যোগ দিল পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে। শেষে কী হলো, হত্যা করা হলো দুজন দীন প্রতিষ্ঠাকামী মো’মেন মুসলমানকে, আর গুড়িয়ে দেওয়া হলো আল্লাহর ঘর মসজিদ। সেই মসজিদে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজসহ জুমা ও ঈদের নামাজও পড়া হচ্ছে। এই ঘটনার বিরুদ্ধে সেদিন কোনো মিডিয়া, কোনো সুশীল সমাজ দাঁড়ায় নি। তারা একে উপেক্ষা করেছেন। ভাবখানা এমন যে, হেযবুত তওহীদের লোকদের মেরেছে ধর্মীয় মতবিরোধের জের হিসাবে। কিন্তু এটা ধর্মীয় মতবিরোধের বিষয় ছিল না, এটা ছিল ধর্মব্যবসায়ীদের দ্বারা বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা গুজব রটনার পরিণতি।
সুশীল সমাজের ও মিডিয়ার এই নীরবতাকে তাদের মৌন সম্মতি ও নিজেদের বিজয় হিসাবে গ্রহণ করেছে গুজব রটনাকারীরা। তারা আরো উজ্জীবিত হয়েছে, আত্মবিশ্বাসী হয়েছে নতুন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ সাধনে। এ বিষয়ে সম্ভবত কোনো ঐতিহাসিক দ্বিমত করবেন না যে, মানব ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নৃশংসতা চালানো হয়েছে ধর্মের নাম ব্যবহার করে, সেটা খ্রিষ্টান ধর্ম হোক, ইসলাম হোক, হিন্দু হোক, বৌদ্ধ হোক বা জুডাই ধর্মই হোক। আর এই পৈশাচিক ক্রীড়ার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে যাজক পুরোহিত ধর্মব্যবসায়ী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীটি এবং এটাকে অবলম্বন করেছে ধান্ধাবাজ রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলকারী গোষ্ঠী। মধ্যযুগে ইউরোপের বিজ্ঞানীদের হত্যা থেকে শুরু করে ভারতজুড়ে গরুর মাংস নিয়ে মুসলমান হত্যা সবই একই সূত্রে গাঁথা। অন্যান্য ধর্মের কথা বাদ দিলাম, সেগুলো না হয় প্রাচীন ধর্ম, সেগুলোর ধর্মগ্রন্থ না হয় বিকৃত হয়েছে কিন্তু আমাদের ইসলাম তো সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক ধর্ম। কোর’আনও ১৪শ’ বছর ধরে অবিকৃত। মহানবী যে সভ্যতাটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা মানব ইতিহাসে বুদ্ধির, যুক্তির, জ্ঞানের আকাশে উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের ন্যায় বিরাজ করছে। এই মহান সভ্যতার ধারক মুসলিমরা কখনও এই পাশবিক আচরণে অভ্যস্ত হতে পারে না, সেটা তাদের মূল শিক্ষার সঙ্গে যায় না। তা সত্ত্বেও আমাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কেন এমন পাশবিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠল?
এর কারণ হিসাবে বলব, কোর’আন অবিকৃত থাকলেও বাস্তবে এর শিক্ষাকে উল্টে ফেলা হয়েছে। বাড়াবাড়ি করে দীনকে জটিল বানিয়ে তা কুক্ষিগত করে ফেলেছে ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণি। ফলে সাধারণ মানুষ ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তারা অন্ধভাবে ঐ ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণির বচন বিশ্বাস করে, জান্নাতের আশায় ধর্মব্যবসায়ীদের নসিহতে তারা সৎকর্মপরায়ণ না হলেও সহিংসতা ও নৃশংসতায় মেতে উঠতে কসুর করে না। বিশেষ করে যদি সেই সহিংসতাকে জেহাদের মোড়ক পরানো হয় তাহলে তো কথাই নেই। এই অন্ধত্বের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি ও অসহায় হয়ে যায়। যারা এর বিরুদ্ধে যাবে তারাই কাফের, নাস্তিক ফতোয়া দ্বারা বিদ্ধ হবে। তাদের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে ধর্মবিশ্বাসী ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা সম্পর্কে অনবহিত জনগোষ্ঠীকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হবে, সৃষ্টি করা হবে ধর্মোন্মাদনা। প্রতিটি ওয়াজে তাদের গলাচেরা গর্জন, চিৎকার, ভেঙে দিতে হবে, গুড়িয়ে দিতে হবে, চামড়া তুলে ফেলতে হবে, আগুন জ্বালিয়ে দিতে হবে বলে তাকবির দেওয়া যেন একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। আগেই বলেছি, সরকারগুলোও ভোটের হিসাব নিকাশের কারণে বা আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কায় তাদের সমীহ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এটা সাধারণ জ্ঞান যে, হুজুগ আর গুজব কখনোই একটি জাতির জন্য ইতিবাচক কিছু বয়ে আনে না। কারণ মিথ্যা যখন প্রকাশিত হয়ে যায় তখন পুরো আন্দোলন ভিত্তিহীন হয়ে যায়, তার যৌক্তিক প্রসঙ্গগুলোও আর ধোপে টেকে না। গুজব ব্যবহারের দরুন একটি ন্যায়সঙ্গত বিষয়ও জনসমর্থন হারায়। তাই কোনো অবস্থাতেই হুজুগ আর গুজবকে আশ্রয় করে জাতির টেকসই পরিবর্তন আনয়ন করা যায় না। এই শিক্ষাটি দেয় ইসলাম।
উড়ো কথা প্রচার করা বা কারো উপর অপবাদ আরোপ করা ইসলামের দৃষ্টিতে দণ্ডনীয় অপরাধ। কারো ব্যাপারে কোনো কথা শুনে সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে প্রচার করা সমাজে বিশৃঙ্খলা বিস্তারের অন্যতম কারণ। আল্লাহ বলেছেন- মো’মেনগণ! যদি কোন পাপাচারী ব্যক্তি তোমাদের কাছে কোনো সংবাদ আনয়ন করে, তবে তোমরা পরীক্ষা করে দেখবে, যাতে অজ্ঞতাবশতঃ তোমরা কোনো সম্প্রদায়ের ক্ষতিসাধনে প্রবৃত্ত না হও এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত না হও (সুরা হুজরাত-৬)। আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন, কোনো মানুষের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে যাই শোনে তাই যাচাই না করেই অন্যের কাছে বর্ণনা করে দেয় (মুসলিম)।” রসুলাল্লাহর জীবনে এমন একটি ঘটনাও নেই যেখানে সাহাবীরা গুজবে মেতে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ক্ষতিসাধন করেছেন।
আম্মা আয়েশার (রা.) উপর কিছু মোনাফেক অপবাদ আরোপ করেছিল যা নিয়ে মদীনায় ব্যাপক গুঞ্জন ও কানাকানি হয়েছিল। নবগঠিত মুসলিম জাতির একমাত্র শক্তিই ছিল তাদের সর্বাবস্থায় ন্যায়ের উপর দণ্ডায়মান থাকার নীতি। রসুলাল্লাহ জাতিটিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেনই ন্যায়ের পক্ষে। এমতাবস্থায় স্বয়ং রসুলাল্লাহর স্ত্রীকে যদি ‘চরিত্রহীনা’ (নাউযুবিল্লাহ) বলে সাব্যস্ত করা যায় তাহলে মো’মেনদের নৈতিক শক্তি ভেঙে পড়বে যা ছিল মুনাফেকদের মনোবাঞ্ছা। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারী মোনাফেকদের সে আশা পুরণ হলো না। আল্লাহ আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন যে আয়েশা (রা.) নির্দোষ। রসুলাল্লাহ একটি খোতবা দিলেন এবং আল্লাহ কোর’আনে এ ব্যাপারে যা নাযেল করেছেন তা তাদেরকে তেলাওয়াত করে শোনালেন। তারপর তিনি গর্হিত অপপ্রচারে সর্বাধিক তৎপর মিসতাহ, হামনা, হাসসান বিন সাবিত (রা.) ও আব্দাল্লাহ বিন উবাইকে অপবাদের নির্ধারিত শাস্তি আশিটি বেত্রাঘাতের আদেশ দিলেন এবং যথারীতি সে আদেশ পালিত হোল। অপবাদকারীদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে যারা গর্হিত অপপ্রচারে অংশ গ্রহণ করেছিলো, তাদের কথা উল্লেখ করে কোর’আনের যে আয়াতটি নাজেল হলো সেটি হচ্ছে: “যারা এ অপবাদ রটনা করেছে তারা তো তোমাদেরই একটি দল; এই অপবাদকে তোমরা তোমাদের জন্য অনিষ্টকর মনে করো না; বরং এতো তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট আছে তাদের কৃত পাপকর্মের ফল এবং তাদের মধ্যে যে এই ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তার জন্য আছে কঠিন শাস্তি। এ কথা শোনার পর মো’মেন পুরুষ ও নারীগণ কেনো নিজেদের বিষয়ে সৎ ধারণা করে নি এবং বলে নি: এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ? ….. যখন তোমরা মুখে মুখে এটা ছড়াচ্ছিলে এবং এমন বিষয় মুখে উচ্চারণ করছিলে যার কোন জ্ঞান তোমাদের ছিল না এবং তোমরা একে তুচ্ছ গণ্য করছিলে, যদিও আল্লাহর নিকট এটা ছিল গুরুতর বিষয় (সুরা নূর ১১ – ১৫)। সুতরাং গুজব রটনাকারীর দণ্ড ইসলামে কঠোর এবং তারা আল্লাহর লানতের পাত্র যা শুরুতেই উল্লেখ করেছি।
গুজব আর হুজুগ যেন জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে জাতিকে মুক্ত করার পথ সন্ধান করছে চিন্তাশীল মানুষ, অনেকে অনেকরকম আলোচনা করছেন। কিন্তু চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে এই যে, মানুষ যতক্ষণ না নিজেদের ভিতরে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব ও লালন না করবে ততক্ষণ সে সত্যের প্রতি অবনতমস্তক হতে পারবে না। ততক্ষণ সে গুজব ও হুজুগে আন্দোলিত হবে। এই পন্থা অবলম্বন করেই আল্লাহর রসুল জাহেলিয়াতের আরবদেরকে হুজুগ ও গুজব থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে ইতিহাস আজও আমাদেরকে উজ্জ্বল সূর্যের মতো শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে।