ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান ভয়াবহ গণহত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে অরাজনৈতিক ধর্মীয় আন্দোলন হেযবুত তওহীদ। “ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ করো, করতে হবে” শ্লোগানকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচি পালিত হয়।
হেযবুত তওহীদের ঢাকা মহানগরীর উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধনে নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির ঢাকা বিভাগীয় আমির ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় নারী বিষয়ক সম্পাদক রুফায়দাহ পন্নী, তথ্য সম্পাদক এসএম সামসুল হুদা, ঢাকা বিভাগীয় সভাপতি ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ, মোখলেছুর রহমান সুমন, বিভাগীয় নারী নেত্রী তাসলিমা ইসলাম, কেন্দ্রীয় যুগ্ম নারী বিষয়ক সম্পাদক আয়েশা সিদ্দিকা এবং নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের আমির আরিফ উদ্দিন। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিভাগীয় সহ-সভাপতি আল-আমিন সবুজ।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, আজ যখন আমরা বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ উদ্যাপন করছি, রোজা, নামাজ ও নানা কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রয়েছি, তখন মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার দূরে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপর চলছে অবর্ণনীয় এক ধ্বংসযজ্ঞ। ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি দখল, হামলা ও নিপীড়নের শিকার। ২০২৩ সাল থেকে এই সহিংসতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই সেখানে বোমা বর্ষিত হচ্ছে, ধ্বংস করা হয়েছে ঘরবাড়ি, স্কুল, কলেজ, হাসপাতালসহ সকল অবকাঠামো। লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ নির্মমভাবে প্রাণ হারাচ্ছে। শুধু গত এক বছরে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার শিশু নিহত হয়েছে। এমন অবস্থায় কবর দেওয়ার লোকও পাওয়া যাচ্ছে না। উদ্বাস্তু শিবিরে পানির জন্য ছুটে যাওয়াদের ওপরও বোমা ফেলা হচ্ছে। এই নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার মাত্রা এতটাই ভয়ঙ্কর যে তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
বক্তারা আরও বলেন, দীর্ঘ ৭৫ বছরের দখলদারিত্ব ও গণহত্যার পর এবার ইসরায়েল নির্লজ্জভাবে ঘোষণা করেছে- এই ভূখণ্ডে আর কোনো মুসলমান থাকবে না। হয় তাদের হত্যা করা হবে, নয়তো বিতাড়িত করে উদ্বাস্তুতে পরিণত করা হবে। এই হৃদয়বিদারক মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিরব সাক্ষী আজ সমগ্র বিশ্ব। অথচ মুসলিম বিশ্বের সরকারগুলো, জাতিসংঘ, ওআইসি, আরব লীগসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো চুপ করে বসে আছে। এমনকি প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোও যেন চোখে ঠুলি পরে আছে। একইভাবে কয়েক বছর আগে মিয়ানমারে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা ও বিতাড়িত করা হয়েছিল। তারাও আজ বাংলাদেশে উদ্বাস্তু জীবনযাপন করছে।
বক্তারা প্রশ্ন তোলেন- ফিলিস্তিনসহ মুসলিম বিশ্বের এই করুণ অবস্থা ও নির্যাতনের প্রকৃত কারণ কী? কেউ বলবেন রাজনৈতিক, কেউ ভৌগোলিক, কেউ ধর্মীয় বা অর্থনৈতিক। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এগুলো কোনো প্রকৃত কারণ নয়, এগুলো শুধু ফলাফল। মূল কারণ হলো- আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও তওহীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুতি। ঈমান থেকে সরে গিয়ে মুসলমানরা ঐক্যহীন, দুর্বল ও বিভক্ত হয়ে পড়েছে; ফলে তারা আল্লাহর সাহায্য হারিয়ে পরাজিত হয়েছে।
বক্তারা বলেন, মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করে তওহীদের ভিত্তিতে একটি অনন্য জাতি ‘উম্মতে মোহাম্মদী’ গঠন করেছিলেন। এই জাতি ছিল আল্লাহর হুকুমের অধীনে, একজন নেতার নেতৃত্বে, ইস্পাত কঠিন ঐক্যে আবদ্ধ। তারা কেবল আল্লাহর বিধানকে মান্য করত, মানবপ্রণীত ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করত। ফলে সেই জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা, সংস্কৃতি, সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু আজ মুসলমানরা আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা পরিত্যাগ করে ইউরোপীয়দের তৈরি পুঁজিবাদ, বিচারব্যবস্থা, দণ্ডবিধি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে গ্রহণ করেছে। ঈমানের রশি ছিঁড়ে যাওয়ায় তারা বিভিন্ন ফেরকা, মাজহাব ও মতবাদে বিভক্ত হয়ে পরস্পরে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে। রাসুল (সা.) সতর্ক করেছিলেন- যে ঐক্য, শৃঙ্খলা, আনুগত্য, হিজরত ও জেহাদের বন্ধন ত্যাগ করে, সে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলেছে। কিন্তু আমরা সেই সতর্কবার্তা ভুলে গিয়েছি।
বক্তারা বলেন, জাতীয় জীবনে আল্লাহর হুকুম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণে আল্লাহ আমাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কোরআনের সুরা বাকারার ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- যারা আল্লাহর কিতাবের কিছু অংশ মানে আর কিছু অংশ অস্বীকার করে, তাদের জন্য দুনিয়াতে রয়েছে লাঞ্ছনা এবং আখিরাতে কঠিন শাস্তি। আজ সেই লাঞ্ছনা বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে। মুসলমানরা ব্যক্তি জীবনে ইবাদত করলেও জাতীয় জীবনে ইহুদি-খ্রিস্টানদের তৈরি করা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর ফলেই আজ তারা অপমানিত, শোষিত, নিধন ও বাস্তুচ্যুত।
বক্তারা পবিত্র কোরআনের সুরা তওবার ৩৯ নম্বর আয়াত উদ্ধৃত করে বলেন- “তোমরা যদি জেহাদে বের না হও, তবে আমি তোমাদের কঠিন শাস্তি দেব এবং তোমাদের স্থলে অন্য জাতিকে এনে স্থাপন করব।” আমরা যখন জেহাদ ও তওহীদের সংগ্রাম থেকে সরে এসেছি, তখনই আল্লাহ আমাদের সম্মান, শক্তি কেড়ে নিয়ে শত্রুদের আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। তাই আজ বিশ্বজুড়ে মুসলিম জাতি নিপীড়নের শিকার।
বক্তারা জানান, বসনিয়ায় দুই লক্ষ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, বিচার হয়নি। সিরিয়ায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ নিহত, ইরাকে নিহত দশ লক্ষ, লিবিয়ায় গণকবর, আফগানিস্তান ধ্বংসস্তূপে পরিণত, তবু কোনো বিচার হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আট কোটির বেশি মুসলমান বাস্তুচ্যুত হয়ে উদ্বাস্তু জীবন যাপন করছে। এই ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের কারণ আমাদের স্বার্থপরতা, আদর্শচ্যুতি, ঐক্যহীনতা, জেহাদ থেকে সরে যাওয়া এবং দীন থেকে বিচ্যুতি।
বক্তারা প্রশ্ন রাখেন- এই দুর্বিপাক থেকে মুক্তির উপায় কী? বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ, লংমার্চ, মানববন্ধন, পণ্য বয়কট কিংবা আত্মঘাতী হামলা কোনো টেকসই সমাধান নয়। মুক্তির একমাত্র পথ হচ্ছে- মুসলিম জাতিকে সব ফেরকা, মাজহাব, দলাদলি বাদ দিয়ে তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করা। জাতীয় জীবনে আল্লাহর দেওয়া দীন প্রতিষ্ঠার জন্য একজন নেতার নেতৃত্বে সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। আল্লাহ কোরআনে বলেছেন- “তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করো এবং এতে কোনো মতভেদ করো না” (সুরা শুরা ১৩)। শুধু প্রতিবাদ নয়, বাস্তব দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেই রক্ষা আছে।
তারা বলেন, বাংলাদেশও নিরাপদ নয়। এখানে যদি অনুরূপ সংকট দেখা দেয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ- আল্লাহর উপর নির্ভরশীল হয়ে জাতিকে জাগ্রত করা, ঐক্যবদ্ধ করে দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করা। আমাদের শ্লোগান হওয়া উচিত- হুকুম চলবে আল্লাহর, জাতি হবে এক, নেতা হবেন একজন, এবং আমরা আমাদের জ্ঞান, সম্পদ, জীবন দিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করব। তবেই এই জুলুম বন্ধ হবে- ইনশাআল্লাহ।
মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারী নারী-পুরুষের হাতে ছিল বিভিন্ন প্রতিবাদী শ্লোগানসম্বলিত প্ল্যাকার্ড। মানববন্ধন শেষে এক বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। এ সময় “ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধ করো- করতেই হবে”, “ফিলিস্তিনে হামলা কেন- জাতিসংঘ জবাব দাও” শ্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে রাজধানীর রাজপথ।