পথে হজ্জযাত্রীদের নেতা হিসাবে যাঁরা মক্কা শরীফ যান, তাঁদেরকে আমীরুল হজ্জ বলা হয়। হযরত উসমান (রা.) স্বেচ্ছায় আমীরুল হজ্জ হিসাবে মদীনা হতে মক্কায় যেতেন। এক বৎসর মদীনায় গোলমাল দেখা দিল। কয়েক শত বিদ্রোহী এসে রাজধানী অবরোধ করে বসল। সুতরাং হজ্জের মৌসুম যায়-যায় দেখেও হযরত উসমান (রা.) মদীনা ত্যাগ করতে পারলেন না। অতএব আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-কে সে বৎসরের জন্য আমীরুল হজ্জ নিযুক্ত করে খলীফা তাঁকে মদীনার হাজী-কাফেলার নেতৃত্বে পাঠালেন। আবদুল্লাহ (রা.) মক্কার পথে যাত্রা করলেন। কিন্তু তাড়াতাড়িতে তিনি যথেষ্ট খাদ্য সঙ্গে নিতে পারেন নি; ফলে পথে খাদ্য ফুরিয়ে গেল। আবদুল্লাহ (রা.) কাফেলা থামিয়ে তাঁবু গেঁড়ে বসলেন এবং নিকটস্থ পল্লী হতে খাদ্য সংগ্রহের জন্য লোক পাঠালেন। আবদুল্লাহ (রা.) এর লোকেরা গাঁয়ে এক কুটিরে একটি বুড়ীকে দেখতে পেয়ে তার কাছে গিয়ে কথাবার্তা শুরু করল।
‘মা, আমাদের কাছে কিছু খাদ্য বেচতে পার? আমরা ভারি বিপদে পড়েছি। খাদ্য আমরা উপযুক্ত দাম দিয়েই নিব।’
‘না, আমার কাছে দেবার মতো অতিরিক্ত খাদ্য নেই। আমি আর আমার দুই ছেলে, পরিবারে আমরা এই তিনটিই প্রাণী, এই তিনজনের জন্য যতটুকু দরকার, কেবল তাই ঘরে আছে।’
‘কিন্তু তোমার ছেলেরা কোথায় বুড়িমা?’
‘তারা কাঠ কাটতে জঙ্গলে গিয়েছে।’
‘আচ্ছা, তোমার ছেলেদের জন্য কি রান্না করেছ?’
‘মাত্র একটা বড় রুটি!’
‘এই রুটি ছাড়া খাবার আর কিছু নেই?’
‘কিছু নেই!’
‘বেশ, ঐ রুটির অর্ধেকটা আমাকে দাওÑআমি অনেক পুরস্কার দিব।’
‘আচ্ছা, তুমি আমাকে এত বখীল ও হীন মনে কর কেন? আমি তোমাকে একটা রুটির অর্ধেক কখনো দিতে পারি না। তোমার যদি অতই ঠেকা থাকে, বেশ, সমস্ত রুটিখানাই নিয়ে যাও। (এরপর রুটি নিয়ে তারা তাদের আমিরের নিকট যান এবং ঘটনা খুলে বলেন)
আবদুল্লাহÑতোমরা তো দেখছি এক অদ্ভুত মহিলার দর্শন পেয়েছিলে। তাঁকে দেখবার আমার অত্যন্ত ইচ্ছা হচ্ছে। যাও, তাঁকে এখানে দাওয়াত করে নিয়ে এস।
‘বুড়িমা, তোমাকে দাওয়াত।’
‘কোথায়?’
‘আমাদের তাঁবুতে।’
‘কারণ?’
‘আমাদের আমির মস্তবড় মানুষ, তিনি তোমাকে দেখতে চান।’
‘কিন্তু আমার মতো একজন গরীব বেদুঈন বুড়ীর সঙ্গে তোমাদের মনিব কেন দেখা করতে চায়?’
‘আর কিছুই নয়, মা, শুধু তোমাকে দেখে ভক্তি করা।’
‘আমার ভক্তির দরকার নাই, বাপু; আমি যেতে পারব না।’
‘কিন্তু যেতে যে তোমাকে হবেই, মা।’
‘কেন যেতেই হবে?’
‘তোমাকে নিতে না পারলে কি আমাদের মুখ থাকবে? হয়তো গর্দান যেতে পারে।’
‘বটে! আচ্ছা, তবে চল।’
আবদুল্লাহÑ(উঠিয়া অগ্রসর হয়ে) ‘এস, বুড়িমা, এস। আস্সালামু আলাইকুম।’
বুড়ীÑ‘ওয়া আলাইকুম আস্সালাম।’
‘তুমি কোন কওমের, মা?’
‘আমি বনি কলব কওমের অন্তর্গত।’
‘কেমন আজকাল তোমার চলছে?’
‘ভালোই চলছে। আমার নিজের রুটি নিজেই তৈয়ার করে গরম ছাইয়ের উপর সেকে নেই।’
‘তারপর?’
‘আমরা জঙ্গলের ঝর্ণার পানি খাই।’
‘আর?’
‘আর কিছু নাঃ আমরা ভাবনা-চিন্তাকে আমাদের বাড়ীর কাছে ঘেঁষতেই দেই না। আল্লাহ বেশ শান্তিতে রেখেছেন।’‘তোমার রুটিটা দিয়ে আমার মহা উপকার করেছ।’
‘ও কথা না হয় না-ই বল্লেঃ আমার নিজের প্রশংসা শুনতে তো আর তোমার কাছে আসি নাই।’
‘কিন্তু সবটুকু রুটি আমাকে দিয়ে দিলে, তোমার ছেলেদেরকে কী খাওয়াবে?’
‘আবার সেই একই কথা! রুটি সম্বন্ধে এই সব আবোলতাবল বকে তুমি সত্যি আমাকে শরম দিচ্ছ।’
‘কেন, বল তো মা?’
‘আচ্ছাÑতুমি-না মস্ত সর্দার, তা কোন একটা বড় বিষয়ে আলাপ করতে পার না? কেবল রুটিÑরুটিÑরুটি, আমি শুনে শুনে একদম হয়রান।’
‘তা কী করব, মা?’ ‘আল্লাহর ওয়াস্তে এ বিষয় ছেড়ে এখন অন্য বিষয়ে কথা কও।’
‘আচ্ছা, মা, আমি কসম খাচ্ছি, আর ও প্রসঙ্গে আমি কোন কথাই বলব না।’
‘খুব ভালো। এতক্ষণে তা হলে তোমার একটু বুদ্ধির লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি।’
‘এখন, বল মা, আমি তোমার কী উপকার করতে পারি?’
‘উপকার? কই, তার তো কোন পথ দেখি না।’
‘যদি অনুমতি কর, তোমাকে একটা উপহার দেই।’
‘কিন্তু চারদিকে তো গরীব দুখী আছে! তাদের দাবীই বড়। আমাদের তো খোদার ফজলে কোন ঠেকা নাই।’
‘কিন্তু তোমাকে একটা কিছু সওগাত না দিলে যে আমি মনে সোয়াস্তি পাচ্ছি না, মা?’
‘আচ্ছা কেবল ওরই জন্য যদি তুমি এত বেকারার থাক, তবে পাঠিয়ে দিও আমাকে সামান্য কিছু।’
আবদুল্লাহÑ‘দেখ, এক্ষুণি বুড়ীকে দশ হাজার দিরহাম ও চল্লিশটি উট পাঠিয়ে দাও।’
Ñইদ্রিস আহমদ