গণমাধ্যমের বর্তমান যে চেহারাটা আমরা দেখছি এটা কম্পিউটার ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রযুক্তির কল্যাণে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এতটা উন্নতি লাভ করেছে। এখন তথ্যের যুগ, তাই যে কোনো তথ্য আমাদেরকে জানতেই হবে এমন একটা চাপ অবচেতনভাবেই আমাদের উপর এসে পড়েছে। প্রিয়াঙ্কা চোপড়া খালার বাড়িতে গিয়ে পালং শাক দিয়ে ভাত খেয়েছেন, ক্যাটরিনার জন্মদিনে পরা পোশাকটার দাম কতো ইত্যাদি তথ্যও আজ আমাদের না জানলে চলছে না। কিন্তু পূর্বের শতসহস্র বছর মানুষ নির্ঝঞ্ঝাটে পার করে ফেলেছে সংবাদপত্র, টেলিফোন, ফেসবুক ইত্যাদি ছাড়াই। তখন কি মানুষ খুব খারাপ ছিল?
মোটেও তেমন নয়। কিন্তু সময়ের চাকা তো ঘুরে এখন যে অবস্থায় আমরা এসেছি সেই বাস্তবতাকে তো অস্বীকার করা যাবে না। আমরা শুধু এর সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করতে পারি, আর যেহেতু সব জিনিসেরই ভালোমন্দ দুটোই থাকে, এই তথ্য প্রযুক্তিরও ভালো দিকটাকে কাজে লাগাতে পারি। ভালোমন্দের মানদণ্ড আমাদের সব মানুষের মধ্যেই বাই ডিফল্ট স্রষ্টা দিয়েছেন। আমরা কোনটা ভালো আর কোনটা ক্ষতিকর সেই সাধারণ জ্ঞান সবারই আছে। যে কোনো ভালো জিনিসও যদি কেউ কুক্ষিগত করে নেয় এবং স্বার্থ হাসিলের কাজে ব্যবহার করে তাহলে সেটা থেকে বৃহত্তর কল্যাণ তো হয়-ই না, বরং সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা সংবাদমাধ্যমের জন্য যেমন সত্যি, তেমনি সত্যি কোনো প্রতিষ্ঠান বা কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্যও। যতক্ষণ কোনো কিছুর চরম লক্ষ্য হয় বৃহত্তর মানুষের কল্যাণ ততক্ষণ সেটা খুব ভালো ফল দেয়।
গণমাধ্যম বিষয়টা সময়ের ধাপে ধাপে নানরকম রূপ পরিবর্তন করেছে। গোড়াটা অবশ্যই হাতে লেখা দিয়ে। ব্রোঞ্জযুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠে বিভিন্ন সভ্যতা। যেমনঃ মিসরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয়া সভ্যতা, ব্যাবলনীয় সভ্যতা, ফিনিশীয় সভ্যতা, ইনকা সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতা ইত্যাদি। মিসরীয় সভ্যতায় আমরা হায়ারোগ্লিফিক্স বা পবিত্র লিপির সন্ধান পাই।
ব্যাবলনীয় সভ্যতার মহান সম্রাট হাম্মুরাবী (Hammurabi) একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রণিত আইনকে হাম্মুরাবী আইন বা Code of Hammurabi বলা হয়। এই আইনের বেশ কিছু নীতি ও ধারা বর্তমানের ব্রিটিশ আইনেও ব্যাবলনীয় সভ্যতায় লেখা হয়েছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগাম্মেশ (Gilgamesh)। নীলনদের অববাহিকায় প্রচুর নলখাগড়া উৎপাদিত হত। যা থেকে প্রস্তুত হতো প্যাপিরাস (Papyrus) নামের এক ধরনের কাগজ যা আমরা সবাই জানি। এই প্যাপিরাস ছাড়াও গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়া ও উটের চামড়ায় মূল্যবান দলিলপত্রসহ অনেক কিছু লিপিবদ্ধ করে রাখা হত। এছাড়া ২৫০০ খ্রি.পূর্বাব্দে চৈনিক সভ্যতা ও সিন্ধু সভ্যতায় লেখার পদ্ধতি ছিল। তবে প্রথম বর্ণমালার ব্যবহার হয় ১২শ-১৩শ খ্রী.পূর্বাব্দে লেবানন এলাকায় উদ্ভূত ফিনিশিয় সভ্যতায়। এতে কোনো স্বরবর্ণ ছিল না। এই লিপিতে লেখা একটি পাথর মৃত সাগরে পাওয়া যায়। যেখানে মোয়াবের রাজা ও ইসরাঈলের রাজার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছিল।
ফিনিশীয়রা লিখন পদ্ধতির যে রূপ দান করেছিল গ্রিকরা স্বরবর্ণ সংযোজনের মাধ্যমে লেখার পদ্ধতিকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়। রোমানরা একটি চূড়ান্ত ও সামগ্রিক রূপ দিয়ে তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে যোগাযোগ পদ্ধতিকে সুষম ও সহজতর করে তুলেছিল।
বর্ণমালাভিত্তিক লেখার কৌশল আবিষ্কার হবার পর মানুষ চিন্তা-ভাবনা শুরু করে কিভাবে সময়, অর্থ ও শ্রম বাঁচিয়ে যোগাযোগকে আরো গতিশীল করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায়, ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানীর জোহানেস জেনসকিচ গুটেনবার্গ টাইপ আবিষ্কার করেন।
এখন যেমন দৈনিক পত্রিকা একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম, একটা সময় এই জায়গাটি দখল করে ছিল বই। কিন্তু বইয়ের গতি অতি মন্থর। দ্রুত সংবাদ পৌঁছানোর পদ্ধতিও ছিল। প্রাচীন রোমে তিন রাস্তার মোড়ে বিভিন্ন দালান-কোঠা থেকে জানিয়ে দেওয়া হত দেশের পক্ষ থেকে কী বলা হচ্ছে। তিন রাস্তার এই মোড়কে বলা হত Trivia অনেকের মতে, প্রথম সংবাদপত্র পাওয়া যায়, জুলিয়াস সিজারের আমলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ এর দিকে। সেই সময়ে রোমে এক ধরণের লোক কাজ করতো যাদেরকে বলা হত সংবাদ লেখক বা News writer. তারা সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে প্রাত্যহিক দিনলিপি সংগ্রহ করতো। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময়ে প্রতিষ্ঠিত Acta-diarma কে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সংবাদ নামে অভিহিত করা হয়।
আমরা জানি নবী মোহাম্মদ (সা.) এর সময় আরবে কাব্যচর্চার প্রচলন ছিল। এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পবিত্র কোর’আনও অনন্য কাব্যগুণ সম্পন্ন। সে যুগে কবিরা অনেকাংশে গণমাধ্যমকর্মীর কাজ করতেন। তারা কবিতার ছন্দে ঘটনাবলী বর্ণনা করতেন, সেই কবিতা শুনে অনেকেই সেটা হুবহু অন্যের কাছে বর্ণনা করতে পারতেন। এভাবে তথ্য প্রবাহিত হতো। ইসলামের শাসনব্যবস্থা যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন এই তথ্যের আদান প্রদানের বিষয়ে বেশকিছু নৈতিকতা আরোপিত হলো। পবিত্র কোর’আনে সেগুলো কয়েকটি পৃথক আয়াতে বিবৃত হয়েছে।
১. হে মো’মেনগণ! যদি কোনো পাপাচারী তোমাদের নিকট কোনো বার্তা আনয়ন করে তোমরা তা পরীক্ষা করে দেখবে। পাছে অজ্ঞতাবশত কোনও সম্প্রদায়কে ক্ষতি করে বস”। (সুরা হুজরাত, ৬)
২. তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত কোর না এবং জেনে শুনে সত্য গোপন কোর না” (সুরা বাকারা, ৪২)।
৩. হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান অপরাধ। অন্যের দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো পরনিন্দা না করে। (সুরা হুজরাত, ১২)
এসকল স্বচ্ছতার মূল্যবোধ নিয়ে মুসলিম সভ্যতার সোনালী যুগে গণমাধ্যম একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। এগার থেকে চৌদ্দ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় Town criers বা নগর লেখক নামে লোক নিয়োজিত ছিল। যেসব জাহাজ সমুদ্র বা নদী বন্দরে ভিড়তো সেইসব জাহাজের প্রান্ত সংবাদ চিৎকার করে এবং ঘণ্টা বাজিয়ে শোনানো হত। ইরাকের রাজধানী বাগদাদে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, যার নাম ছিল Clear house of information. এই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাক্তির পদবী ছিল Shihab-al-Barid বা Master of Post. বাংলা অর্থ ডাক ও তথ্য বিভাগের মহাপরিচালক।
প্রকৃতপক্ষে আদিমসমাজ থেকে সভ্য সমাজে আরোহণকারী মানুষের মধ্যে যোগাযোগ প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক হিসেবে ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও রাজপ্রাসাদের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ। নতুন কোনো আদেশ জারি করার প্রয়োজন হলে রাজার পক্ষ থেকে ঘোষকরা এলাকায় এলাকায় গিয়ে ঢেড়া পিটিয়ে সেটা জানিয়ে দিয়ে আসতো। ধর্মগ্রন্থ ও রাজার ফরমান লেখার জন্য লেখালেখিটা বেশি প্রয়োজন হতো। কিন্তু, পঞ্চদশ শতকে আবির্ভাব ঘটে গুটেনবার্গের মুদ্রণযন্ত্রের। শুরু হয় গণমাধ্যমের যুগ। গণমাধ্যমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকেই আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে ইন্টারনেট যুগ।
বর্তমানে গণমাধ্যমগুলো যেমন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে এমন অবস্থা অতীতে ছিল না, তা বলা বাহুল্য। আর বাণিজ্যিক স্বার্থে সাংবাদিতার মধ্যেও দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। সাংবাদিকতায় দুই নম্বরি কাজকে ভদ্রভাষায় হলুদ সাংবাদিকতা বলে। হলুদ সাংবাদিকতা মানেই ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকর্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি ইত্যাদি।
সাংবাদিকতায় বিরাট ভূমিকা রাখলে পুলিৎজার পুরস্কার দেওয়া হয়। জোসেফ পুলিৎজার ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের এক খ্যাতনামা সম্পাদক যিনি উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট নামে অপর এক সম্পাদকের সঙ্গে অরুচিকর পেশাগত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন। এই দুই সম্পাদক অন্য প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের অধিক বেতনে নিজেদের প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত কেলেংকারির চাঞ্চল্যকর খবর ছেপে তারা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর চেষ্টা করেন। তাদের এই দ্বন্দ্ব থেকেই হলুদ সাংবাদিকতার জন্ম।
বর্তমানেও আমরা দেখি ভালমত গবেষণা বা খোঁজ-খবর না করেই নজরকাড়া শিরোনাম দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। গণমাধ্যম পরিচালনায় যতদিন অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রাধান্য পাবে, ততদিন এই নীতিহীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। অনেক বড় বড় মনীষী জীবনের কোনো না কোনো অধ্যায়ে সাংবাদিকতা করেছেন। এক সময় সাংবাদিকদের জাতির বিবেক বলে মনে করা হতো, এখন অনেক সাংবাদিককে তথ্য সন্ত্রাসী বলে অভিহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটাতে গণমাধ্যমকর্মীদের একটি উন্নত, মানবিক, স্বার্থহীন আদর্শিক প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হওয়ার পাশাপাশি বস্তুতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আবশ্যক যা তাদেরকে ভিতর ও বাহির থেকে ন্যায়ের সৈনিকে পরিণত করবে।