মো. মশিউর রহমান
মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে চতুর মানুষেরা চিরকালই স্বার্থ হাসিল করেছে। এর মধ্যে ধর্মনেতারা অন্যদের থেকে এক কদম এগিয়ে থাকেন, কারণ তাদের শাস্ত্রবাক্য জানা থাকে। এর বাইরেও যারা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য লালায়িত তারাও জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করেন সুবিধামত। আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোও যারা পালাক্রমে সরকার গঠন করে আসছে বিগত ৪৭ বছর ধরে, তারাও ধর্মকে ক্ষমতায় আরোহণের সিঁড়ি বানিয়ে ধর্মব্যবসায় লিপ্ত। ধর্মব্যবসায়ীদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দলে ভেড়াচ্ছে। ক্ষমতাসীনরাও যখন ধর্মব্যবসা করে তখন দেশ থেকে ধর্মব্যবসা দূর করা কি আদৌ সম্ভব – এমন প্রশ্ন সচেতন মানুষ প্রায়শই করে থাকেন।
প্রশ্নটি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং দুঃখজনক। আমরা যদি একটু পেছন ফিরে চাই দেখন, আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলাম যখন হারিয়ে গেল তখন একদল স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সে ইসলামটাকে রোজগারের বাহন হিসেবে ব্যবহার করছে, কুক্ষিগত করছে। মানুষ আল্লাহকে পাওয়ার জন্য তাদেরকে হাজার হাজার টাকা দিচ্ছে। কিন্তু আল্লাহকেও পায়নি, রসুলকেও পায়নি। দুঃখ লাগে, যারা আল্লাহর দীনকে প্রত্যাখ্যান করেছে, জাতীয় জীবনে ইসলাম চায় না তারাও পর্যন্ত ধর্মকে ব্যবহার করেছে। তারা প্রথমে ভেবেছে ধর্মের কাছে যাবে না। কিন্তু না চাইলেও বাস্তবতা হলো, বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে ধর্ম এখন প্রধান ইস্যু। ভারত এখন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছে। একশ’ বছরের পুরনো কংগ্রেসকে পরাজিত করে ধর্মধারী অর্থাৎ ধর্মের দাবিদাররা এখন ক্ষমতায়। আজকে ফ্রান্সে, জার্মানিতে, ইংল্যান্ডে পর্যন্ত ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেন মুসলমান বিদ্বেষ বক্তব্য দিয়ে, এখনও সেখানে বর্ণবাদী বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে। একদল শিয়ার পক্ষে, আরেক দল সুন্নির পক্ষে। আমাদের দেশেও স্বাধীনতার পর ইসলামকে ব্যবহার করে, মানুষের ইমানকে হাইজ্যাক করে জাতিবিনাশী কর্মকা- ঘটানো হয়েছে।
কাজেই ওই সেক্যুলার দলগুলি যারা প্রকৃতপক্ষে গোড়া থেকে ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা শুরুতে ধর্মের ধারে-কাছেও যাননি, এখন দেখেছেন ধর্ম প্রধান ইস্যু, এটাকে ফেলে দেয়া যায় না। আমরা যদি অবজ্ঞা করি বা এই মত পোষণ করি যে, ধর্ম তো একটা নিকৃষ্ট জিনিস। মূর্খ লোকেরা ধর্ম-কর্ম করে। আজকের এই আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে ধর্ম চলে নাকি? একথা বলে অবজ্ঞা করে আর ফেলে রাখা যাচ্ছে না, কারণ এখন ধর্মই প্রধান ইস্যু। এই ধর্মীয়দলগুলি বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়ে সারা দুুনিয়াতে, মিয়ানমারে ধর্মীয় ইস্যু সৃষ্টি করে দিয়ে বৌদ্ধধর্মের উগ্র অনুসারীদেরকে লেলিয়ে দিয়েছে মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এটা ধর্মের শিক্ষা ছিল না যেটা আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বলছি। কাজেই জনমনে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায় দাঙ্গা সৃষ্টি করা হচ্ছে, ওমুক সরকার নাস্তিক, অমুক ক্ষমতায় আসলে মন্দির হয়ে যাবে, অমুককে ভোট দিলে তুমি জাহান্নামে যাবে, ভোট আমাদেরকে দাও তুমি জান্নাতে যাবে, এটা ভোট নয় জান্নাতের টিকেট ইত্যাদি ইত্যাদি।
মানুষ আল্লাহকে পেতে চায় যতই পাপ করুক না কেন। আমি চট্টগ্রামে দেখেছি, সারাবছর অবৈধ ব্যবসা করে, বছর শেষে পীর সাহেবের মাজারে গিয়ে বিরাট গরু দিয়ে আসে। তার ধারণা গরু তাকে জান্নাতে নিয়ে যাাবে। এই ঈমানকে অস্বীকার করতে পারে নাই সরকারগুলো, রাজনৈতিকদলগুলো। তখন তারাও কৌশল পাল্টালেন। তারা ভাবলেন, আমরাও ধর্মকে কাজে লাগাব। নির্বাচন যখন আসে দেখবেন বহর নিয়ে হজ্ব করতে যায়, হজ্বের ছবি প্রচার করা হয়। মাজার থেকে শুরু হয় নির্বাচনী কার্যক্রম। মাহফিলগুলোতে হাজির হন টুপি মাথায়, মসজিদ কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক আগেই দখল। মাইক্রোফোনে বলতে থাকেন অতগুলো মসজিদ দিয়েছি, মাদ্রাসা দিয়েছি, মক্তব বসিয়েছি। দলে দলে মৌলভী সাহেবরা আসেন আর টাকা নিয়ে যান, এগুলো সব প্রচার করা হয় গণমাধ্যমে। আর এই মৌলভী সাহেবরা ঈমানকে বিক্রি করেছেন টাকার কাছে। চিন্তাও করেন না এ টাকা কোত্থেকে আসলো।
তাহলে এই যখন অবস্থা, যে ধর্ম এসেছে মানুষের কল্যাণের জন্য, যে দীন প্রতিষ্ঠিত হলে আমরা মুক্তি পাব সেই দীনকে একদিকে স্বার্থের জন্য ব্যবহার করছেন ধর্মব্যবসায়ীরা, আরেকদিকে ব্যবহার করছে ওই ধান্দাবাজ স্বার্থপরেরা। কিন্তু মানুষ ইসলাম পায়নি, ধর্মের মূল শিক্ষা পায়নি, আল্লাহ রসুলের ইসলামের মূল আকিদাও পায়নি। মধ্যখানে প্রতারিত হচ্ছে মানুষ। মুক্তিকামী জনতা মুক্তি পাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে আসলে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ও জটিল। কিন্তু সত্য যখন এসে যায় তখন মিথ্যাকে বিতাড়িত হতেই হয়। আল্লাহকে, রসুলকে নিয়ে রাজনীতি চলে না। তাই আমার কথা হচ্ছে, সাবধান! আস্তিক বা নাস্তিক হোন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী বা ডানপন্থী হোন, আর তথাকথিত ইসলামপন্থী হোন না কেন আপনার হদয়ের খবর আল্লাহ জানেন। কাজেই আল্লাহকে নিয়ে রাজনীতি করবেন না। আল্লাহকে ধারণ করুন, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে হদয়ে ধারণ করুন। তাহলেই সমাজ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে, মানবতা বাঁচবে।
[লেখক: সাংবাদিক ও সংগঠক; যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫]