নজরুল ছিলেন দাবা খেলার ওস্তাদ। বড় বড় দাবাড়ুদের সাথে তিনি দাবা খেলার প্রতিযোগিতায় নামতেন। ডক্টর কাজী মোতাহের হোসেন, কোলকাতায় গেলে তাঁর সাথে প্রায়ই খেলা হতো তাঁর।
একদিন গিয়ে দেখলাম, তিনি তাঁর দোতালার কামরায় দাবার ছক নিয়ে বসে নাড়াচাড়া করছেন। বিছানা এলোমেলো। চারিদিকে সিগারেটের ছাই। সদ্য নিঃশেষিত চায়ের কাপগুলো দেখে মনে হলো, এইমাত্র এখানে আড্ডা ভেংগে গেছে। যাঁর সকাল থেকে এসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, তাঁরা এইমাত্র চলে গেছেন।
কবি একা বসে আছেন। হাতে কোন কাজ না থাকায় দাবার ঘুঁটি নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন। বল্লামঃ “কি করছেন? দাবা খেলবেন নাকি এক হাত?”
হেসে কবি বল্লেনঃ “তুই খেলতে জানিস নাকি?”
বল্লামঃ “কিছু কিছু জানি।”
কবি বল্লেনঃ “আচ্ছা বোস তা’ হ’লে।”
ঘুঁটিগুলো সাজিয়ে বসা গেলো। তিন চার মিনিটের মধ্যেই তিনি আমাকে মাত করে দিলেন।
বল্লেনঃ “তুই তো কিছুই খেলা জানিস্ না রে।”
বল্লামঃ “হুঁ, তা বইকি! খেলিনি তাই।”
“বেশ, তা হলে আবার বোস্।” -কবি ঘুঁটিগুলো সাজালেন। এবার আমি খুব সাবধানে খেল্লাম। এবার আমাকে মাত করতে তাঁর বোধ হয় চার মিনিটের কম সময় লাগলো।
বল্লেনঃ “আরো খেলবি?”
বল্লামঃ “হু-”।
আবার বসা হলো। তিনি আমাকে নিতান্ত উপেক্ষা করে খুব অমনোযোগী হয়ে খেল্ছিলেন। এবার আমি ফাঁক পেয়ে প্রথমেই তাঁর মন্ত্রীকে গজ দিয়ে কোনাকুনি মেরে দিলাম। তিনি অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে তাকালেন আর বল্লেনঃ “তুই তো দাবার নিয়ম-কানুন কিছুই জানিস্না।”
তিনি সবগুলো ঘুঁটি তুলে নিলেন। বল্লেনঃ “বেশ ! আমার মন্ত্রী, নৌকা, গজ তুলে রাখলাম। শুধু কয়েকটা বড়ে দিয়ে তোর সাথে খেলবো।
এবার আমাকে মাত করতে তাঁর পাঁচ মিনিটের বেশী সময় লাগেনি মৃদু হেসে কবি বল্লেনঃ “তুই দাবা খেলার কিছুই জানিস না। অথচ আমার সাথে খেলতে তোর সাহস হলো?”
বল্লামঃ “আমি যে দাবা খেলার কিছুই জানি, আমি তা ভালো করেই জানি। তবে ইউসুফ আলায়হিস্ সাল্লামের কিস্সা আপনার মনে আছে? সেই মিসরের বাজারে যখন তাঁকে বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো? আর হাজারে হাজারে লোক উটের পিঠে আশ্রফী বোঝাই করে তাঁকে কিনতে এসেছিল? এক বুড়ি এসেছিল সেই দলে, মাত্র দু’-একটা টাকা নিয়ে।
লোকেরা বলেছিলঃ বুড়ি, তুই কোন সাহসে এলি?
বুড়ি হেসে বলেছিলঃ বাবা, বুঝতে পারছো না? আমি কিনতে পারবো না, জানি। কিন্তু হযরত ইউসুফের ক্রেতার দলে আমাকে নাম লেখা থাকবে তো?
আমারও সেই বুড়ির দশা। আপনাকে কোন সময় একা পাওয়া যায় না। এই সুযোগে আপনার সাথে দু’এক হাত দাবা খেলে নিলাম। বন্ধুদের কাছে গর্ব করে বলতে তো পারবো, নজরুল ইসলামের মতো বিখ্যাত দাবাড়ুর সাথে আমি দাবা খেলেছি!”
হো হো করে হেসে কবি ঘর ফাটিয়ে দিলেন। আর পিঠে কী বিরাট চাপ্পড়।
(সংগ্রহে: মালিহা আবদুল্লাহ)