কাজী নজরুল ইসলাম
ক্ষুদিরামের ফাঁসির সময়ের একটি গানে আছে, ক্ষুদিরাম বলছে
“আঠার মাসের পরে
জনম নেব মাসীর ঘরে, মা গো,
চিনতে যদি না পার মা
দেখবে গলায় ফাঁসি”
সেই হারা-ক্রন্দনের আশ্বাস-গান শুনে আজো অতি বড় পাষাণী মেয়েরও চোখে জল আসে, গা শিউরে ওঠে। আমাদের মত কাপালিকেরও রক্ত-আঁখি আঁখির সলিলে টলমল ক’রে ওঠে। কিন্তু বলতে পার কি দেশের জননীরা, আমাদের সেই হারা-ক্ষুদিরাম তোমাদের কার ঘরে এসেছে? তোমরা একবার তোমাদের আপন আপন ছেলের কণ্ঠের পানে তাকাও, দেখবে তাদের প্রত্যেকের গলায় ক্ষুদিরামের ফাঁসির নীল দাগ। ক্ষুদিরাম ছিল মাতৃহারা। সে কোন্ মাকে ডেকে আবার আসবে ব’লে আশ্বাস দিয়ে গেছে, কেঁদে গেছে, তা যদি বুঝতে বাঙলার মা’রা, তা হ’লে তোমাদের প্রত্যেকটি ছেলে আজ ক্ষুদিরাম হ’ত। ক্ষুদিরাম ছেলেবেলায় মা হারিয়ে পেয়েছিল সারা দেশের মায়েদের। মায়ের স্নেহের ক্ষুধা তার মেটেনি, তোমাদের সকলকে মা ব’লে ডেকেও সে তৃপ্ত হয়নি, তাই আবার আসব ব’লে কেঁদে গেছে। এবার অভিমানী ছেলে মায়ের ঘরে আসবে না, মাসীর ঘরে আসবে। কিন্তু অভিমানী হ’লে কি হয়, ও ছিল বোকা ছেলে, তাই বুঝতে পারেনি যে, মাসীর ঘর ব’লে অভিমান ক’রে যার ঘরে আসতে চেয়েছে, সেও যে মায়েরই ঘর।
মায়ের সাড়া পায় নাই, মা’রা তাকে কোলে নেয়নি, তাই অভিমানে সে আত্মবলিদান দিয়ে আত্মনির্যাতন ক’রে মায়েদের অনাদরের প্রতিশোধ নিয়েছে। যাবার বেলায় দস্যি ছেলে এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলে গেল না। হায় হতভাগা ছেলে! কার জন্যে সে কাঁদবে? যার জন্যে কাঁদবার কেউ নেই, তার চোখের জল যে লজ্জা, তা’র কাঁদাটাও যে অপমান। দস্যিছেলে সব চোখের জলকে কণ্ঠের নীচে ঠেলে রাখলে। ফাঁদি প’রে নীলকণ্ঠ হবার আগেই ব্যথায় নীলকণ্ঠ হয়ে গেল। প্রাণের তিক্ত ক্রন্দনের জ্বালা তার কেউ দেখলে না, দেখলে শুধু কিশোর ঠোঁটের অপূর্ব হাসি। ফাঁসি হ’তে আর দু’চার মিনিট বাকী, তখনও সে তার নিজের ফাঁসির রশির সমালোচনা নিয়ে ব্যস্ত যে, ফাঁসির রজ্জুতে মোম দেওয়া হয় কেন! তোমরা কি ভাবছ মা যে, কি সাংঘাতিক ছেলে বাপু! কিন্তু ছেলে যতই সাংঘাতিক হোক, সত্যি করে বল দেখি, ঐ মাতৃহারা তোমাদেরই মুক্তির জন্য ফাঁসিতে যাওয়ার কথা শোনার পরেও কি তোমরা নিজেদের দুলালদেরে বুকে ক’রে শুয়ে থাকতে যন্ত্রণা পাও না? ঐ মাতৃহারার মরা লাশ কি তোমাদের মা ও ছেলের মধ্যে এসে শুয়ে একটা ব্যবধানের পীড়া দেয় না? নিজের ছেলেকে যখন আদর করে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় যাবতীয় সামগ্রী খাওয়াও, নিবিড় স্নেহে বুকে চেপে ধরে শুয়ে ঘুম পাড়াও, একটু অসুখ করলে তেত্রিশ কোটি দেবতার পায় মাথা খোঁড় তখন কি এই মাতৃহীন ক্ষুদিরামের কথা তারই মত আরো সব লক্ষ্মী-ছাড়া মাতৃহারাদের কথা মনে হয়ে তোমাদের বুকে কাঁটার মত বেঁধে না? তোমাদের এত স্নেহে এত মায়া কি অনুশোচনায়, লজ্জায় সঙ্কুচিত হয়ে উঠে না? বল মা, উত্তর দাও! আজ ঐ ক্ষুদিরামের মত শত লক্ষ্মীছাড়া ছেলে এসে তোমাদেরে তোমাদের মাতৃহৃদয়ের নামে জিজ্ঞাসা করছে, উত্তর দাও! জানি, উত্তর দিতে পারবে না, মুখে কথা ফুটবে না। তুমি বলতে যাবে, কিন্তু অমনি তোমার মনের মা তোমার মুখ টিপে ধরবে! মানুষের মন আর আত্মা এমনি বালাই যে, পরের দুঃখ দেখে তার নিজের ভোগ বিস্বাদ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে মা-দের। মাতৃহারা এক পাশে দাঁড়িয়ে জল-ছলছল চোখে যদি চায়, তা’হলে তোমার হাত উঠবে না তোমার ছেলের মুখে কিছু তুলে দিতে, আপনি শিথিল হয়ে যাবে। এটাও সওয়া যায়। কিন্তু যদি কোনো মাতৃহারা বিদ্রোহ ক’রে কারুর কাছে কিছু না চায়, মাথা উঁচু ক’রে কোনো মায়ের ঘরের পানে না তাকিয়ে তার রুক্ষ কেশ লক্ষ্মীছাড়া মূর্তির রুদ্রকেতন উড়িয়ে চলে যায়, ডাকলেও ঘরের পানে তাকায় না, মায়ের ডাকে চোখ ছলছল না ক’রে উল্টো আত্মনির্যাতন করে তোমাদের চোখের সামনে, তা’হলে মায়ের মন কেমন ক’রে ওঠে বল দেখি? হে আমার দেশের জননীরা! তোমাদের কাছে এসেছে তেমনি বিদ্রোহী লক্ষ্মীছাড়া মাতৃহারার দল, তাদের হারানো ক্ষুদিরামকে খুঁজে নিতে। ভয় করো না, বিদ্রুপ করো না এদের মা, এরা ভিখারী ছেলে নয়। আমরা তোমাদের কাছে করুণা ভিক্ষা করতে আসিনি, আসবও না। আমরা এসেছি আমাদের দাবী নিয়ে, আমাদের হারানো ক্ষুদিরামকে ফিরে নিতে। সে যে আমাদের মাতৃহারার দলের, সে মায়ের দলের নয়। ক্ষুদিরাম গেছে, কিন্তু সে ঘরে ঘরে জন্ম নিয়ে এসেছে কোটি কোটি ক্ষুদিরাম হয়ে। তোমরা চিনতে পারছ না, তোমরা মায়ায় আবদ্ধ। ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও আমাদের ক্ষুদিরামকে তোমাদের ছেলেদের ছেড়ে দাও, ওরা আমাদের আমাদের লক্ষ্মীছাড়ার দলের। ওরা মায়েদের নয়, ওরা ঘরের নয়, ওরা বনের। ওরা হাসির নয়, ফাঁসির। ঐ যে কণ্ঠে হাত দিয়ে জড়িয়ে বুকে চেপে ধরছ, ঐ কণ্ঠে ফাঁসির নীল দাগ লুকানো আছে। ওরা তোমার নয়, আমার নয়, ওরা দেশের, ওরা বলিদানের, ওরা পূজার।
কোথায় প্রতি ঘরে ঘরে। কিন্তু আঠার বছর যে কেটে গেল ভাই, সাড়া দাও সাড়া দাও আবার, যেমন যুগে যুগে সাড়া দিয়েছ ঐ ফাঁসি-মণ্ডপের রক্ত-মঞ্চে দাঁড়িয়ে। তোমার সাথে আমাদের বারবার দেখাশুনা ঐ ফাঁসি-পরা হাসি-মুখে! আর একবার সাড়া দিয়েছিলে তুমি আয়র্ল্যাণ্ডে রবাট এমেট নামে। সেদিনো এমনি তরুণ বয়সে তুমি ফাঁসির কৃষ্ণ-আলিঙ্গন, খড়গের সুনীল চুম্বন পেয়েছিল। হারা প্রিয়া ‘সারা’র আলিঙ্গনপরশ তোমার জন্য নয়, কমলার প্রসাদ তোমার জন্য নয়, তোমার প্রিয়ার তুমি এমনি বারে বারে পাবে আবার বারে হারাবে, তোমার প্রিয়ার চেয়েও প্রিয়তম ঐ ফাঁসির রশি। কোথায় কোন্ মাতৃ-বক্ষে কোন্ “সারা”র কোন্ কমলার কুঞ্জে আপন ভুলেছ, হে ক্ষুদিরামের জাগ্রত আত্মা। সাড়া দাও! সাড়া দাও! এস আবার ফাঁসিমঞ্চে, আর একবার নতুন ক’রে আমাদের সেই চির-নূতন চির-পুরাতন গান ধরি
“আঠার মাসের পরে,
জনম নেব মাসীর ঘরে, মা গো
চিনতে যদি না পার মা,
দেখবে গলা ফাঁসি!”