আখেরি নবী বিশ্বনবী (সা.) আল্লাহপ্রদত্ত ঐশী বিধান নিয়ে আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে কঠোর সাধনা ও সংগ্রাম করে আরব উপদ্বীপে একটি মানবিক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপন করেন। তাঁর এন্তেকালের পর তাঁরই হাতেগড়া জাতি অর্থাৎ সাহাবীরা বাকি অর্ধ পৃথিবীতে তাঁরই দেখানো নিয়ম মোতাবেক সংগ্রাম করে ইসলামের সুমহান আদর্শ দিয়ে ন্যায়বিচার, সুবিচার, মানবতা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে এই যে, সেই সত্যনিষ্ঠ মানুষগুলো একে একে চলে যাওয়ার পর সময় যত গড়িয়েছে ইসলামের গৌরব তত ম্লান হয়েছে। নানাবিধ মতবাদের সৃষ্টি হয়ে জাতি হাজারো মাজহাব, ফেরকা, তরিকায় ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একে একে এসেছে ক্রুসেডাররা, মঙ্গোলরা। তারা ইসলামের কেন্দ্রগুলোতে হামলা করে মুসলিম জাতিকে পদানত করেছে। পরবর্তীতে ইউরোপীয় খ্রিষ্টান শক্তিগুলো এসে প্রায় পুরো মুসলিম বিশ্বকেই তাদের দাসে পরিণত করে এবং তাদের জীবনব্যবস্থাই পাল্টে দেয়। এই যে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনগুলো মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলোর বিরুদ্ধে চালানো হলো, এই আগ্রাসনের পক্ষে সৈন্য সংগ্রহের জন্য ও নিজ দেশের নাগরিকদের মনোভাব ইসলামের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়ার জন্য আক্রমণকারী রাজশক্তি ও তাদের ধর্মীয় নেতারা ইসলামের বিরুদ্ধে, রসুলাল্লাহর বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার চালায়। ইসলামের ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে হাজার হাজার বই লেখা হয়। এভাবে বিশ্বজুড়ে ইসলামবিদ্বেষী মতবাদ ও ইসলামভীতির ব্যাপক প্রসার হয়। নাস্তিক্যবাদী যে দর্শন এখন আমাদের সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সেটা সেই ক্রুসেড যুগের প্রোপাগান্ডারই ধারাবাহিকতা। এই নাস্তিক্যবাদীরা মূলত ইসলামবিদ্বেষী। তারা ইসলামের বিরুদ্ধে ভীতি ও ঘৃণা প্রচার করার ক্ষেত্রে অনেক সময় বলে থাকেন, কোর’আনে আল্লাহ বিধর্মীদের গর্দানে ও গিরায় গিরায় আঘাত করার নির্দেশ, তাদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকা ও যেখানে পাবে সেখানেই হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাহলে ইসলাম কী করে মানবিক বা পরমতসহিষ্ণু ধর্ম হতে পারে?
এই প্রশ্নটির জবাবে আমরা বলব, পবিত্র কোর’আনের এই আয়াতগুলো ইসলামবিদ্বেষীদের দ্বারা যেমন আলোচিত তেমনি জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীগুলোও এ আয়াতগুলোকে তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা ও ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। এখানে মূলত দুটো আয়াতের উল্লেখ করা হয়েছে।
(১) স্মরণ কর, তোমাদের প্রতিপালক মালায়েকগণের প্রতি প্রত্যাদেশ করেন, “আমি তোমাদের সঙ্গে আছি, সুতরাং মো’মেনদেরকে অবিচলিত রাখ; যারা কুফরি করে আমি তাদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করব, সুতরাং তাদের স্কন্ধে ও সর্বাঙ্গে আঘাত কর।” (সুরা আনফাল: আয়াত ১২)
(২) অতঃপর যখন নিষিদ্ধ মাসগুলো অতিবাহিত হয়ে যাবে, তখন তোমরা মুশরিকদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে পাকড়াও কর, তাদেরকে অবরোধ কর এবং তাদের জন্য প্রতিটি ঘাঁটিতে বসে থাক। তবে যদি তারা তাওবা করে এবং সালাত কায়েম করে, আর যাকাত দেয়, তাহলে তাদের পথ ছেড়ে দাও। নিশ্চয় আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সুরা তওবা: আয়াত ৫)
এই আয়াতগুলোকে এই দুটো গোষ্ঠী অর্থাৎ ইসলাম বিদ্বেষী ও জঙ্গিবাদীরা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে থাকে। জঙ্গিবাদীরা ভিন্ন ধর্মের বা মতের অনুসারীদের প্রকাশ্য বা গুপ্তহত্যার নির্দেশ হিসাবে এগুলো প্রচার করে। আসলে বিষয়টি কী?
প্রকৃত বিষয় হলো ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, সেহেতু এতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি বিধানের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা বা সামরিক বিভাগের নীতি-নির্দেশ বা কৌশলও বিবৃত হয়েছে। যে কোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য প্রতিরক্ষা কৌশল ও সেনাবাহিনী থাকা আবশ্যক। আল্লাহর রসুল যখন মক্কায় ছিলেন তখন তাঁর কোনো সেনাবাহিনী বা সামরিক তৎপরতার প্রয়োজন পড়ে নি। সেটা ছিল রসুলাল্লাহর জেহাদের সাংগঠনিক পর্যায় অর্থাৎ মানুষকে বুঝিয়ে, যুক্তিতর্ক দিয়ে, সদুপদেশ দিয়ে জাহেলি সমাজে বিরাজিত ভুল আদর্শের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে নিজ আদর্শের দিকে আকৃষ্ট করার যুগ। এটি তাঁর বিপ্লবী জীবনের একটি পর্যায়।
কিন্তু যখন আল্লাহ তাঁকে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামের চর্চা করার জন্য একটি ভূখণ্ড দান করলেন, তখন প্রয়োজন পড়ল নিজ ভূখণ্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও নিজ জাতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাছাড়াও তখন নবগঠিত মদীনা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি এর অন্তর্ভুক্ত ইহুদি ও অন্যান্য গোত্রগুলোর মধ্যে একটি নিরাপত্তাচুক্তি করেন যেখানে রসুলাল্লাহকে সবাই জাতির একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে মেনে নেয়। এজন্য প্রত্যেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র যেমন নিজ নিজ সামরিক বাহিনী গঠন করে, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি বা জোট গঠন করে তেমনি রসুলাল্লাহকেও বিভিন্ন গোত্রের সঙ্গে সনদ বা চার্টার প্রণয়ন করতে হয়েছে, আক্রান্ত হলে যুদ্ধ করতে হয়েছে, চিহ্নিত শত্রুদেরকে অগ্রবর্তী হয়েও আক্রমণ করতে হয়েছে।
এখানে যে আয়াতগুলো উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলো হচ্ছে ইসলামের যুদ্ধনীতি সংক্রান্ত আয়াত। যে কোনো দেশের সংবিধানে প্রতিরক্ষা ও যুদ্ধনীতি সংক্রান্ত পৃথক অধ্যায় থাকে। কোর’আনেও অনেক সুরা বা অধ্যায় আছে যেগুলো যুদ্ধ সংক্রান্ত বিধানাবলীসহ অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের সৈন্যদের জন্য ওঁৎ পেতে বসে থাকা অর্থাৎ অ্যামবুশ করা যেকোনো গেরিলা যুদ্ধে করতেই হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন ঘটনা হাজারবার ঘটেছে। বীরশ্রেষ্ঠদের অনেকেই গেরিলা আক্রমণ করতে গিয়েই শহীদ হয়েছেন এবং সর্বোচ্চ খেতাব অর্জন করেছেন। শত্রুসেনাকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করতে হলে তাকে গিরায় গিরায় আঘাত করা একটি সাধারণ কৌশল। এটা নিয়ে অপপ্রচার বা ইসলামকে হেয় করে দেখানোর প্রচেষ্টা অবান্তর। শান্তিরক্ষা বাহিনীর হাতে অস্ত্র থাকে এটা স্বাভাবিক। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশন যুদ্ধ করেই শান্তি প্রতিষ্ঠা করে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা বিভাগ মানেই আন্তর্জাতিক সামরিক বাহিনীর সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর সম্মিলিত শক্তি। ইসলামও এসেছে মানবজীবন থেকে সকল অন্যায় অবিচার দূর করে ন্যায়, নিরাপত্তা, সুবিচার তথা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য। এজন্য স্বভাবতই রসুলাল্লাহ ও তাঁর জাতিকে অন্যায়ের ধারক গোত্র বা রাজশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এই লড়াই তিনি করেছে যখন তিনি ছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের কর্ণধার ও সেনানায়ক।
আজকে যারা জঙ্গিবাদী মতবাদে অনুপ্রাণিত, তারা ছোট ছোট দল গঠন করে বা স্বপ্রনোদিত হয়ে ভিন্নমতের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে কাফের মুরতাদ ফতোয়া দিয়ে চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে হত্যা করে মনে করছেন যে কোর’আনের হুকুম পালন করলাম, তারা নির্বোধের মতো কাজ করছেন। কারণ তারা রসুলাল্লাহর মতো কোনো সার্বভৌম ভূখণ্ডের রাষ্ট্রনায়ক নন, তারা কোনো রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সাধরণ সৈনিকও নন। তারা স্বঘোষিত বিপ্লবী। তারা সন্ত্রাসবাদী। তারা যদি রসুলাল্লাহর সামগ্রিক জীবনীকে অধ্যয়ন করতেন তাহলে দেখতে পেতেন যে ব্যক্তি বা দলগত পর্যায়ে রসুলাল্লাহ কোনো সামরিক কার্যক্রম যেমন শত্রুবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা বা ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করেননি। যারা ব্যক্তি বা দলগত পর্যায়ে সেই চোরাগোপ্তা হামলা করে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছেন তারা রসুলাল্লাহর সুন্নাহ বা নীতিকে বুঝতে পারেন নি বা বুঝেও অস্বীকার করছেন।
অপরদিকে ইসলামবিদ্বেষীরা যে দাবি করছে ইসলাম বিধর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা ও হত্যার নির্দেশ দেয় তারাও সত্যকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। ইসলাম কখনোই সাধারণ অমুসলিম বা বিধর্মীদেরকে হত্যা করার নির্দেশ দেয় না। কোর’আনে বলা হয়েছে যারা কাফের ও মোশরেক তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। তাও সব কাফের ও মোশরেক নয়, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে স্বশস্ত্রভাবে বাধা প্রদান করবে তাদের। অর্থাৎ বেসামরিক লোকদের হত্যা করা যাবে না। প্রত্যেক যুদ্ধের আগে রসুলাল্লাহ এ কথা তাঁর বাহিনীকে স্মরণ করিয়ে দিতেন যেন কেউ বেসামরিক নারী, পুরুষ, বৃদ্ধ ও শিশুদের হত্যা না করে এমন কি ফসল ও গাছপালাও বিনষ্ট না করে। এমন কি তিনি আরব সমাজের রীতি-রেওয়াজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধ করতেন না। আল্লাহ, রসুল ও মো’মেনদের এই কঠোরতা শুধু তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরুদ্ধাচারী। যারা তা নয় তাদেরকে দয়া প্রদর্শন ও তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ নিষেধ করেননি। উপরন্তু অকারণে তাদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। আল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, “দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায়বিচারকারীদেরকে ভালোবাসেন। আল্লাহ কেবল তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেন যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে, তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেছে এবং এ কাজে সাহায্য করেছে। তাদের সাথে যারা বন্ধুত্ব করে তারা তো জালেম” (সুরা মোমতাহেনা ৮-৯)।
রসুলাল্লাহকে তাঁর স্বদেশ থেকে যারা বহিষ্কার করেছিল, তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের সহায় সম্পত্তি দখল করে নিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, তাদের শক্তি-সামর্থ্যকে খর্ব করার জন্য বাণিজ্য বহরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা যে কোনোবিচারেই ন্যায়সঙ্গত। যে কোনো সেনাবাহিনীই সামর্থ্য থাকলে শত্রুর রসদ সরবরাহ বা সাপ্লাই চেইন বন্ধ করে দেয়। এটা একটি সর্বজনবিদিত রণকৌশল। তাই এগুলো নিয়ে যারা অপপ্রচার করে তারা আসলে নিজেদের অজ্ঞতার পরিচয় দেয়।
তাহলে আমরা বুঝলাম যে, কোর’আনের এই যুদ্ধসংক্রান্ত আয়াতগুলো প্রকৃতপক্ষে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভূখণ্ডের রাষ্ট্রনায়ক বা অধিপতির দ্বারা পরিচালিত সেনাবাহিনীর প্রতি দিক-নির্দেশনা। যারা অলিতেগলিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থেকে, মেসে বা মসজিদে মাদ্রাসায় বসে পরিকল্পনা করে এখানে ওখানে বোমাহামলা করেন, চাপাতি মেরে যাকে ইচ্ছা কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করেন তাদের এসব কর্মকাণ্ডের কোনো বৈধতা ইসলাম দেয় না। এসবের সঙ্গে ইসলামের কোনো যোগসূত্র নেই, এসবের জন্য আল্লাহ-রসুল-কোর’আনকে দায়ী করার কোনো সুযোগ নেই।