মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে-
সমস্ত বিশ্বের মানুষের জীবনবিধান হচ্ছে কোর’আন এবং যতদিন এই পৃথিবী ও মানুষ আছে ততদিনের জন্য। এ হচ্ছে মানুষের জন্য চিরস্থায়ী সংবিধান। এই সংবিধানে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং সামগ্রিকভাবে মানবজাতির জন্য জীবনবিধান নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষা, দণ্ডবিধি ইত্যাদি এক কথায় মানুষের যত রকম প্রয়োজন হতে পারে তার মৌলিক নীতি, পথ-নির্দেশ রয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে, এ নীতিমালা সর্বকালের জন্য কি করে হতে পারে? যেখানে মানুষ জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে, তার সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা বদলে যাচ্ছে, বিবর্তন হয়ে চলছে, সেখানে চৌদ্দশ’ বছর আগে দেয়া আইন-কানুন, জীবনব্যবস্থা কি করে বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে? এ প্রশ্ন হয়েছেও। শুধু হয়েছে তাই নয়, এবং তা সম্ভব নয় মনে করে প্রায় সম্পূর্ণ ‘মুসলিম’ জাতি এবং এর ‘মুসলিম’ রাষ্ট্রগুলি কোর’আনের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক আইন-কানুন ও দণ্ডবিধি পরিত্যাগ করে খ্রিষ্টানদের মত শুধু ব্যক্তিগত নির্দেশ, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। এরা যদি সত্যান্বেষী মন নিয়ে কোর’আন পড়তেন তবে দেখতে পেতেন যে, যিনি এই মহা সংবিধান রচনা করেছেন তিনি তাঁর আদেশ-নির্দেশ দেবার সময় সর্বক্ষণ মনে রেখেছেন যে, তাঁর এই আদেশ-নির্দেশ, আইন-কানুন, দণ্ডবিধি মানুষের অস্তিত্বের শেষ পর্যন্ত কার্যকর থাকতে হবে। সুতরাং এতে এমন কোন আইন, আদেশ-নিষেধ থাকতে পারবে না যা স্থান বা কালের কারণে অচল হয়ে যেতে পারে। তাহলে তাকে আবার নতুন প্রেরিত এবং নতুন আইন পাঠাতে হবে। এরা দেখতে পেতেন যে, কোর’আনের সমস্ত আদেশ বুনিয়াদী, ভিত্তিমূলক (Basic Truths) অর্থাৎ যে সব সত্য স্থান, কাল, পাত্রভেদে তফাৎ হয় না, যা সর্বকালে সর্ব অবস্থায় সত্য, প্রযোজ্য। স্রষ্টা বলেছেন, “তোমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমার দেয়া রজ্জুকে (দীন, জীবনবিধান) ধরে রাখ এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না (সুরা আল ইমরান ১০৩)।” অর্থাৎ বলছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাক। ঐক্য বিচ্ছিন্নতার চেয়ে শক্তিশালী। বিচ্ছিন্ন দশজনের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ দশজন অনেক শক্তিশালী এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য একথাও যে আজ থেকে লক্ষ বছর আগেও তা সত্য ছিল এবং আজ থেকে লক্ষ বছর পরেও তা তেমনিই সত্য থাকবে। অর্থাৎ বিচ্ছিন্নতার চেয়ে ঐক্য শক্তিশালী একথা চিরন্তন সত্য, শাশ্বত সত্য, এর কোন পরিবর্তন নেই, হতে পারে না। আগুনে হাত দিলে হাত পুড়বে একথা কি কোনদিন অসত্য ছিল বা ভবিষ্যতে হবে?
কোর’আন শুধু এমনি চিরন্তন সত্যে পূর্ণ। এতে এমন একটি আদেশ-নির্দেশ নেই যা স্থান, কাল, পাত্রভেদে অচল বা অকার্যকর। বিশাল বিশ্বজগৎ যিনি সৃষ্টি করেছেন, যার একটি পরমাণুতেও কোনো খুঁত নেই, মানব জাতির জন্য তাঁর তৈরি সংবিধানের (জীবনবিধান) চেয়ে অন্য কোন সংবিধান নিখুঁত হওয়া কি সম্ভব? মোটেই সম্ভব নয়। আল্লাহর সৃষ্টি কেমন নিখুঁত, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, “তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোনো ত্রæটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোনো খুঁত দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ- তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে (সুরা মুলক ৩-৪)।” আল্লাহর দেওয়া জীবনবিধানও এমনই নিখুঁত।
কোর’আন যেহেতু শুধু বর্তমানের জন্য নয়, মানুষের ভবিষ্যতের জন্যও, সেহেতু তার মধ্যে অবশ্যই অনেক কিছুই থাকবে যা আমরা বর্তমানে বুঝতে পারব না। কথাটার ব্যাখ্যা দরকার। মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান কখনও একস্থানে দাঁড়িয়ে নেই, তা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে ক্রমাগত এগিয়ে চলেছে। যে বই বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব কিছু আবৃত করবে তার মধ্যে এমন সব বিষয় থাকতে বাধ্য যা সময়ের বিশেষ কোন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সবটা বোঝা যাবে না। আজ যদি কেউ বলে যে একটা মাত্র বোমা মেরে পঞ্চাশ লক্ষ লোকের বসতিপূর্ণ একটি শহর পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া যায় তবে কি কেউ প্রতিবাদ করবে? কেউ না, কারণ দু’টি বোমা মেরে হিরোশিমা আর নাগাসাকি শহর দু’টো নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আজ মানুষের হাতে যে পারমাণবিক বোমা আছে তা দিয়ে এই পৃথিবীটাই ধ্বংস করে দেয়া যায় কিন্তু মাত্র একশ’ বছর আগে কেউ একথা বললে বা লিখলে লোকে তাকে পাগল ভাবত। কিংবা ভাবুন- মাত্র দেড়শো বছর আগে কেউ যদি দাবী করত যে সে চাঁদে গিয়েছিল, ঘুরে এসেছে তবে আপনি তার সম্বন্ধে কি ভাবতেন? কিন্তু নীল আর্মস্ট্রং-ই (ঘবরষ অৎসংঃৎড়হম) শুধু নয় আরো বেশ কয়েকজন তা বলেছেন এবং এখনও বলছে আর পৃথিবীর কেউ তাতে আপত্তি করছেন না, তাদের পাগলা-গারদেও পাঠাবার কথা বলছেন না বরং তাদের নানাভাবে সম্মানিত করছেন। কারণ তাদের দাবী সত্য।
এমনিভাবে কোর’আনে অনেক কিছুই আছে যা অবতীর্ণ হবার সময় বোঝা যায় নি কারণ জ্ঞান, বিশেষ করে বিজ্ঞান তখন অতি প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। আজ জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ জাতি আরও সম্মুখে এগিয়েছে এবং নতুন বৈজ্ঞানিক তথ্য আবিষ্কার করে দেখছে যে স্রষ্টা চৌদ্দশ’ বছর আগেই তা কোর’আনে বলে রেখেছেন যেগুলো বর্তমান তথ্য আবিষ্কার হবার আগে বোঝা সম্ভব ছিল না। শুধু একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আল্লাহ বলেছেন, “আমি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণী পানি থেকে সৃষ্টি করেছি (সুরা নূর ৪৫)।” আজ বিজ্ঞান দেখছে যে তার এই বাণী দু’ভাবে সত্য। প্রথমত চিকিৎসা বিজ্ঞান জানতে পেরেছে যে, সমস্ত প্রাণীর দেহের ৭৫ থেকে ৯৬ ভাগই পানি। এমন কি উদ্ভিদ জাতীয় সব কিছুরই প্রধান ভাগ পানি। দ্বিতীয়ত পৃথিবীর প্রথম প্রাণ সৃষ্ট হয় সমুদ্রে, অর্থাৎ পানিতে।
কোর’আনে আগামী সমস্ত সময়ের জন্য মানুষের যা কিছু প্রয়োজন হবে সবই দেয়া আছে। মানুষের জ্ঞান ধীরে ধীরে যতই বাড়তে থাকবে ততই কোর’আনের আয়াতগুলির অর্থ বোঝা যেতে থাকবে। সম্পূর্ণ কোর’আন যে আজ বোঝা যেতে পারে না, কারণ অনাগত ভবিষ্যতের মানুষের জন্য অনেক তথ্য আল্লাহ এর মধ্যে দিয়ে দিয়েছেন। মানুষের জ্ঞান যখন আরও অগ্রসর হবে এবং মানুষ সেগুলি বোঝার উপযুক্ত হবে তখন আল্লাহ মানুষকে সেগুলি বোঝার ক্ষমতা দান করবেন।
তাহলে মানবজাতির সম্মুখে দুইটি মাত্র পথ। একটি হল, স্রষ্টার দেওয়া নিখুঁত ত্রুটিহীন সংবিধান (জীবনবিধান)। দ্বিতীয় পথটি হল, স্রষ্টার দেওয়া জীবনবিধান প্রত্যাখ্যান করলে মানবজাতিকে অবশ্যই নিজেদের জীবনবিধান নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হবে। কারণ সামাজিক জীব মানুষের জীবনবিধান ছাড়া চলা অসম্ভব। দুইটির মধ্যে কোন্টি গ্রহণ ও মানবজীবনে কার্যকরী করলে কাম্য, ইপ্সিত ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা, সুখ ও শান্তি পাওয়া যাবে? এই বিরাট প্রশ্নের জবাব স্রষ্টা স্বয়ং আমাদের দিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলছেন, “যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি কি জানেন না? তিনি সু²তম বিষয়ও জানেন (সুরা মুলক ১৪)।” এই কথার কোনো জবাব আছে কি? তদুপরি আল্লাহ বলেছেন, “আমি তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দিয়েছি (বনী ইসরাঈল ৮৫)।” ক্ষুদ্র জ্ঞানের অধিকারী মানুষের পক্ষে কি অসীম জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহর মত নিখুঁত কোন কাজ করা সম্ভব? শেষ নবী মোহাম্মদের (দ.) মাধ্যমে যে শেষ জীবন বিধান স্রষ্টা প্রেরণ করেছিলেন তা মানবজাতির একাংশ গ্রহণ ও সমষ্টিগত জীবনে কার্যকরী করার ফলে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি অংশ অর্থাৎ নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে কী ফল হয়েছিল তা ইতিহাস। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পূর্ণ নিরাপত্তা যাকে বলে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মানুষ রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধনসম্পদ হারিয়ে গেলেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানী প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসত না। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াত। এটি ইতিহাস। অন্যদিকে মানব রচিত কোন সংবিধান বা জীবনবিধান এর একটি ভগ্নাংশও মানবজাতিকে উপহার দিতে পারে নাই। মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন রকম জীবনবিধান একটা একটা করে প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে। এর প্রত্যেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন অধিকাংশ সমাজে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। এরও ফল আমরা দেখছি। সমস্ত পৃথিবী আজ গত এক বা দুই শতাব্দী আগের চেয়ে অনেক বেশী অন্যায় এবং অবিচারে পূর্ণ। গরীব ও ধনীর ব্যবধান অনেক বেশী প্রকট। মানুষে মানুষে সংঘর্ষ ও রক্তপাত বহুগুণে বেশী। গত এক শতাব্দীতেই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে কোটি কোটি লোক হতাহত হয়েছে। এই নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের একটি দিনও যায় নাই যেদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ, রক্তপাত চলে নাই।
মানব জাতির এই অবস্থায় সবগুলি জীবনবিধান ব্যর্থ হওয়ার পর স্রষ্টার দেওয়া জীবন বিধান মেনে নেওয়া ছাড়া শান্তি ও নিরাপত্তার আর কোনো পথ নেই। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায় স্রষ্টার প্রেরিত মানবজাতির জন্য একমাত্র নিখুঁত, নির্ভুল ও চিরস্থায়ী সংবিধান হচ্ছে কোর’আন- যে সংবিধান আমাদের বর্তমান, ভবিষ্যতে সকল সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। (সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)