রিয়াদুল হাসান: রমজান মাস এলেই আমাদের দেশে তারাবির নামাজ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিতর্ক আমরা দেখতে পাই। বিশেষ করে তারাবির নামাজ কয় রাকাত হবে, ২০ রাকাত না ৮ রাকাত এ নিয়ে রীতিমত ঝগড়া, বাহাস চলতে থাকে। ২০ রাকাত তারাবি পড়া হলে সেখানে সাধারণত কোর’আন খতম করা হয়। আলেম সাহেবরা যুক্তি দিয়ে থাকেন যে কোর’আনের তেলাওয়াত শুনলে এমনিতেই বহু নেকি, আর রমজান মাসে তো সেই নেকি বহুগুণ বেড়ে যায়। যদিও একটা বর্ণও না বুঝে তেলাওয়াত শোনার মধ্যে কী উপকার নিহিত সে প্রশ্নও অনেকে তুলে থাকেন।
ধর্মচর্চার কিছু উপলক্ষ থাকে। এই উপলক্ষগুলোকে কেন্দ্র করে ধর্মব্যবসার বাজারও বেশ রমরমা হয়ে ওঠে। রমজান মাসটা তেমনই একটি সময়। এই মৌসুমে সম্মানিত হাফেজে কোর’আনদের ব্যস্ততা বৃদ্ধি পায়। আমাদের সমাজে একটি নিয়ম দাঁড়িয়ে গেছে যে কোর’আনে হাফেজগণ কোর’আন পাঠ করেই জীবিকা নির্বাহ করবেন। হেফজখানায় ভর্তির ক্ষণেই এই পরিকল্পনা নিয়েই মানুষ ভর্তি হয় বা তার বাবা-মায়েরা ভর্তি করেন। তারা হাফেজে কোর’আনদের ফজিলত শুনে এই পথে অগ্রসর হন, বংশে একজন হাফেজ থাকলে আখেরাতে নাজাতের জন্য শাফায়াত করবে। আমরা যতটুকু জানি রসুলাল্লাহর যে আসহাবগণ ইয়ামামার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন তারা কিন্তু কোর’আনকে জীবিকার মাধ্যমে পরিণত করার নিয়তে কোর’আন শিক্ষা করেন নি। তারা কোর’আন সংরক্ষণের জন্য হেফজ করেছেন এবং কোর’আন প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছেন। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও ছাপাখানার যুগে কোর’আন সংরক্ষণের নিমিত্তে আর কোর’আন মুখস্থ করার খুব একটা দরকার হয় না, তবু সওয়াবের আশায় এই চর্চাটি আমাদের সমাজে আজও ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে।
হাফেজে কোর’আনদের প্রতি যথাযোগ্য সম্মান রেখেই বলছি, আপনারা কি নিশ্চিত যে কোর’আন খতম দিয়ে অর্থ রোজগার করা বৈধ বা হালাল? যেহতু জীবিকা বৈধ না হলে এবাদত কবুল হয় না, তাই এ বিষয়টি আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন আছে।
প্রথম কথা হচ্ছে আল্লাহর রসুল কখনও খতম তারাবি করেন নি, এটার নামও কোনোদিন শোনেন নি, হাদিসগ্রন্থে তারাবি শব্দটিই নেই এটা আলেমগণই বলে থাকেন। তথাপি একে অনেক উত্তম আমল হিসাবে, বলা চলে সওমের অংশ হিসাবে পালন করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। এর পেছনে কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ নেই তো? এ প্রশ্নগুলো সকলের বিবেচনার জন্য করা, এর সমাধান করার জন্য আপনার বিবেকই যথেষ্ট হবে। এখন আমরা দেখব কোর’আন ও তারাবির বিনিময়গ্রহণ সম্পর্কে কোর’আন, হাদিস ও ফতোয়ার গ্রন্থগুলোতে কী পাওয়া যায়।
বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে মহান আল্লাহর সিদ্ধান্ত
শুরুতেই পবিত্র কোর’আনের একটি আয়াত। আল্লাহ বলেন, যারা আল্লাহর অবতীর্ণ কেতাবকে গোপন করে এবং এর বিনিময়ে পার্থিব তুচ্ছমূল্য গ্রহণ করে তারা তাদের উদরে আগুন ছাড়া কিছুই পুরে না। হাশরের দিন আল্লাহ তাদেরকে পবিত্র করবেন না, তাদের সঙ্গে কথাও বলবেন না। এরাই হচ্ছে সেই সমস্ত মানুষ যারা সঠিক পথের পরিবর্তে ভ্রান্ত পথ এবং ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তি ক্রয় করেছে। আগুন সহ্য করতে তারা কতই না ধৈর্যশীল (সুরা বাকারা ১৭৪)।
অত্যন্ত সরল কথা, আল্লাহর আয়াতের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ মানে আগুন ভক্ষণ। হাজার রকম তাফসির বের করে এই আয়াতের অর্থকে পরিবর্তন করে নিলেও সঠিক পথের পরিবর্তে গোমরাহি আর ক্ষমার পরিবর্তে শাস্তিই জুটবে। এ বিষয়ে আল্লাহ আরো বলেন, “তোমরা আমার আয়াতসমূহ সামান্যমূল্যে বিক্রি করো না এবং কেবল আমাকেই ভয় কর। আর তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-বুঝে সত্যকে গোপন করো না (সুরা বাকারা ৪১-৪২)। পবিত্র কোর’আনে ইসলামের যে কোনো কাজের বিনিময়ে অর্থগ্রহণ করাকে হারাম করা হয়েছে। যারা বিনিময় গ্রহণ করে তাদের পেছনে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ বলছেন- অনুসরণ করো তাদের, যারা বিনিময় নেয় না এবং হেদায়াহপ্রাপ্ত (সুরা আল ইয়াসীন- ২১)।
বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে রসুলাল্লাহর (সা.) সিদ্ধান্ত
এবার রসুলাল্লাহর হাদিস। বিশিষ্ট সাহাবি আবদুর রহমান ইবনে শিবল রা. বলেন, আমি রসুলাল্লাহকে বলতে শুনেছি যে, তোমরা কোর’আন পড় তবে তাতে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার প্রতি বিরূপ হয়ো না। কোর’আনের বিনিময় ভক্ষণ করো না এবং এর দ্বারা স¤পদ কামনা করো না।’ -মুসনাদে আহমদ ৩/৪২৮; মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা ৫/২৪০; কিতাবুত তারাবীহ।
জীবনের প্রতিটি বিষয়ের মত কোর’আন পড়ার মধ্যেও রসুলাল্লাহ পরিমিতিবোধ বজায় রাখতে বলেছেন। কারণ দীর্ঘ সময় কোর’আন পাঠ করলে পাঠকারী ও শ্রোতা উভয়ের মধ্যেই বিরক্তিভাব বা ক্লান্তি বা অমনোযোগ চলে আসতে পারে। এজন্য তিনি এই বাড়াবাড়িটা করতে নিষেধ করেছেন। পাশাপাশি কোর’আন পাঠের বিনিময় ভক্ষণ করতে, এমনকি মনে মনে সম্পদ কামনা করতেও নিষেধ করেছেন।
অর্থের বিনিময়ে কোর’আন খতমের যে ধারা আমাদের সমাজে চালু হয়েছে সে বিষয়ে রসুলাল্লাহর একটি ভবিষ্যদ্বণী রয়েছে। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, একদিন আমরা একদল লোক এক স্থানে সমবেত ছিলাম। আমাদের মধ্যে আরব, অনারব, কৃষ্ণাঙ্গ ও শেতাঙ্গ সকল শ্রেণির লোকই ছিল। এ অবস্থায় নবী করিম (সা.) আমাদের মধ্যে আগমন করে বললেন, “তোমরা সৌভাগ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত রয়েছি। তোমরা আল্লাহর কেতাব তেলাওয়াত করে থাক। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল বর্তমান রয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে মানুষের নিকট এইরূপ এক যুগ আসবে যখন তীরের ফলক বা দ- যেরূপ সরল ও সোজা করা হয়, লোকেরা কোর’আন তেলাওয়াতকে ঠিক সেইরূপ সরল ও সোজা করবে। তারা দ্রুত তেলাওয়াত করে নিজেদের পারিশ্রমিক আদায় করবে এবং এর জন্য তাদের বিলম্ব সহ্য হবে না (মুসনাদে আহমদ, তাফসির ইবনে কাসীর)।
বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে আসহাবে রসুলগণ ও তাবেয়ীনদের সিদ্ধান্ত
রসুলাল্লাহর সাহাবিরা তাই কখনওই কোর’আন পাঠ বা শিক্ষাদানের বিনিময় গ্রহণ করতেন না, একে আগুনের মত ভয় করতেন। তারা সবসময় আশঙ্কায় থাকতেন যে কোনোভাবে ইসলামের কাজের বিনিময়ে সম্পদ গ্রহণ করে ফেলেন কিনা। কারণ তারা ইসলামের যাবতীয় কাজ করতেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। পার্থিব জীবনযাপনের চাহিদা মেটাতে তারা হালাল পথে পরিশ্রম করে রোজগার করতেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আবদল্লাহ ইবনে মা’কাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি এক রমজানে লোকদের নিয়ে তারাবি পড়ালেন। এরপর ঈদের দিন উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ তাঁর কাছে এক জোড়া কাপড় এবং ৫০০ দিরহাম পাঠালেন। তখন তিনি কাপড় জোড়া এবং দিরহামগুলো এই বলে ফেরত দিলেন, আমরা কোর’আনের বিনিময় গ্রহণ করি না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৫/২৩৭, হাদিস : ৭৮২১)
তাবেয়ী যাযান (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি কোর’আন পড়ে মানুষ থেকে এর বিনিময় গ্রহণ করে, সে যখন হাশরের মাঠে উঠবে তখন তার চেহারায় কোনো গোশত থাকবে না, শুধু হাড্ডি থাকবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৭৮২৪)
বিনিময় গ্রহণ সম্পর্কে ফকীহ ও ইমামদের সিদ্ধান্ত
এবার দেখা যাক ইসলামের বিশেষজ্ঞ ও ইমামগণ এই ব্যাপারে কী ফায়সালা দিয়েছেন। আলেম-ওলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, খতমে তারাবির বিনিময় দেওয়া-নেওয়া উভয়ই নাজায়েজ ও হারাম। হাদিয়া হিসেবে দিলেও জায়েজ হবে না। হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বলেন, বিনিময় লেনদেন হয় এমন খতম তারাবি শরিয়তপরিপন্থী। এরূপ খতমের দ্বারা সাওয়াবের অংশীদার হওয়া যাবে না বরং গোনাহের কারণ হবে (এমদাদুল ফতোয়া ১/৪৮)।
দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠানটি উপমহাদেশে কোর’আন হেফজ করার ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা পালন করছে। তাদের ফতোয়ার একটি গ্রহণযোগ্যতা আলেম সমাজে রয়েছে। এই দারুল উলুম কর্তৃক প্রদত্ত ফতোয়াতেও আমরা দেখি খতম তারাবির বিনিময়ে অর্থ গ্রহণ না-জায়েজ। হজরত মুফতি আজিজুর রহমান (রহ.) বলেন, বিনিময় গ্রহণ করে কোর’আন শরিফ তেলাওয়াত করা জায়েজ নেই। যাদের নিয়তে দেওয়া-নেওয়া আছে, তাও বিনিময়ের হুকুমে হবে। এমতাবস্থায় শুধু তারাবি আদায় করাই ভালো। বিনিময়ের কোরআন তেলাওয়াত না শোনা উত্তম। কিয়ামুল লাইলের সাওয়াব শুধু তারাবি পড়লেই অর্জন হয়ে যাবে। (ফতোওয়া দারুল উলুম ৪/২৪৬)
দেওবন্দি আন্দোলনের অন্যতম কা-ারি হজরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী (র.) স্বয়ং বলেছেন, তারাবিতে যে পবিত্র কোর’আন পড়ে এবং যে শোনে তাদের মধ্যে অর্থের বিনিময় হারাম। (ফতোয়ায়ে রশীদিয়া- ৩৯২) আমাদের দেশের অধিকাংশ কোর’আনে হাফেজগণই এই দারুল উলুম দেওবন্দের ভাবধারায় পরিচালিত কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। তারা এই ফতোয়াগুলোর কতটুকু মূল্যায়ন করছেন?
আহলে হাদীস মতাদর্শের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব মাওলানা আব্দুল্লাহ অমৃতসরী লিখেছেন, বিনিময়ের মাধ্যমে তারাবিতে পবিত্র কোর’আন তিলাওয়াত করা বা বিনিময় নির্ধারণ করা সম্পূর্ণ হারাম। বরং এরূপ লোকের পেছনে তারাবিও হয় না (ফতোয়ায়ে আহলে হাদিস ২/৩০২)।
দারুল ইফতাহ ও দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া রয়েছে – যে হাফেজ সাহেব টাকার লোভে কোর’আন মজিদ শোনান তা শোনার চেয়ে যে সুরা তারাবি আদায় করে তার মুক্তাদি হওয়া ভাল। যদি পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোর’আন শোনানো হয় তাহলে ইমামের সওয়াব হবে না, মুক্তাদিরও সওয়াব হবে না।
বিনিময় দিয়ে কোর’আন খতম শুনে তারাবি আদায় না করার চেয়ে সুরা তারাবি আদায় করাকেই অনেক আলেম আমলের দিক থেকে উত্তম বলে ঘোষণা করেছেন। শায়েখ মুফতি মুহাম্মদ শফি (রহ.) বলেছেন, “ছোট ছোট সুরা দিয়ে তারাবি পড়ে নিন। বিনিময় দিয়ে কোর’আন শুনবেন না। কারণ কোর’আন শোনানোর মাধ্যমে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ নেই (জাওয়াহেরুল ফিকহ ১/৩৮২)।
বিনিময় নিয়ে তারাবি নামাজে ইমামতকারী ইমামের ব্যাপারে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী (র.) বলেন, আমি বিনিময় নিয়ে নামাজ পড়ানোকে মাকরূহ মনে করি এবং আমার ভয় হয়, ওই সব লোকের নামাজ আবার পড়তে হবে কি না, যারা এমন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করেন। এরপর তিনি বলেন, আমার মত হলো, বিনিময় গ্রহণ করা যাবে না (ফতোয়ায়ে নজিরিয়া ১/৬৪২)।
এই নিবন্ধে আমরা নিজেদের কোনো মতামত প্রদান করি নি, কেবল কোর’আন, হাদীস ও প্রসিদ্ধ আলেমদের ফতোয়ার গ্রন্থ থেকে কিছু দলিল তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এ সমস্ত দলিল ও যুক্তিপ্রমাণের আলোকে যেন মুসলিম উম্মাহ সঠিকভাবে চিন্তা করার পথ খুঁজে পায় সেটাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। একটি ভুল দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বলে সেটাকে অনন্তকাল চালিয়ে যেতে হবে এমন ধারণা থেকে আমাদের সবার বেরিয়ে আসা উচিত। ধর্মব্যবসা ধর্মের ধ্বংস ডেকে আনে, এই সরল কথাটি সকলেই জানেন ও বোঝেন। এখন প্রয়োজন ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান। তাহলেই আমরা আবার আমাদের হারানো গৌরবের দিন ফিরে পেতে পারি।