শাকিলা আলম:
বিদায় হজ্বের দিন আল্লাহর রসুল বলেছিলেন, “আজ যারা এই সমাবেশে উপস্থিত নেই তাদের কাছে যারা উপস্থিত রয়েছ তারা আমার এই কথাগুলো পৌঁছে দেবে।” সত্য প্রচারের এই যে দায়বদ্ধতা ও বাধ্যবাধকতা উম্মাহর উপর তাদের নেতা, আল্লাহর শেষ রসুল কর্তৃক অর্পিত হলো সেই দায়িত্ব কি উম্মাহ টাকার বিনিময়ে পালন করবে? এই সত্যের শিক্ষা প্রদানের সাথে কি অর্থের বা স্বার্থের কোনো সংযোগ থাকতে পারে? আল্লাহর রসুল যা কিছু করেছেন তা কি তিনি অর্থের বিনিময়ে করেছেন? নাউজুবিল্লাহ। তিনি নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহর নির্দেশে অতিবাহিত করেছেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ তাঁকে এর বিনিময়ে কোনো আজরিন, র্খাজান, মা’লান অর্থাৎ মজুরি, সম্পদ, বিনিময় (payment, wealth, reward) গ্রহণ না করার জন্য অন্তত ছয়টি আয়াতে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,
এবং তুমি তাদের নিকট কোনো মজুরি দাবি করো না। এই বাণী তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ মাত্র (সুরা ইউসুফ ১০৪)।
বল! আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো পারিশ্রমিক চাই না। এবং যারা মিথ্যা দাবি করে আমি তাদের দলভুক্ত নই (সুরা সা’দ ৮৬)।
…বল! আমি এর (দীনের) বিনিময়ে তোমাদের কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসা ও আত্মীয়তাজনিত সৌহার্দ্যপূর্ণ ব্যবহার ব্যতীত অন্য কোনো মজুরি চাই না (সুরা শুরা ২৩)।
(হে মোহাম্মদ!) তুমি কি তাদের নিকট কোনো মজুরি চাও? তোমার প্রতিপালকের প্রতিদানই তো শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই শ্রেষ্ঠ রেযেকদাতা (সুরা মো’মেনুন ৭২)।
তবে কি তুমি তাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাচ্ছো যা ওরা একটি দুর্বহ বোঝা মনে করে? (সুরা তুর ৪০)
তাঁদেরকেই (নবীদেরকেই) আল্লাহ সৎপথে পরিচালিত করেছেন। সুতরাং তুমি তাদের পথ অনুসরণ কর; বল! এর জন্য আমি তোমাদের কাছে কোনো মজুরি চাই না (সুরা আনআম ৯০)।
শেষোক্ত আয়াতটিতে আল্লাহ পূর্বের সমস্ত নবী-রসুলদের কথা উল্লেখ করে তাঁর শেষ রসুলকে (সা.) নির্দেশ দিচ্ছেন পূর্বসূরীদের পথ অনুসরণ করতে। সেই পথটি কী? সেটা হচ্ছে বিনা মজুরিতে আল্লাহর দীনকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। সমসাময়িক বিকৃত ধর্মের ধারক বাহকদের ধর্মব্যবসার বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থান নেওয়ার দরুন আল্লাহর নবী-রসুলগণ ধর্মব্যবসায়ী আলেম পুরোহিত গোষ্ঠীর দ্বারা প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। নবী-রসুলরা তাদের এই ধর্মব্যবসাকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন, যার ফলে তারা রুজি রোজগার বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি সম্মান ও কর্তৃত্ব খোয়ানোর আশঙ্কায় নবী-রসুলদের বিরুদ্ধে জনগণ ও শাসক শ্রেণিকে খেপিয়ে তুলেছেন। নবী-রসুলগণ সকলেই তাদের জাতির উদ্দেশ্যে একটি সাধারণ ঘোষণা দিয়েছেন যে, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, আমার বিনিময় রয়েছে আল্লাহর কাছে। এটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তিনি যা তাদের সামনে উপস্থাপন করছেন তা নির্ভেজাল সত্য, হক্, এতে মিথ্যার কোনো মিশ্রণ নেই। কারণ প্রতিটি মিথ্যাই হয় উদ্দেশ্য-প্রণোদিত, তাতে মানুষের কোনো না কোনো পার্থিবস্বার্থ জড়িত থাকে। নবী-রসুলগণ যে কোনো পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছেন না সেটা সুস্পষ্ট করার জন্যই এ কথাটি বলতেন। বিনিময় গ্রহণ না করা তাঁদের সত্যতার, হাকিকতের বড় একটি নির্দেশক।
এ বিষয়ে নবী-রসুলদের (আ.) বেশ কয়েকজনের ঘোষণা আল্লাহ দৃষ্টান্তস্বরূপ পবিত্র কোর’আনেও সন্নিবদ্ধ করেছেন। যেমন:
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার স¤প্রদায়! এর পরিবর্তে আমি তোমাদের নিকট ধন সম্পদ চাই না। আমার পারিশ্রমিক আল্লাহর নিকট (সুরা হুদ-২৯)।
হুদ (আ.) এর ঘোষণা: হে আমার স¤প্রদায়! আমি এর পরিবর্তে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাই না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা কি তবুও বুদ্ধি (আক্ল) খাটাবে না? (সুরা হুদ-৫১)।
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের কাছে কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার পারিশ্রমিক তো কেবল বিশ্বজাহানের প্রতিপালকের কাছে রয়েছে (সুরা শু’আরা ১০৯)।
সালেহ (আ.) এর ঘোষণা: আমি তোমাদের নিকট এর জন্য কোনো পারিশ্রমিক চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা ১৪৫)।
লুত (আ.) এর ঘোষণা: এর জন্য আমি কোনো মজুরি চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৬৪)।
নূহ (আ.) এর ঘোষণা: যদি তোমরা আমার কথা না শোনো তাহলে জেনে রাখ, আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই নি। আমার প্রতিদান কেবল আল্লাহর নিকট এবং আমাকে মুসলিম (সত্যের প্রতি সমর্পিত) হওয়ার জন্য আদেশ করা হয়েছে (সুরা ইউনুস ৭২)।
হুদ (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর বিনিময়ে তোমাদের নিকট কোনো মজুরি চাচ্ছি না। আমার পারিশ্রমিক তাঁরই নিকট যিনি এই বিশ্বজাহানের স্রষ্টা (সুরা শু’আরা ১২৭)।
শোয়েব (আ.) এর ঘোষণা: আমি এর জন্য তোমাদের নিকট কোনো মূল্য চাই না। আমার মজুরি জগতসমূহের প্রতিপালকের নিকট রয়েছে (সুরা শু’আরা-১৮০)।
পাঠকবর্গকে অনুরোধ করব এই আয়াতগুলোর পূর্বাপর আয়াতগুলোও পবিত্র কোর’আন থেকে পড়ে নিতে, তাহলে দীনের এই চিরন্তন নীতি সম্পর্কে আল্লাহর যে নীতি তা আপনাদের কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা দেবে। নবী-রসুলগণ আজীবন সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করে গেছেন। তাদের বক্তব্যের সারকথা হচ্ছে এমন, “তোমরা একমাত্র আল্লাহকে মান্য করো। আমার কথা শোনো। আমি তোমাদের জাগতিক ও পারলৌকিক শান্তির ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি। আমি তোমাদেরকে অশান্তি থেকে, জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্ত করতে চাই। তোমরা ভাবছ আমার স্বার্থ কী? না, আমার এই চাওয়ার পেছনে কোনো স্বার্থ নেই। আমাকে কোনো টাকা পয়সা তোমাদের দিতে হবে না। আমার এই কাজের বিনিময় আল্লাহর কাছ থেকে পাব।”
ধর্মের কোনো কাজ করে নবী ও রসুলরা যেমন পারিশ্রমিক গ্রহণ করতেন না, তেমনি তাঁদের উম্মাহর জন্যও পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ নয়। তথাপি নবীদের বিদায়ের পরে জাতির মধ্যে অবধারিতভাবে জন্ম নিয়েছে দীনের পদ্ধতি, ধারক-বাহক, আলেম, পুরোহিত, যাজক নামধারী একটি অকর্মণ্য, কর্মবিমুখ, পরনির্ভরশীল শ্রেণি। বিভিন্ন অঞ্চলে ভাষাভেদে তাদের বিভিন্ন উপাধি বা বিশেষণ ধরে ডাকা হয়ে থাকে। যাহোক, তারা নিজেদেরকে নবী-রসুলদের প্রতিনিধি, ওয়ারিশ বা স্থলাভিষিক্ত (ওরাসাতুল আম্বিয়া, Inheritors of the Prophets) বলে দাবি করতে থাকেন এবং জাতিও তাদের এই দাবি মেনে নেয়। কিন্তু এই তারা যে আম্বিয়ায়ে কেরামের, নবী-রসুলদের ওয়ারিশ বলে নিজেদের দাবি করে তাদেরই রেখে যাওয়া বিনিময় গ্রহণ না করে নিঃস্বার্থ ধর্মপ্রচার, প্রসার, ধর্মীয় কার্যাদি পরিচালনার নীতি নিজেদের বেলায় বহাল রাখলেন না। সেটাকে উল্টে দিয়ে নিজেরা ধর্মের লেবাস ধারণ করে স্বার্থহাসিলে তথা ধর্মব্যবসায় মত্ত হয়ে গেলেন যা আল্লাহ হারাম করেছেন।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
ফেসবুক: shakila.alam2930
ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]