আরশাদ মাহমুদ:
একদিন শেষ রসুল মোহাম্মদ (স.) কা’বা শরীফের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। তখন সময়টা ছিল এমন যখন তিনি ও তাঁর সাহাবীগণের (রা.) ওপর প্রচণ্ড বাধা এবং অবর্ণনীয় নির্যাতন নিপীড়ন চলছিল। হঠাৎ একজন সাহাবা বললেন, হে আল্লাহর রসুল! এই অত্যাচার নিপীড়ন আর সহ্য হচ্ছে না। আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন আমাদের বিরোধীরা সব যেন ধ্বংস হয়ে যায়। কথাটাকে আল্লাহর রসুল কতখানি গুরুত্ব দিলেন তা বোঝা যায় এই থেকে যে, তিনি হেলান ছেড়ে সোজা হয়ে বসলেন এবং ঐ সাহাবাকে বললেন, তুমি কী বললে? সাহাবা তার কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। শুনে আল্লাহর রসুল তাকে বললেন, ‘শোন, শীঘ্রই সময় আসছে যখন কোন যুবতী মেয়ে গায়ে গহনা পরে একা সা’না থেকে হাদরামাউদ যাবে। তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য জন্তু ছাড়া আর কোনো ভয় থাকবে না।’ [খাব্বাব (রা.) থেকে বোখারী ও মেশকাত]।
পাঠক, সাহাবার ধ্বংস কামনার জবাবে আল্লাহর রসুল নির্দিষ্টভাবে ইঙ্গিত করলেন কোন বিষয়ে তা খেয়াল করুন। এ থেকে আমরা ইসলামের ও আল্লাহর রসুলের ইতিহাস সৃষ্টিকারী সংগ্রামী জীবনের অন্যতম উদ্দেশ্যটি বুঝতে পারি, তা হচ্ছে- সমাজ থেকে যাবতীয় ভয় ভীতি, আতঙ্ক দূর করে মানবজীবনে নিশ্চিত নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা। চিন্তা করে দেখুন, একটি সমাজের নিরাপত্তা কোন্ পর্যায়ে গেলে অনুরূপ অবস্থায় একটি স্ত্রীলোকের মনে আল্লাহ এবং বন্য পশু ছাড়া আর কোনো ভয়ই থাকে না। ইতিহাস সাক্ষী, রসুলের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা হয়নি। বাস্তবেই তেমন একটি শান্তিময়, নিরাপদ সমাজ ও নিশ্চিত জীবন উপহার দিয়েছিলেন তারা। এই ছিল আল্লাহ-রসুলের প্রকৃত ইসলাম।
আখেরি নবী এমন একটা সময় পৃথিবীতে এসেছিলেন যখন মানুষ অন্যায় অবিচার, হানাহানি, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদিতে পরিপূর্ণভাবে নিমজ্জিত ছিল। সেই ক্ষণে আখেরি নবী মোহাম্মদ (সা.) এসে মানুষকে স্রেফ একটা কথায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান করলেন যে তোমরা বল- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানবো না। এতেই তোমাদের মুক্তি, এতেই জান্নাত। প্রথম প্রথম তিনি প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হলেন, তবুও তিনি এই তওহীদের আহ্বান সকল গোত্রের কাছে পৌঁছাতে লাগলেন। অবশেষে একটি জনগোষ্ঠী এ কথার উপর ঐক্যবদ্ধ হলো যে তারা আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানবে না এবং রসুলাল্লাহকে তাদের নেতা হিসাবে মান্য করবে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাদের জীবনের নানাবিধ সমস্যা ও জটিলতাগুলোর ফায়সালা দেওয়ার ভার তাঁর উপরই বর্তালো। আর আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে রসুলাল্লাহকে অবগত করতে লাগলেন তার সমাধান। আল্লাহ পর্যায়ক্রমে মুসলিম জাতিকে তাদের ব্যক্তিগত থেকে রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাদি যথা বিয়ে, তালাক, বিচার, দণ্ড, য্দ্ধু, সন্ধি, চুক্তি, ব্যবসা, বাণিজ্য সব বিষয়ে এবং সেই জাতির শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা বা আমলের হুকুম নাজিল করলেন। এভাবে ২৩ বছর ধরে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ একটা জাতির প্রতি প্রয়োজন সাপেক্ষে একে একে যে আদেশ, নিষেধ, উপদেশ, ভর্ৎসনা ইত্যাদি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে সেগুলোর সংকলিত রূপই হচ্ছে পবিত্র কোরআন। আর আল্লাহর কোন হুকুম কীভাবে পালিত হবে, কার বেলায় কতটুকু প্রযোজ্য হবে, কোন সাহাবী কি কথা বলেছেন, রাসুল কি কথা বলেছেন, আবেগ-অনুভূতি ইত্যাদির যে চর্চা রসুল ও তাঁর জাতি করেছেন সেগুলোই পরবর্তীতে হাদীস হিসাবে সংকলিত হয়েছে। যাহোক, আল্লাহর হুকুমের ভিত্তিতে যাবতীয় ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হবার ফল এই হলো যে, নিরাপত্তা, আত্মিক পরিশুদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেল তৎকালীন মুসলিম জাতিটি। নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সেটি এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে, মানুষ রাতে ঘুমানোর সময় ঘরের দরজা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করত না, রাস্তায় ধনসম্পদ ফেলে রাখলেও তা পরে যেয়ে যথাস্থানে পাওয়া যেত, চুরি, ডাকাতি, হত্যা, রাহাজানি প্রায় নির্মূল হয়ে গিয়েছিল, আদালতে মাসের পর মাস কোনো অপরাধ সংক্রান্ত মামলা আসত না। কেউ অপরাধ করে ফেললেও নিজেই নিজের বিচার দাবি করত। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ এমন স্বচ্ছল হয়েছিল যে, তারা যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মত লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াত।
কিছুদিন পূর্বেও যারা বংশ পরম্পরায় বিবাদে লিপ্ত থাকত, আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সেই বর্বর আরব জাতিকে ইসলাম ঐক্যবদ্ধ করে দিল, শত্রুকে ভাই বানিয়ে দিল, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষদেরকে মানবতার কল্যাণে জীবনÑসম্পদ উৎসর্গকৃত সংগ্রামী বানিয়ে দিল। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যারা ছিল সবচাইতে পশ্চাদপদ, সেই জাতিটিই ইসলামের পরশপাথরে এতখানি পরিবর্তিত হয়ে গেল যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে শিক্ষকের আসন লাভ করল। সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অভিনব অগ্রগতি সাধন করে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেই জাতিটি পৃথিবীর ইতিহাসের অবিস্মরণীয় এক রেনেসাঁর জন্ম দিল। ইসলামের সেই রেনেসাঁই পরবর্তীতে স্পেন ও ফ্রান্স হয়ে ইউরোপীয় রেনেসাঁর উপাদান যুগিয়েছিল এ কথা পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরাই স্বীকার করছেন এখন।
আজ আমাদের দুর্ভাগ্য যে, গত ১৩০০ বছরে ইসলাম বিকৃত হতে হতে বর্তমানে আল্লাহ-রসুলের সেই প্রকৃত ইসলাম কোথাও নেই বললেই চলে। তাই যে জাতিটি মাত্র ৬০/৭০ বছরের মধ্যে পৃথিবীর শিক্ষকের জাতিতে পরিণত হয়েছিল সেই জাতি আজ পৃথিবীর অন্যান্য জাতিগুলোর গোলামী ও লাঞ্ছনায় ডুবে আছে। আল্লাহ আমাদেরকে কালের পরিক্রমায় বিলিন হয়ে যাওয়া সেই প্রকৃত ইসলাম উপলব্ধি করার তওফিক দান করুন।
[লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, যোগাযোগ: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১]