হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
পৃথিবীতে যে কয়টি দেশ বর্তমানে কর্তৃত্ব করছে, আধিপত্য বিস্তার করেছে, তাদের এই কর্তৃত্বের পেছনে মূল শক্তি কী?
- সামরিক শক্তি (Military Might)
- অর্থনৈতিক শক্তি (Financial Might)
- প্রযুক্তিগত উন্নতি (Technological Development)
- শিক্ষিত জনগোষ্ঠী (Educated People)
প্রশ্ন হচ্ছে, এই শক্তিগুলো তাদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হলো কী করে? এর উত্তর হচ্ছে, তারা যে কোনো ভাবেই হোক একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যের পানে তাদের জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। কর্তৃত্ব ও আধিপত্য দুই ধরনের হতে পারে কীভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের পরাশক্তি হতে পারে? ন্যায়, সুবিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষে অথবা সাম্রাজ্যবিস্তার করে জুলুম, শোষণ করার লক্ষ্যে। এক প্রকার কর্তৃত্বের ফলে মানুষ শান্তি-সুখে বসবাস করে, আরেক প্রকার কর্তৃত্বের ফলে মানুষ অশান্তির দাবানলে জ্বলতে থাকে।
আজকে পৃথিবীতে যে পরাশক্তিগুলো আধিপত্য বিস্তার করে আছে তাদের এই আধিপত্য-কর্তৃত্ব হলো দ্বিতীয় প্রকারের। প্রকৃতপক্ষে মানুষ আজ তাদের অধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি চায়। তারা তীর্থের কাকের ন্যায় প্রতীক্ষা করে আছে এমন একটি সভ্যতার উত্থানের জন্য যে সভ্যতা তাদেরকে যাবতীয় শোষণ, অবিচার থেকে মুক্তি দেবে, সবার কথা বলার অধিকার থাকবে, ঘরে বাইরে সমান নিরাপত্তা থাকবে, পরিবেশ প্রকৃতি হবে সুনির্মল।
প্রশ্ন করতে পারেন বর্তমানের এ সকল দানবীয় পরাশক্তির যুগে এমন সভ্যতা নির্মাণকারী জাতির উত্থান কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব, এই বাঙালি জাতিকে দিয়েই সম্ভব। সেজন্য আমাদেরকে শুধু অল্প কয়েকটি শর্ত মানতে হবে। বাংলাদেশের মানুষকে একটি প্রাকৃতিক সত্য অনুধাবন করতে হবে যে, ল্যামার্কের সেই কথা- Survival of the fittest বা যোগ্যতমের উদ্বর্তন মোতাবেক যে জাতি যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে তারাই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে, অন্যরা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে। একে প্রাকৃতিক নির্বাচনও বলা হয়। এই জাতি কি পারবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে?
১৯৭১ সালে আমরা একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছিলাম কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো শক্তিশালী জাতিসত্ত্বা গড়ে তুলতে পারি নি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যে কী জিনিস জানতে চাইলে রোহিঙ্গা ও ফিলিস্তিনীদের জিজ্ঞেস করুন। এই ইস্পাতকঠিন জাতিসত্ত্বা গড়ে না তোলার ফল কী হয়েছে? স্বাধীনতার পর ৪৬ বছর চলে গেল, অর্ধশতাব্দি হতে চলেছে। এত বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, উর্বর ব্যবহারযোগ্য জমি, অপার প্রাকৃতিক সম্পদ, সম্পূর্ণ মিঠাপানির দেশ পৃথিবীর বুকে দ্বিতীয়টি নেই। তবুও আমরা বিশ্বের বুকে মর্যাদার আসন লাভ করতে পারছি না। এর প্রধান কারণ বিভক্তি; রাজনৈতিক বিভক্তি, ধর্মীয় বিভক্তি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি বিভক্তি। গণতন্ত্রের নামে স্বার্থপরতার রাজনীতি, ধান্ধাবাজির রাজনীতির চর্চা করতে করতে কালক্রমে অগণিত রাজনৈতিক দল গড়ে উঠেছে যারা একে অপরের জীবন-মরণের শত্রু। এক দল ক্ষমতায় গেলে অপর দল পরদিন থেকে রাস্তায় নেমে পড়ে গাড়ি ভাঙচুর করার কর্মসূচি নিয়ে। গদি থেকে টেনে নামানোর জন্য এমন কোনো রাস্তা নেই যা তারা বাদ রাখে। ক্ষমতাসীন দলের সিংহভাগ মেধা, ধ্যান, শক্তি, যোগ্যতা, সামর্থ্য, অর্থ, শ্রম, সময় ব্যয়িত হয় কথিত বিরোধী দলের মোকাবেলা করতে। আর ওদিকে ধর্মের নামে তৈরি হলো শত শত দল, মাদ্রাসাভিত্তিক দল, ইসলামিক রাজনৈতিক দল, জঙ্গিবাদী দল, পীরপন্থী দল ইত্যাদি। এই দলগুলোর একটার সাথে আরেকটার মধ্যে যে কী শত্রুতা তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তারা সুযোগ পেলেই একে অপরকে কাফের, জিন্দিক, মুরতাদ, ফেরকায়ে বাতেলা, ইহুদির দালাল ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করতে থাকে। রীতিমত ওয়াজ মাহফিল করে তারা এই কদর্য বিদ্বেষের চর্চা করে। সাপ আর বেজিও বন্ধু হতে পারে, কিন্তু তারা একে অপরের বন্ধু হতে পারে না। জনগণ এই সমস্ত ধর্মীয় দলগুলোর অনুসরণ করে হাজারো শত্রুতামূলক ভাগে বিভক্ত।
আর প্রচলিত ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতিকে মানসিক ভাবে বিভক্ত করে দিয়েছে, তাদেরকে লক্ষ্যকে চুরমার করে দিয়েছে। প্রথমেই দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তিত হলো- সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষা। সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধর্ম, নৈতিকতা, দেশপ্রেম কিছুই শিক্ষা দেওয়া হলো না। সেটা সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী, ভোগবাদী জীবনদর্শনের উপর গড়ে উঠল। ওখানে আবার দুটো মূল ভাগ – বাংলা মিডিয়াম, ইংরেজি মিডিয়াম। বাংলা মিডিয়ামে বাংলা সাহিত্য, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শরৎ পড়ানো হয়। আর ইংরেজি মিডিয়ামে পড়ানো হয় শেকসপিয়ার, বায়রন, কিটস, টেনিসন ইত্যাদি। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতদের মনে নিজের বাঙালি ও মুসলিম জাতি সম্পর্কে সীমাহীন অজ্ঞতা ও হীনম্মন্যতা তৈরি হয়। তাদের চোখে ইউরোপ হচ্ছে স্বর্গ, সেটাই সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের পাদপীঠ। নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে উন্নীত করার স্বপ্নও তারা দেখে না, তাদের একমাত্র স্বপ্ন বিদেশে গিয়ে এতদিনের শিক্ষাজীবনের যে মূল লক্ষ্য অর্থাৎ পাশ্চাত্যের ভোগবাদী জীবনের সাথে বিলীন হওয়া। এই যদি তাদের জীবনের উদ্দেশ্য না হতো, তাহলে এই শিক্ষিত লোকেরা বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক শ্রেণির রক্ত শোষণ করে এক বছরে সত্তর হাজার কোটি টাকা বিদেশের ব্যাংকে পাচার করতো না। গত ৪৫ বছরে এই শিক্ষিত জোঁকেরা কত লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে সে পরিসংখ্যান বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এরাই আবার নির্বাচনে দাঁড়ায় আর জনগণও তাদেরকেই ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি বানায়। এভাবে তারা দুধও খায়, দুধের সরও খায়।
অপরদিকে মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে প্রতি বছর হাজার হাজার কর্মবিমুখ ধর্মব্যবসায়ী পরজীবী শ্রেণির মানুষ বের হয়। সেখানেও আছে বহু প্রকার বিভক্তি। কেউ সরকারী, কেউ কওমী। কওমীদের মধ্যেও আবার রয়েছে বহু প্রকার বিভক্তি। এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের রীতিমত শত্রু। এই শত্রুতা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, তা জাতির মধ্যেও বিস্তৃত হয়েছে। এই মাদ্রাসা শিক্ষিত লোকগুলোর জীবনের কোনো বড় লক্ষ্য নেই। তারা কেবল কোনো একটা মসজিদে মাদ্রাসায় চাকরি নিয়ে তিনবেলা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারলেই তারা খুশি। জাতিকে নিয়ে ভাবার সময় নেই, যোগ্যতা নেই, সাহসও নেই। জাতি কোথায় ছিল, এখন কোথায় আছে, তাদের ভবিষ্যৎ কী, জাতির শত্রু কে কে, কী করে জাতিকে পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করা যায় এসব দুনিয়াবী বিষয় নিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজনবোধ তারা করেন না। এর ফল কী হয়েছে? সমগ্র জাতি এইভাবে জাতি নিয়ে ভাবা ছেড়ে দিয়েছে এবং আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে। ব্যতিক্রম যে দু’ চারজন নেই তা বলব না, কিন্তু তাদের শত চিৎকার কোটি কোটি স্বার্থপরের কোলাহলে হারিয়ে যায়। এইসব করেই জাতিটা আর ঐক্যবদ্ধ হতে পারলো না, নিজেদের জাতির লক্ষ্যই তারা জানতেও পারল না।
এখন বিশ্বপরিস্থিতি খুবই উপ্তপ্ত, উত্তাল, টালমাটাল। একটার পর একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ অস্ত্রব্যবসায়ী সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিগুলোর ষড়যন্ত্রে ও আগ্রাসনে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হচ্ছে। পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক শোষণমূলক অর্থব্যবস্থার পরিণামে গুটি কয়েক লোকের হাতে অকল্পনীয় অর্থবিত্ত জমা হচ্ছে আর দরিদ্র মানুষগুলো দুটো অন্নসংস্থানের জন্য উদয়াস্ত অমানুষিক পরিশ্রম করতে করতে হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে। এটা স্বাভাবিক যে পৃথিবীতে কেউ না কেউ আধিপত্য করবেই। কিন্তু সেটা যদি অন্যায় শক্তির আধিপত্য হয় তাহলে মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না, জাতিসত্ত্বার অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়ে যায়। পক্ষান্তরে আমরা বলতে চাচ্ছি, শুধু অস্তিত্ব রক্ষাই নয় বরং বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে সক্ষম হবে এবং রুদ্রহস্তে যাবতীয় অন্যায় নির্মূলকারী পরাশক্তিধর রাষ্ট্র হবে।
এখন জনগণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়, তারা এই হানাহানি, শোষণ, বিভক্তিসৃষ্টিকারী, আত্মকেন্দ্রিক জনগোষ্ঠী সৃষ্টিকারী প্রচলিত সিস্টেমের জগদ্দল পাথর পিঠে বয়ে বেড়াবে, নাকি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। আমরা বাংলার মাটি ও মানুষের মধ্যে উপরে বর্ণিত শত প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও দুনিয়াকে নেতৃত্ব দেওয়ার মত পরাশক্তিধর ও শ্রেষ্ঠ জাতি হওয়ার যে অপার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি সেটা হচ্ছে প্রথমত যে আদর্শ থাকলে একটি জাতি সামরিক, অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত ও শিক্ষাদীক্ষায় অতি উচ্চ অবস্থানে যেতে পারে সেই আদর্শ আল্লাহর দয়ায় এসে গেছে। পাশাপাশি একটি বিরাট কর্মক্ষম উদ্যমী জনগোষ্ঠীও রয়েছে। একটি বড় সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে গোটা জাতি একসঙ্গে রুখে দাঁড়ানোর ইতিহাসও তাদের রয়েছে। এখন প্রয়োজন একজন সত্যনিষ্ঠ, নির্ভীক, দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অধীনে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ করা এবং একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করে পুরো জাতিটিকে সমগ্র মানবজাতির জীবনে সত্য প্রতিষ্ঠার মহান লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করা।