আতাহার হোসাইন:
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম দু’টি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আর জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টিসহ বাকি দলগুলো মূলত অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এদের সাথে নিজেদেরকে জড়িয়ে রাখে, কখনো বা দু’একজনের মন্ত্রিত্বের বিনিময়ে একট-আধটু ক্ষমতার স্বাদ ভোগও করে থাকে। অবশ্য এ ছাড়া তাদের বিশেষ কিছু করণীয়ও নেই। কারণ, দেশের মানুষ যে দিকে জোয়ার বেশি সে দিকেই সব সময় ঝুঁকে থাকে। তারা চায়না তাদের সমর্থন কোন ক্ষুদ্র দলকে দেওয়ার মাধ্যমে তা ব্যর্থ হোক। এ কারণে বৃহত্তর এই দু’টি রাজনৈতিক দলই পাকা-পোক্ত হয়ে বসে আছে। একই কারণে ৯০ পরবর্তী সময় থেকে একে একে তারাই ঘুরে ফিরে ক্ষমতা ভোগ করে আসছে। দু’টি দলের মধ্যেই এ ব্যাপারে নিশ্চিৎ ও স্থির সিদ্ধান্ত প্রোথিত হয়ে আছে বলে সর্বদাই তারা গণমুখী ও জবাবদিহিতামূলক রাজনীতি থেকে দূরত্ব রেখে পথ চলে। উভয় দলই মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও ঐ একই কারণে তারা নিজেরাই গণতন্ত্রকে উপেক্ষা করে থাকে, গণদাবি আদায়ের নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে, তাদের স্বাভাবিক চলাচল ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা-বিঘ্নের সৃষ্টি করে। আর তাদের মুখ থেকে গণদাবির আওয়াজ উচ্চারিত হলেই সাধারণ মানুষ আতঙ্ক বোধ করে।
ব্যাপক গণ-আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে সামরিক বাহিনী থেকে উঠে আসা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সরকারের পতন হলে এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে। এর মধ্যে দু’টো দলের মধ্যে একটার পর একটা ক্ষমতায় এলেও রেকর্ড ভেঙ্গে বিগত পাঁচই জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে পর পর দুই বার ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। দেশে-বিদেশে এ নির্বাচন গৃহীত না হলেও দল জামায়াতে ইসলামীর উপর নির্ভর করে জ্বালাও-পোড়াওয়ের কর্মসূচি প্রদান করে জন মন থেকে তাদের এ জাতীয় কর্মকাণ্ডের সমর্থন হারিয়ে ফেলে। যার কারণে নির্বাচন পরবর্তী সময়ের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও মিডিয়ার সামনে সরব থাকা ব্যতীত দাবি আদায় কিংবা সরকারকে পদচ্যুতির জন্য তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে নি।
এদিকে এ অবস্থায় বর্তমানে বৃহত্তর দল দু’টো মধ্যে দু’টোই জন-সম্পৃক্ততাহীনতায় ভুগছে। আমাদের দেশে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিয়মানুযায়ী যে কোন দলকেই সমর্থন হারানোর ধারাবাহিকতায় স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগকেও জনসমর্থনহীন হয়ে পড়তে হয়েছিল। নির্বাচনের আগে প্রকাশিত জরিপ এবং সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত প্রার্থীদের ব্যাপক ভরাডুবির মাধ্যমে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু বাহির থেকে সেসবকে আমলে না নিয়ে, সংবিধানের দোহাই দিয়ে বিএনপির দাবিকে উপেক্ষা করে নিজেদের অধীনেই নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
এখন নির্বাচন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে তাদের ক্ষমতাকে স্থায়ী করতে আর বিএনপি চাচ্ছে আন্দোলন করে সরকারের পদচ্যুতি। এ জন্য আওয়ামী লীগ মুখে মুখে বিদেশ তোষণ নীতিকে অস্বীকার করে আসলেও তারা বিদেশি সমর্থন ও বৈধতা প্রাপ্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে। আওয়ামী লীগ মূলত প্রতিবেশী দেশ ভারতে কংগ্রেস সরকারে থাকা অবস্থায় অনেকটাই নিশ্চিৎ ছিলো। কেননা, বিগত নির্বাচন আন্তর্জাতিক মহলে সমর্থন না পেলেও ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকার আওয়ামী লীগকে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন প্রদান করেছে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা ও সমর্থন কতটুকু তা আমাদের দেশের সব রাজনৈতিক দলই সম্যক অবগত। যাদের পক্ষে ভারতের সমর্থন যায় তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা হয়-তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসকে ব্যাপক ভরাডুবির মুখে ঠেলে দিয়ে হঠাৎ মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির উত্থান ঘটলে আওয়ামী লীগ পূর্বের মত অব্যাহত সমর্থন পাবে কি না তা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বিএনপির মধ্যে বয়ে যায় খুশির আমেজ- যদি দুটো দলই আনুষ্ঠানিকভাবে একথা অস্বীকার করে থাকে। তবে মোদির উত্থানে বিএনপি- আওয়ামী লীগের মধ্যে খোশ-নাখোশের বন্যা বয়ে গেলেও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ এসে জানিয়ে দিয়ে গেছেন তারা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মোটেও হস্তক্ষেপ করবে না। তবে এরই মধ্যে বিএনপি ঈদের পরে সরকার পতনের আন্দোলন করার লক্ষ্য নিয়ে পুরো রমজান মাস জুড়েই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় নিজেদেরকে সংগঠিত করার কাজ করে গেছে। ঈদের পরেই দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কর্মসূচি ঘোষণা করার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অনেক দিন আগে থেকেই তিনি এ এ জন্য ঘর গুছিয়ে প্রস্তুতি নিতে দলের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে এসেছেন। তবে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বিশেষতঃ আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে পারেন।
এদিকে ঈদের পর আন্দোলনের সূচনা হলে বিএনপি কতটুকু সফলতা লাভ করতে পারবে তা নিয়েও নানা মুখী কথা চলছে। অনেকেই মনে করছেন বিএনপিতে আন্দোলন করার মত ত্যাগী নেতা-কর্মীর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাছাড়া নিজেদের মধ্যে দলীয় কোন্দল ও অনৈক্যেরও অভাব নেই। ইতোমধ্যেই ঢাকা মহানগরীর জন্য গঠিত কমিটি নিয়ে মির্জা আব্বাসের অসন্তুষ্টি ফুটে উঠেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনোবলও তেমন একটা শক্ত বলে মনে হচ্ছে না। বিশেষ করে বিগত আন্দোলনের সময় সরকারের হুকুমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান, ব্যাপক ধর-পাকড় ও মামলা হামলার কারণে এখনো তারা পুরোপুরি দাঁড়াতে সক্ষম হয় নি। এরই মধ্যে নতুন করে সর্বাত্মক আন্দোলন করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে ক্ষমতায় থাকা দলটির ভরসা অতীতের মতই অনুগত প্রশাসন ও মিডিয়ার উপর। অর্থাৎ সার্বিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে এ কথা খুব সহজভাবেই বলা যায় যে দু’টো দলের কোনটাই জনগণের উপর আস্থাশীল নয়। হয় তারা অনুগত প্রশাসন নয় বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে আছে। এ লক্ষ্যেই তারা তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সুতরাং কোনভাবেই এই পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের জন্য স্থায়ী সমাধান ও মঙ্গল বয়ে আনতে পারবে না বলে মনে করছেন অভিজ্ঞ মহল।