এস.এম.সামসুল হুদা:
যে সময়ের কথা বোলছি তখন প্রকৃত ইসলাম ছিলো না। প্রকৃত ইসলাম হারিয়ে গেছে রসুলাল্লাহর দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের ৬০/৭০ বছর পরেই যখন উম্মতে মোহাম্মদী আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ত্যাগ কোরেছে। আমরা বোলছি ১৪শ’ শতকের কথা। মোসলেম জাতির পায়ের নিচে তখন অর্ধেক দুনিয়া। অঢেল সম্পদের উত্তরাধিকার হোয়ে এই জাতিটির শাসকেরা অন্যান্য রাজা বাদশাহদের মতোই ভোগবিলাসে মত্ত। তবে তারা মোসলেম ছিলেন এ কথা অনস্বীকার্য। কারণ অর্ধ-পৃথিবীর সার্বভৌমত্ব তখনও আল্লাহর, সেখানে আইন-কানুন, অর্থনীতি, দণ্ডবিধি অর্থাৎ জীবনব্যবস্থা তখনও আল্লাহর। এই দীনের প্রভাবে সেই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিলো অকল্পনীয় শান্তি। সমাজ থেকে অন্যায় অশান্তি, অপরাধ প্রায় নির্মূল হোয়ে গিয়েছিল। মানুষের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা ছিলো চূড়ান্ত, মাসের পর মাস আদালতে অপরাধ সংক্রান্ত কোন মামলা আসতো না। মানুষ যাকাত ও সদকার অর্থ নিয়ে পথে পথে ঘুরতো কিন্তু গ্রহণ করার মতো কোন দরিদ্র মানুষ খুঁজে পেত না। একজন যুবতী নারী অলঙ্কার পরিহিত অবস্থায় সম্পূর্ণ একা শত শত মাইলের পথ পাড়ি দিতে পারতো, তার মনে কোনরূপ ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও জাগ্রত হোত না। এমন একটি সময়ে পরিব্রাজক ইবনে বতুতা মোসলেম সভ্যতার প্রতিটি শহর পরিভ্রমণ করেন। তার লেখা থেকে সে সময়ের একটি সুস্পষ্ট চিত্র পরিস্ফুট হোয়ে ওঠে।
খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রায় ৬০০ বছর পরে ১৩৩০ সনের কাছাকাছি সময়। মোসলেমরা ব্যবসা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে, হজ্বের উদ্দেশ্যে আরও বিভিন্ন কারণে দূর দূরান্তরে ভ্রমণ কোরতেন। তাদের যাত্রাবিরতি ও বিশ্রামের জন্য পথের বিভিন্ন স্থানে অতিথিশালা (ঈড়হাবহঃ) তৈরা করা হোত। যাদের নিজস্ব পরিবার পরিজন নেই, তারাও এসব অতিথিশালাতে অবস্থান কোরতেন। মক্কার অতিথিশালাগুলির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ছিলো রাবি কনভেন্ট। এখানে একটা পানির কূপ ছিলো, যার পানি এত মিষ্টি যে সারা মক্কায় তার কোনো তুলনা পাওয়া যেত না। যাঁরা এখানে থাকতো তাঁরা সবাই ছিলেন আল্লাহর জন্য সর্বত্যাগী মানুষ। হেজাজের মানুষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতো রাবিকে। আমীরের নির্দেশে তায়েফের লোকেরা এটার অধিবাসীদের জন্য ফলমূল সরবরাহ কোরত। যার যে বাগান আছে- সে পাম গাছের হোক বা ডুমুর, আঙুর বা পিচেরই হোক, উৎপাদিত ফলের একটা অংশ তাকে এই অতিথিশালার অধিবাসীদের জন্য পাঠাতে হোত, নিজের উটে করে। তায়েফ থেকে মক্কা দু’ দিনের পথ। কেউ যদি গাফেলতি বা কৃপণতাবশত সময়মত ফল না পাঠাতো তাহোলে তার বাগানের ফলন কমে যেতো। এবং পরের বছর গাছ মরে বাগান উজাড় হোয়ে যেতো। একদিন মক্কার আমীরের কয়েকজন প্রতিনিধি কনভেন্ট পরিদর্শনে এলেন সরকারি ঘোড়ায় করে। ঘোড়াগুলোকে সেই কূপের পানি খাওয়ানো হয়। তার একটু পর পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হওয়ায় সমস্ত ঘোড়া মাটিতে গড়াগড়ি খেতে শুরু কোরল। খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে আমীর নিজে কনভেন্টে ছুটে আসলেন এবং সেখানকার অধিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের একজনকে নিয়ে ঘোড়াশালে এলেন। কনভেন্টের ঐ অধিবাসী এসে ঘোড়াগুলির পেটে হাত বুলিয়ে দিতে বমি কোরল পশুগুলো, পেটের পানি বের হোয়ে যেতেই আস্তে আস্তে তারা সুস্থ হোয়ে উঠল।
এই ঘটনার কারণ বর্তমানের এই বস্তুবাদী সভ্যতার যুগে বোঝা খুবই কঠিন, উপলব্ধি করা তো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। বস্তুতঃ আল্লাহর সত্যদীন যে স্থানে প্রতিষ্ঠিত থাকে সে স্থানের প্রতিটি বিষয়ের সঙ্গে আল্লাহর প্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকে। আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী যে শাসক শাসন করেন, সেই শাসককে আল্লাহই পরিচালিত করেন। এই ঘটনার মধ্যে তেমন একটি উদাহরণই পাওয়া যায়। কনভেন্টের অধিবাসীদের জন্য যাদের নিয়মিত ফলমূল পাঠানোর দায়িত্ব তারা যদি না পাঠাতো তাদের বাগানই উজাড় হোয়ে যেত। এটা আল্লাহ কোরতেন, শাসককে কোরতে হোত না। একে বলা হয় আল্লাহর অদৃশ্য প্রশাসন বা Inner Administration. কনভেন্টের কূপে পানি নির্দিষ্ট ছিলো সেখানকার অধিবাসীদের ব্যবহারের জন্য, সরকারি লোকদের ঘোড়ার জন্য নয়। তাই যখন ঘোড়াদেরকে সেই পানি খাওয়ানো হোল সেটা ছিলো একটি অন্যায় কাজ। তাই ঐ পানি পান করার পরে ঘোড়াগুলি অসুস্থ হোয়ে পড়ে। এ সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মক্কার আমীরও বুঝতে পারেন যে তার প্রতিনিধিরা কি ভুল কোরেছে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসেন এবং কনভেন্টের অধিবাসীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তারা যখন ঘোড়াগুলির পেটে হাত বুলিয়ে দেন সেগুলির পেট থেকে ঐ পানি বের হোয়ে যায় এবং তারা সুস্থ হোয়ে যায়। মূলতঃ এটা ছিলো আমীরের প্রতিনিধিদের জন্য একটি বড় শিক্ষণীয় বিষয়। সেটা হোচ্ছে: কার কি অধিকার বা হক তা আল্লাহ কর্তৃক নির্দিষ্ট করার পর কেউ যদি সেই হক নষ্ট করে তার ফল তাকে অবশ্যই পোহাতে হবে, অন্যরাও এজন্য ক্ষতির শিকার হবে। যেমন তারা কনভেন্ট অধিবাসীদের অধিকারভুক্ত পানির অপব্যবহারের কারণে কিছু নিরপরাধ প্রাণী কষ্ট পেল।- এ শান্তিময় সুন্দর সমাজ আমরা হারিয়েছি।
আর বিনিময়ে যা পেয়েছি তা হোল:- আল্লাহর সত্যদীনকে প্রত্যাখ্যান কোরে আজকে আমরা দাজ্জালের তৈরি মতবাদ গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ইত্যাদি গ্রহণ কোরে নিয়েছি। প্রশ্ন হোল আমরা কিসের বিনিময়ে কি পেয়েছি? এইসব তন্ত্রমন্ত্রের গালভরা বুলি আছে কিন্তু তা অনাহারী মানুষের পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারছে না। প্রতিদিন প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ না খেয়ে আছে। এই তন্ত্রমন্ত্রের প্রদত্ত মানবাধিকার সনদ অতি মানবিক, কিন্তু বাস্তবে দেখি পৃথিবীর কোটি কোটি মোসলেম নামধারী মানুষ গৃহহারা, তাদের জীবনের কোন মূল্য নেই, তাদের মেয়েদের ইজ্জতের কোন মূল্য নেই। এই সব তন্ত্রমন্ত্র মানুষকে স্বাধীনতার নামে দেয় দাসত্বের বেড়ি, অধিকারের নামে দেয় অপমান আর লাঞ্ছনা। অন্যায় আর অশান্তির দাবানলে প্রতি মুহূর্তে অঙ্গার হোচ্ছে মানুষ। জীবন ও সম্পদের ন্যূনতম নিরাপত্তাও মানুষের অবশিষ্ট নেই।
এই যে বিপর্যয় সৃষ্টি হোয়েছে তা আমাদেরই কর্মফল। যখনই মানুষ অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ কোরেছে তখনই জন্ম নিয়েছে অশান্তির। সেই অশান্তি আজ পুরো মানবজাতিকে গ্রাস কোরে নিয়েছে। ইহুদি খ্রিস্টান সভ্যতার প্রভাবে সকল মানুষই আজ অন্যায়ের শিকার, সকলেই তার অধিকার বঞ্চিত, সকলেই ক্ষুব্ধ। এমতাবস্থায় এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ হোল, সেই হারানো সত্যদীনকে, স্রষ্টা প্রদত্ত জীবনব্যবস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনা। প্রকৃত ইসলাম ১৩০০ বছর আগেই হারিয়ে গেছে। কিন্তু তার প্রভাব যে কয় শতাব্দী পৃথিবীর বুকে ছিলো তার একটি নিদর্শন একটু আগেই উপস্থাপন কোরলাম। মহাকালের অথৈ সাগরে যেই ধনভাণ্ডারের চাবি আজ থেকে ১৩০০ বছর আগে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই চাবির কথা দূরে থাক ধনভাণ্ডারের অস্তিত্বই আজ মানুষ ভুলে গেছে। ফলে সেই ধনভাণ্ডার উদ্ধারের কোন আশাই আর ছিলো না। এমন সময় মহান আল্লাহ আবার মানবজাতিকে দয়া কোরলেন। তিনি তাঁর সেই হারিয়ে যাওয়া ধনভাণ্ডারের চাবি, তওহীদ মানবজাতির হাতে ফিরিয়ে দিলেন। যাঁর মাধ্যমে তিনি এই বিরাট সুযোগ মানবজাতিকে দান কোরলেন তিনি এই যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী। সেই ধনভাণ্ডার হোচ্ছে আল্লাহর সত্যদীন। তিনি হেযবুত তওহীদের কাছে সেই ধনভাণ্ডার রেখে গেছেন। এখন হেযবুত তওহীদ মানবজাতিকে সর্বান্তকরণে আহ্বান কোরছে এই ধনভাণ্ডার গ্রহণ কোরে তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ ও শান্তিময় করার জন্য।