উম্মুততিজান মাখদুমা পন্নী:
পরম করুণাময় স্রষ্টা অতি যত্নের সাথে তাঁর শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি মানুষকে এই বিশাল বিস্তৃত পৃথিবীর কর্তৃত্ব দিয়ে প্রেরণ কোরেছেন যেন তারা সুখে শান্তিতে এখানে জীবনযাপন করে। এই পৃথিবী মানুষের জন্য। পৃথিবীতে মহান রব্বুল আলামীন যেসকল নেয়ামত দান কোরেছেন তার সবগুলোই মানুষের জন্য। মানবজাতি এক জাতি। ধর্ম, বর্ণ, ভাষা এবং অবস্থানের ভিত্তিতে বর্তমানে মানবজাতিকে যেভাবে বিভক্ত কোরে রাখা হোয়েছে তা কখনোই স্রষ্টা চান না। হিন্দু, মোসলেম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদি সবাই একই আদম-হাওয়ার সন্তান। একই জায়গা থেকে তাদের উৎপত্তি। মৃত্যুর পর সবাইকে এক আল্লাহর কাছেই ফিরে যেতে হবে। ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভক্তি করা হোয়েছে তা নিছক গুটি কয়েক লোকের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে। সকল ধর্মই এক স্রষ্টা থেকে আগত, তাই সব ধর্মই একই কথা অর্থাৎ মানবতার কথা বলে। অথচ বর্তমানে ধর্মকে অতি বিশ্লেষণ কোরে, যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ কোরে মানুষ এবং স্রষ্টার মধ্যবর্তী এক মাধ্যম হিসাবে আবির্ভূত হোয়েছে মোল্লা পুরোহিত শ্রেণি। ধর্ম সবার জন্য, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার সবার জন্য সমান। বর্তমানে সময় এসেছে এসকল মোল্লা-পুরোহিতদের কবল থেকে ধর্মকে রক্ষা করার। তাই কবি নজরুল বিপ্লবের ডাক দিয়ে বোলেছেন-
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী,
মোল্লা-পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!
কোথা চেঙ্গিস গজনী-মামুদ, কোথায় কালা পাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যতো তালা-দেওয়া-দ্বার!
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
এদের কূপমণ্ডুকতা এবং ব্যক্তি স্বার্থের কবলে পড়ে বর্তমানে হিন্দুরা দাবি কোরছেন ‘ভগবান’ তাদের, মোসলেমরা মনে কোরছেন ‘আল্লাহ’ তাদের, খ্রিস্টানরা মনে কোরছেন ‘গড’ শুধুই তাদের, ইহুদিরাও মনে করে ‘এলী’ শুধু তাদের। কিন্তু ভগবান, আল্লাহ, গড এবং এলী যে নামেই ডাকা হোক তিনি মূলত একজনই। তিনি প্রতিটি স্থান এবং কালের জন্য যে জীবনবিধান পাঠিয়েছেন তার উদ্দেশ্যও এক; আর তা হোল- অন্যায়, অত্যাচার, বিভেদ-ব্যবধান ভুলে এক আদম-হাওয়া দম্পতি থেকে আগত মানবজাতি যেন সুখে ও শান্তিতে বসবাস কোরতে পারে। আর এ জন্যই আদম (আ:), দাউদ (আ:), ঈসা (আ:), মুসা (আ:), এব্রাহীম (আ:), মোহাম্মদ (সা:), কৃষ্ণ (আ:), বুদ্ধ (আ:) সহ যত মহামানব পৃথিবীতে এসেছেন তাদের ডাক একই ছিল।
আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ
কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ।
কিন্তু তাদের আনীত শিক্ষা এবং আদর্শকে এই ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা পুরোহিতরা অবিকৃত অবস্থায় থাকতে দেয় নি। আজকের ধর্মান্ধদের কাছে সাতদিনের অভুক্ত ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেবার চাইতে নামাজ পড়া বেশি জরুরি, তাদের কাছে আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের চাইতে মসজিদ, মন্দির বেশি সম্মানিত, যদিও স্রষ্টা মানুষের কল্যাণের জন্যই মসজিদ, মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহর রসুলের সময় মসজিদ ছিল গরীব ধনী সব মানুষের আশ্রয়স্থল, সেটা কখনওই তালাবদ্ধ থাকতো না। এই ধর্মান্ধরা গরিবদেরকে ঘৃণা কোরে, মানুষের হক নষ্ট কোরে, মানবতার গলায় বিভক্তির ছুরি চালিয়ে ধর্মগ্রন্থকে চুমু খায়। এরা বুঝতে চায় না যে ঐ ধর্মগ্রন্থ স্রষ্টা মানুষের জন্যই নাজেল কোরেছেন, মানবতার মুক্তির জন্য দান কোরেছেন। কাজেই মানবতার গলায় ছুরি চালিয়ে যতোই ধর্মগ্রন্থে চুমু খাওয়া হোক না কেন তা যে স্রষ্টার অপছন্দ তা বুঝতে তাদের মতো পণ্ডিত হবার প্রয়োজন নেই, মানুষ হওয়াই যথেষ্ট। তারা বুঝতে পারে না যে, স্রষ্টার কাছে হাজারও মসজিদ, মন্দির, ধর্মগ্রন্থের চাইতে একটা বুভুক্ষু হাড্ডিসার দুর্বল মানুষের দাম অনেক বেশি। কারণ সেই মানুষের মাঝেও তাঁর রূহ বিরাজ করে। সেই মানুষ কষ্ট পেলে তিনিও কষ্ট পান। নজরুল বলেন,
মানুষেরে ঘৃণা করি’
ও’ কারা কোরআন, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’
ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর ক’রে কেড়ে,
যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে,
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!