হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম:
ঔপনিবেশিক যুগের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যাদের সামগ্রিক ধারণা আছে তারা অস্বীকার করতে পারবেন না যে, আমাদেরকে পদানত করার পর চিরকালের জন্য গোলাম বানিয়ে রাখতে ব্রিটিশরা একটি চক্রান্ত করেছিল। তারা দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল- একটি সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা, আরেকটি মাদ্রাসা শিক্ষা। এই দুটো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে চিন্তা-চেতনায় মৌলিক ব্যবধান ও বৈপরীত্য রয়েছে। এখানেই তারা আমাদের জাতিটিকে মানসিকভাবে ও বাস্তবে বিভক্ত করে দিয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য কী ছিল তা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন অধ্যক্ষ ইয়াকুব শরীফ “আলিয়া মাদ্রাসার ইতিহাস” বইয়ের ভূমিকায় লিখেছেন, “মুসলমানরা ছিল বীরের জাতি, ইংরেজ বেনিয়ারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাদের প্রচলিত ধর্ম, শিক্ষা ও মর্যাদা হরণ করার জন্য পদে পদে যেসব ষড়যন্ত্র আরোপ করেছিল, আলিয়া মাদ্রাসা তারই একটি ফসল। বাহ্যত এই প্রতিষ্ঠানের পত্তন করা হয়েছিল আলাদা জাতি হিসাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষণের নিমিত্তে, যাতে মুসলমানদের ধর্ম, কৃষ্টি ও আদর্শ রক্ষা পায়। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়াই ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য।” এই যে ধোঁকাটা দিল, কী সে ধোঁকা? মারটা কোন জায়গায় দিল সেটা বুঝতে হবে। এখন ফলাফল দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমরা কোথায় ধোঁকাটা খেয়েছি।
ব্রিটিশ পণ্ডিতরা অনেক গবেষণা করে একটি বিকৃত ইসলাম তৈরি করেছিল যা থেকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চেতনাকে (জেহাদ) বাদ দেওয়া হয় এবং ব্যক্তিগত জীবনের মাসলা-মাসায়েল, ফতোয়া, দোয়া-কালাম, মিলাদের উর্দু-ফার্সি পদ্য, বিশেষ করে দীনের যে বিষয়গুলো সম্পর্কে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন মাজহাবের ফকীহদের মধ্যে বহু মতবিরোধ সঞ্চিত ছিল সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করে অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয় যেন সেগুলো নিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষিতরা তর্ক, বাহাস, মারামারিতে লিপ্ত থাকে। সেই ইসলামটিকে জাতির মনে-মগজে গেড়ে দেওয়ার জন্য বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেসটিংস ১৭৮০ সনে ভারতের তদানীন্তন রাজধানী কোলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে। সেখানে নিজেরা অধ্যক্ষ থেকে পর পর ২৬ জন খ্রিষ্টান (প্রথম খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ.এইচ. স্প্রিঙ্গার এম.এ. এবং শেষ খ্রিষ্টান অধ্যক্ষ এ. এইচ. হার্টি এম.এ.) ১৯২৭ সন পর্যন্ত ১৪৬ বছর ধরে মুসলিম জাতিকে সেই বিকৃত ইসলামটি শেখায়। [দেখুন- আলীয়া মাদ্রাসার ইতিহাস, মূল- আঃ সাত্তার, অনুবাদ- মোস্তফা হারুন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ এবং Reports on Islamic Education and Madrasah Education in Bengal by Dr. Sekander Ali Ibrahimy (Islami Foundation Bangladesh)]।
মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে গণিত, ভূগোল, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদির কোনো কিছুই রাখা হলো না। ফলে আলেমরা বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলেন। কিন্তু জীবিকা ছাড়া তো মানুষ চলতে পারে না। অগত্যা তারা ধর্মের বিভিন্ন কাজ করে রুজি-রোজগার করাকেই নিয়তি হিসাবে গ্রহণ করলেন। ব্রিটিশরা এটা এই উদ্দেশ্যে করল যেন তারা সর্বদা পরনির্ভরশীল হয়ে থাকে এবং মেরুদণ্ড সোজা করে কখনো তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারে। ইংরেজরা তাদের এ পরিকল্পনায় শতভাগ সাফল্য লাভ করল। সেখান থেকে কোর’আন-হাদীসের জ্ঞান নিয়ে লক্ষ লক্ষ আলেম বেরিয়ে আসছেন কিন্তু তাদেরকে জাতির ঐক্য গঠনের গুরুত্ব, জীবন-সম্পদ উৎসর্গ করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রেরণা, সমাজে বিরাজমান অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দেয়া হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের পরিণামে তাদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের অহঙ্কার যেমন সৃষ্টি হলো, পাশাপাশি তাদের হৃদয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গতিশীল ভ‚বন থেকে পিছিয়ে থাকার দরুন একপ্রকার হীনম্মন্যতাও সৃষ্টি হলো। তাদের অন্তর্মুখিতা, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গোঁড়ামি, বিভক্তি, নিস্পৃহতা, স্বার্থপরতা, ইসলামের নামে অন্ধত্ব, অযৌক্তিক, কুসংস্কার ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি প্রচণ্ড বিদ্বেষের মূল কারণ এই শিক্ষাব্যবস্থার গোড়াতেই প্রোথিত রয়েছে। শত শত বছর আগের সামাজিক পরিস্থিতিতে উদ্ভ‚ত সমস্যাবলীর সমাধান ঐ সময়ের আলেমরা কীভাবে করেছিলেন সেটা তাদের লেখা ফতোয়ার বইগুলোতে ঠাঁই পেয়েছে। বর্তমানের আমূল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন হাজারো সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু কিতাবি ইসলাম আটকে গেছে সেই পুরানো ফতোয়ার বইতে। এখন যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চাইবেন, তারা নিজেদের সুবিধার জন্য ঘড়ির কাটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে সেই হাজার বছর আগের সমাজটি আগে প্রতিষ্ঠা করতে চান। মাদ্রাসাগুলোর সিলেবাসে সেই আদ্দিকালের চর্বিত চর্বনেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বর্তমান সময়ের সমাজে যে বাস্তব সমস্যাগুলো বিরাজ করছে সেগুলোর বাস্তব কোনো সমাধান সেখানে নেই।
আলীয়া আর কওমী ধারার মধ্যে পার্থক্য এটুকুই যে, একটি সরকারি অর্থায়নে চলে আরেকটি জনগণের দানের টাকায় চলে। উভয় শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য কী সেটা ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। বর্তমানে মানবজাতির জীবনে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেওয়া জীবনব্যবস্থার ত্রুটির দরুন যে হাজারো বাস্তব সমস্যার প্রাদুর্ভাব হয়েছে সেগুলোর সমাধান ঐ মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থায় যুগোপযোগী, বিজ্ঞানভিত্তিক, যৌক্তিকভাবে উল্লিখিত না থাকায় একটি আদর্শিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠী ইসলামিক রাজনীতির নামে, ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জেহাদের নামে মাদ্রাসা ছাত্রদের ঈমানী চেতনাকে নিজেদের মতবাদের অনুক‚লে টেনে নিচ্ছে। কেউ অপরাজনীতিতে তাদের ব্যবহার করছে কেউ জঙ্গিবাদে কাজে লাগাচ্ছে। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে সে কিন্তু ধর্মের প্রকৃত শিক্ষাটি পেল না। এই শূন্যতাটাই কাজে লাগাচ্ছে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো। এখানেই মাদ্রাসা শিক্ষার সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় (General Education System) দীন সম্পর্কে প্রায় কিছুই শিক্ষা দেওয়া হয়নি। বরং সুদভিত্তিক অংক, ব্রিটিশ রাজা- রানির ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, গণিত, পাশ্চাত্যের ধর্মহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা, পাশ্চাত্য বস্তুবাদী দর্শন ইত্যাদি শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম সম্পর্কে, বিশেষ করে ইসলাম সম্পর্কে একটা বিদ্বেষভাব (A hostile attitude) শিক্ষার্থীদের মনে প্রবেশ করানো হলো। ওখান থেকে লক্ষ লক্ষ কথিত আধুনিক শিক্ষিত লোক বের হচ্ছেন যাদের অধিকাংশই চরম আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। নিজেদের বৈষয়িক উন্নতি ছাড়া আর কিছুই তারা ভাবেন না। তাদের বিরাট একটা সংখ্যা ইসলাম ও অন্যান্য ধর্মকে মনে করেন সেকেলে, মধ্যযুগীয় চিন্তাধারা, কল্পকাহিনী। তাদের দৃষ্টিতে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে ধর্ম অচল। তাদেরকে শেখানো হলো আধুনিক সমস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পশ্চিমাদের উদ্ভাবন। কিন্তু এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত্তি যে মুসলিমরাই নির্মাণ করেছিল সেটা তাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হলো না। এদের মধ্যে অনেকেই আছে প্রচণ্ড ধর্মবিদ্বেষী অথচ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাদের জন্ম। আল্লাহর রসুল সম্পর্কে জঘন্য কট‚ক্তি করতেও এদের অনেকের বিবেকে বাধে না। এই বিদ্বেষ প্রচার থেকেও সহিংসতার সৃষ্টি হচ্ছে। নিজ দেশের ভুক্ষা-নাঙ্গা কঙ্কালসার মানুষদের রক্ত শোষণ করে নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দেয় তথাকথিত এই শিক্ষিত লোকগুলো।
আজ এই উভয় শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা শিক্ষিতজনেরা একে অপরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়িতে লিপ্ত থাকেন, দিনকে দিন তাদের মধ্যে বিরাজিত বিদ্বেষ, অবিশ্বাসের ব্যবধান সরু নালা থেকে সাগরে পরিণত হচ্ছে। উভয়েই একে অপরের ছিদ্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্ররা যখন জঙ্গিবাদী হামলা চালাচ্ছে তখন মাদ্রাসা শিক্ষিতরা আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে বলছেন, এই হামলা যদি মাদ্রাসার ছেলেরা চালাতো তাহলে কেমন হতো? আবার কলেজ ভার্সিটি থেকে শিক্ষিতরা যখন দেখেন যে জঙ্গি হামলাকারীরা কোনো মাদ্রাসার ছাত্র তখনই তারা খুব সহজেই পূর্বধারণার ছকটি ইসলামের উপর বসিয়ে দেন। এই যে দ্বন্দ্ব, এর মূল কারণ দ্বিধাগ্রস্ত শিক্ষাব্যবস্থা, যে বিষবৃক্ষটি ব্রিটিশরা রোপন করেছিল। সময় অনেক গড়িয়েছে। একশ’ বছর আগের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি যেমন এক নয় তেমনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতিও এক নয়। বহু প্রাণ ও রক্তের কোরবানির বিনিময়ে এই ভূখণ্ড অর্জন করা হয়েছিল। সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো একটা তাণ্ডব সৃষ্টির জন্য সদা তৎপর। এই অবস্থায় বিভাজিত, বস্তুবাদী শিক্ষাব্যবস্থা আর রাখা যাবে না। জাতির জন্য প্রযোজ্য, ঐক্যসৃষ্টিকারী বিজ্ঞানভিত্তিক এবং ধর্মীয় চেতনা সম্বলিত শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি।
লেখক: এমাম, হেযবুত তওহীদ
ফেসবুক: facebook.com/emamht