ওমর খৈয়াম ১০৪৪ খ্রিষ্টাব্দে খোরাসানের রাজধানী নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আসল নাম গিয়াস উদ্দীন আবুল ফতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহীম। কিন্তু তিনি ওমর খৈয়াম নামেই সমগ্র বিশ্বে পরিচিত। খৈয়াম হচ্ছে বংশগত উপাধি। খৈয়াম শব্দের অর্থ হচ্ছে তাবু নির্মাতা বা তাবু ব্যবসায়ী। সম্ভবত বংশের কেউ তাবু তৈরি করতেন কিংবা তাবুর ব্যবসা করতেন। আর সে থেকেই খৈয়াম অর্থাৎ তাবু নির্মাতা। তিনি জ্ঞানের যে তাবু নির্মাণ করে গেছেন, আজও বিশ্বের অগণিত জ্ঞানপিপাসু মানুষ প্রবেশ করে জ্ঞানের সে তাবু অভ্যন্তরে এবং আহরণ করে জ্ঞান। ওমর খৈয়ামের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত জানা যায় না। এমনকি এ মনীষীর জন্ম তারিখ নিয়েও রয়েছে মতভেদ। পারস্য ঐতিহাসিকগণের মতে গজনীর সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে আনুমানিক ১০১৮ থেকে ১০৪৮ সালের মধ্যে কোন এক সময়ে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী, অংকশাস্ত্রবিদ, দার্শনিক, গনিতবেত্তা, কবি। তিনি কেবলমাত্র আত্মতুষ্টির জন্যে বিজ্ঞানচর্চার অবসর সময়ে মনের খেয়ালে এক ধরনের চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন। তিনি নিজ মাতৃভূমি ইরানেও জীবিতাবস্থায় কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন না। অথচ মনের খেয়ালে তাঁর লিখিত কবিতাগুলো আজ সমগ্র বিশ্বে হয়েছে সমাদৃত এবং দখল করেছে সাহিত্য ও কবিতা জগতের শ্রেষ্ঠ সিংহাসন।
ওমর খৈয়াম আজ সমগ্র বিশ্বের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। কিন্তু ইউরোপীয়রা অত্যন্ত কৌশলে এ মহামনীষীকে বিশ্ব বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীর পরিবর্তে কেবলমাত্র একজন কবি হিসেবে পৃথিবীর মানুষের সামনে পরিচিত করার চেষ্টা করেছেন। ওমর খৈয়ামের মৃত্যুর ৭৩৪ বছর পর ১৮৫৭ সালে এডোয়ার্ড ফিজারেল্ড খৈয়ামের ‘রুবাইয়াত’ নামক চতুষ্পদ কবিতাগুলোর ইংরেজি অনুবাদের দ্বারা সমগ্র ইউরোপে তাঁর ‘রুবাইয়াত’ ছড়িয়ে দেয় এবং তিনি কবি হিসেবে পরিচয় লাভ করেন। ওমর খৈয়াম ছোটবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান।
তাঁর স্মরণ শক্তি এত প্রখর ছিল যে, যে কোন দর্শনগ্রন্থ এবং কঠিন কঠিন কিতাবসমূহ মাত্র ৬/৭ বার পাঠ করেই তা মুখস্ত করে ফেলতেন। তাঁর মেধা ও প্রতিভার সামনে সক্রেটিস, এ্যারিস্টটল এবং ইউক্লিড এর প্রতিভাও ম্রয়িমান হয়ে যায়।
“সূর্যের আলোতে যেরূপ পৃথিবীর সকল কিছুই ভাস্বর হয়ে উঠে, তেমনি জ্ঞানের আলোতে জীবনের সকল অন্ধকার আলোকদ্ভাসিত হয়ে উঠে।”
…ওমর খৈয়াম
ওমর খৈয়ামের শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত পণ্ডিত ইমাম মোয়াফিক। মনীষী ওমর খৈয়ামের আর্থিক অবস্থা খুব ভালো ছিল না। আমীর আবু তাহির জ্ঞানচর্চার জন্যে কিছু অর্থ সাহায্য করেন এবং রাজ্যের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে তাঁর আর্থিক দুরাবস্থা সামান্য লাঘব হয়। রাষ্ট্রীয় সাহায্য তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানসাধনা ও গবেষণার কাজে সহায়তা করেছিল। কোন বই হাতে পেলেই তা তিনি পড়ে শেষ করে ফেলতেন। জ্যোতির্বিজ্ঞান, বীজ, গণিত ও জ্যামিতি ছিল তাঁর খুব প্রিয় বিষয়। এছাড়া দর্শনশাস্ত্রে ছিল তাঁর অসাধারণ ব্যুৎপত্তি। মানুষ হিসেবে ছিলেন তিনি খাঁটি মুসলমান ও আল্লাহপ্রেমিক।
১০৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বৈজ্ঞানিক ওমর খৈয়াম সেলজুকের সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের অনুরোধে রাজকীয় মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁর উপর অর্পিত হয় এক গুরুদায়িত্ব। রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কার্যনির্বাহের সুবিধার্থে একটি সঠিক সৌর বর্ষপঞ্জি তৈরির জন্যে সুলতান জালাল উদ্দিন মালিক শাহের অনুসারে এর নাম দেন আত্ তারিখ আল জালালী বা জালালী অব্দ। এ জালালী বর্ষপঞ্জিতে ৩৭৭০ বৎসরে মাত্র ১ দিনের ভ্রান্তি ছিল। অপরদিকে গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জিতে ভ্রান্তি ছিল ৩৩৩০ বৎসরে মাত্র ১ দিনের। জালালী অব্দ হিজরী ৪৭১ সালের ১০ রমজান থেকে শুরু হয়। এ মহান বিজ্ঞানী একটি নতুন গ্রহও আবিষ্কার করেছিলেন। ওমর খৈয়ামের সর্বাদিক অবদান এলজাবরা বা বীজগণিতে। তিনিই সর্বপ্রথম এলজাবরার সমীকরণগুলোর শ্রেনী বিন্যাসের চেষ্টা করেন। জ্যামিতি সমাধানে বীজগণিত এবং বীজগণিত সমাধানে জ্যামিতি পদ্ধতি তাঁরই বিস্ময়কর আবিষ্কার। ভগ্নাংশীয় সমীকরণের উল্লেখ ও সমাধান করে ওমর খৈয়ামই সর্বপ্রথম বীজগণিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। বীজগণিত সম্পর্কীয় ‘ফি আলজাবের’ নামক গ্রন্থ তিনিই রচনা করে যান। বীজগণিতের ক্ষেত্রে ‘বাইনোমিয়াল থিওরাম’ আবিষ্কার করেন। এই ‘বাইনোমিয়াল থিওরাম’ এর আবিষ্কারকর্তা হিসেবে বৈজ্ঞানিক নিউটন আজ পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছেন। অথচ তারও শত শত বছর পূর্বে কবি হিসেবে পরিচিত ওমর খৈয়াম তা আবিষ্কার করে গেছেন। গণিত শাস্ত্রেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। গণিত জগতে এলালিটিক জিওমেট্রির কল্পনা তিনিই সর্বপ্রথম করেন। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে জনৈক গণিতবিদ একে পূর্ণাঙ্গরূপ দেয় মাত্র।
এছাড়া পদার্থবিজ্ঞানেও তাঁর অবদানের কোন কমতি নেই। ওমর খৈয়ামকে মেধা ও চিন্তাশক্তি এত গভীর ছিল যে, একদিন ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ওমর খৈয়ামকে প্রশ্ন করেছিলেন, “কোন গোলক যে গোলকের অংশের উপর ঘুরতে থাকে, গোলকের সমস্ত অংশ এক প্রকার হওয়া সত্ত্বেও ওই অংশটি অন্যান্য অংশ থেকে কিভাবে আলাদারূপে জানা সম্ভব?” এ প্রশ্নের জবাবে ওমর খৈয়াম তখনই অংকের ব্যাখ্যা শুরু করেন। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্তও তার ব্যাখ্যা শেষ হয়নি। তাঁর জবাবে ইমাম গাজ্জালী (রঃ) সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, “সত্যের সন্ধান পেয়ে মিথ্যার যবনিকা অপসারিত হল। ইতিপূর্বে এ বিষয়ে আমার যে ধারণা ছিল তা মিথ্যা।” ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বিশিষ্ট চিকিৎসাবিজ্ঞানী। তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানেও বহু বহু রচনা করে যান।
ওমর খৈয়াম যে এত বড় দার্শনিক, বিজ্ঞানী, অংকশাস্ত্রবিদ ও চিকিৎসাবিদ ছিলেন তা মুসলিম জাতির অনেকেই হয়তো আজও জানেন না। কেবলমাত্র একজন কবি হিসেবেই তাঁকে সবাই চিনেন। এ অসাধারণ ব্যক্তিটিকে তাঁর জীবিতাবস্থায় নিজ মাতৃভূমির লোকেরাও চিনত না বা চেনার চেষ্টা করত না। ওমর খৈয়াম কখনো নিজকে জনগণের সামনে নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করেন নি। তাঁর মত বহু মুসলিম মনীষী নিজের ব্যক্তিত্বকে লুকিয়ে রেখে সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প সাহিত্যে অবদান রেখে গেছন। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থই সংরক্ষণের অভাবে আজ হারিয়ে গেছে। তাঁর গ্রন্থাবলীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
রুবাইয়াত (মরমী কবিতা),
মিজান-উল-হিকাম (রসায়ন বিজ্ঞান),
নিজাম-উল-মূলক (রাজনীতি),
আল জাবরা ওয়াল মুকাবিলা (বীজগণিত),
মুশফিলাত (গণিতশাস্ত্র),
নাওয়াযিম আসকিনা (ঋতু পরিবর্তন বিষয়ক),
আল কাউল ওয়াল তাকলিক (মানুষের নৈতিক দায়িত্ব),
রিসালা মুকাবাহ,
দার ইলমে কুল্লিয়াত,
(১০) নওরোজ নামা প্রভৃতি।
বিশ্ব বিখ্যাত এ মনীষী ১১২৩ খ্রিষ্টাব্দে ৭৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। জানা যায়, মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর শিষ্যদের শেষবারের মতো বিশেষ উপদেশ দানের উদ্দেশ্যে আহ্বান করেন। এরপর তিনি ওজু করে এশার সালাহ আদায় করেন। এদিকে তিনি শিষ্যদের উপদেশ দানের কথা ভুলে যান। নামাজান্তে সেজদায় গিয়ে কাঁদতে থাকেন এবং জোরে জোরে বলতে থাকেন, “হে আল্লাহ আমি কেবলমাত্র তোমাকে পাবার এবং তোমাকে সন্তুষ্ট করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। আমি চাই তোমাকে। হে আল্লাহ, আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি। তোমার দয়া ও করুণার গুণে আমাকে ক্ষমা করে দাও।” এরপর তিনি আর মাথা তুলেন নি। সেজদা অবস্থায়ই তিনি চিরদিনের জন্যে এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান আল্লাহপাকের সান্নিধ্যে। তিনি বর্তমান সমাজের মুসলিমদের জন্য একজন রোল মডেল। তিনি শুধু নামাজ, রোজা, হজ্জ, যাকাত প্রভৃতিতেই ক্ষান্ত ছিলেন না, জাতির উন্নতির জন্যে তথা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে বিজ্ঞান ও সাহিত্য চর্চাও করেছেন।