কাজী মাহফুজ
খলিফা ওমরের (রা.) শাসনামলে মিশর বিজয়ী সেনানায়ক আমর ইবনুল আস (রা.) রসুলাল্লাহর প্রিয় সাহাবী আবু ওবাদাহ বিন সামেতকে (রা.) মকোকাসের নিকট মুসলিম বাহিনীর দূত হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। তখন মিশর ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অংশ, সেখানে কপটিক খ্রিষ্টান যাজক আর্চ বিশপ মকোকাস শাসন করতেন।
আবু ওবাদাহ (রা.) ছিলেন এমন এক যোদ্ধা যাকে যুদ্ধক্ষেত্রে এক হাজার কাফেরের সমতুল্য বলে মনে করা হতো। তিনি ছিলেন মদিনার খাজরাজ বংশীয় এবং আকাবার বায়াতে অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম। রসুলের একদল সর্বত্যাগী সাহাবী যাদেরকে আসহাবে সুফফা বলা হতো, তারা বাড়ি-ঘরে যেতেন না, মসজিদে নববীতে থাকতেন আর অপেক্ষা করতেন রসুল কখন কী হুকুম দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সে হুকুম বাস্তবায়ন করতেন। আবু ওবাদাহ (রা.) সেই আসহাবে সুফফার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রসুলের সঙ্গে থেকে তিনি প্রায় সকল যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। এই দুর্ধর্ষ চরিত্রের সর্বত্যাগী সাহাবীকেই সেনাপতি আমর ইবনুল আস (রা.) রাজদরবারে প্রেরণ করেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজার সামনে তিনটি বিকল্প প্রস্তাব প্রদান করা। আমর (রা.) বলে দেন ওবাদাহ (রা.) যেন তিন শর্তের বাইরে অন্য কিছুই মিশরীয়দের থেকে গ্রহণ না করেন। ঐ তিন শর্ত হলো-
১) আল্লাহর রসুল সত্য দীন নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন- এই দীন মেনে নিয়ে মুসলিম হয়ে যাও, তাহলে তোমরা আমাদের ভাই হয়ে যাবে এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুল এই দীনকে সমস্ত পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করার যে দায়িত্ব আমাদের ওপর অর্পণ করেছেন, সে দায়িত্ব তোমাদের ওপরও বর্তাবে।
২) যদি তা গ্রহণ না করো তবে আমাদের বশ্যতা স্বীকার করো, আমরা আল্লাহর দেয়া দীন, কোর’আনের আইন-কানুন, দ-বিধি, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করব; তোমরা যার যার ধর্মে থাকবে, আমরা বাধা তো দেবই না বরং সর্বপ্রকারে তোমাদের এবং তোমাদের ধর্মকে নিরাপত্তা দেব; বিনিময়ে তোমাদের যুদ্ধক্ষম লোকেরা বার্ষিক সামান্য একটা কর দেবে, যার নাম জিজিয়া। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, স্ত্রীলোক, রোগগ্রস্ত মানুষ এবং বালক-বালিকা, শিশুগণকে এ কর দিতে হবে না। এর পরও তোমাদের রক্ষার জন্য যুদ্ধে তোমাদের মধ্য থেকে যেসব যুদ্ধক্ষম লোক আমাদের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করবে তাদের ঐ জিজিয়া দিতে হবে না।
৩) যদি এই দুই শর্তের কোনোটাই না মেনে নাও তবে যুদ্ধ ছাড়া আর পথ নেই। আমরা তোমাদের আক্রমণ করে পরাজিত করে আল্লাহর দীন, জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব।
মুসলিম বাহিনীর প্রতিনিধিগণ আবু ওবাদাহর (রা.) নেতৃত্বে মকোকাসের রাজদরবারে প্রবেশ করলেন। আবু ওবাদাহকে (রা.) দেখেই মকোকাসের যে প্রতিক্রিয়া হলো তা ছিল খুবই ভয়ঙ্কর। তিনি আতঙ্কিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন: “এই কালোটাকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর করে দাও, তোমাদের মধ্য থেকে অন্য কেউ আমার সাথে কথা বলো।” তখন শেতাঙ্গরা কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষই জ্ঞান করত না। যদিও আবু ওবাদাহ (রা.) কৃষ্ণাঙ্গ ছিলেন না, কিন্তু তার গায়ের রং সাধারণের চেয়ে কালো ছিল।
প্রতিনিধি দলের একজন বললেন Ñ ‘এই কালো মানুষটিই প্রজ্ঞায় ও জ্ঞানে আমাদের মধ্যে অগ্রণী। তিনিই আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম, আর তিনিই আমাদের আমীর (আদেশকারী)। তার প্রতিটি কথা ও আদেশই আমরা মান্য করি। আমাদের সেনাপতি তাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছেন এবং আমাদেরকে হুকুম করেছেন যেন আমরা তার কোনো সিদ্ধান্ত, এমনকি সাধারণ কোনো কথার ব্যাপারেও কোনোরূপ আপত্তি না তুলি।’
মুসলিম প্রতিনিধির এই কথা মকোকাসকে কৌতূহলী করে তুললো। তিনি বললেন: ‘কিন্তু তোমরা কি করে একজন কালো মানুষকে তোমাদের আমীর হিসাবে মেনে নিলে? সে কি হিসাবে তোমাদের অন্তর্ভুক্ত হলো?’
মুসলিম প্রতিনিধি জবাব দিলেন, ‘না। আপনার চোখে তিনি কালো হতে পারেন কিন্তু তিনি পদমর্যাদায়, ঈমানে, বিচারবুদ্ধিতে এবং প্রজ্ঞায় আমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। আমাদের মধ্যে শামিল হতে তার গায়ের রং কোনো বিচার্য বিষয়ই নয়।’
অগত্যা মকোকাস একরাশ ঘৃণা মিশ্রিত চোখে আবু ওবাদাহর (রা.) দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বেশ, তাই হোক। কিন্তু খবরদার কালো মানুষ, আমার সাথে তুমি সংযত হয়ে ভদ্রভাবে কথা বলো। কারণ তোমার গায়ের রঙ আমাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। তোমার কথাও যদি এমন রুক্ষ হয় তাহলে তা আমার ক্রোধ উদ্রেক করতে পারে।’
ওবাদাহ (রা.) তখন ধীর পদক্ষেপে অন্যদের থেকে এগিয়ে মকোকাসের সামনে গিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন এবং বললেন, “তোমার কথা তো শুনলাম, এবার আমার কথা শোন। আমার সঙ্গীদের মধ্যে আরও এক হাজার কালো মানুষ আছে, যারা প্রত্যেকে দেখতে আমার চেয়েও কালো এবং কুৎসিত। তাদেরকে দেখলে তুমি আমাকে দেখে যতটা না আতঙ্কিত হয়েছ তার চেয়ে বেশি আতঙ্কিত হতে। আমি আমার যৌবন পার করে এসেছি, তারপরেও আল্লাহর রহমে এখনও আমি একাই এক হাজার কাফেরের অন্তরাত্মায় ত্রাস সৃষ্টি করতে পারি; এমনকি তারা যদি আমাকে একযোগেও আক্রমণ করে তবু। এই একই কথা আমার সঙ্গীদের প্রত্যেকের বেলায়ও সমানভাবে খাটে।
“আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমাদের হৃদয়ের আকুলতা আর আল্লাহর রাস্তায় অবিরাম সংগ্রাম করে যাওয়ার নেশা ও তাতে দৃঢ় প্রত্যয়ী থাকার প্রশিক্ষণ (সবর) আমাদের চরিত্রকে এমনভাবে তৈরি করেছে। আমাদের জেহাদ শুধু তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে আমাদের সামনে অবতীর্ণ হয়। সেই জেহাদ আমরা পার্থিব কিছুর আশায় করি না, সম্পদ লাভের জন্যেও করি না। যেটুকু গনিমত আল্লাহ আমাদের জন্য বৈধ করেছেন শুধু তা-ই আমরা গ্রহণ করি। এ থেকে কেউ প্রচুর সোনার মালিক হতে পারে আবার কেউ এক দেরহামের বেশি কিছু নাও পেতে পারে, এটা আমাদের কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ আমরা বেঁচেই আছি শুধু আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ করার জন্য। আমাদের শুধু পেটের ক্ষুধা নিবারণ আর পরার কাপড়ের চেয়ে বেশি কিছু চাই না। এই দুনিয়ার জীবনের কোনো মূল্য আমাদের কাছে নেই- এর পরের জীবনই আমাদের কাছে সব। এই হচ্ছে আমাদের প্রতি আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ ও আমাদের নবীর হুকুম।”