মশিউর রহমান:
বর্তমানে ইসলামকে বহুভাবে অপব্যবহার করা হচ্ছে, মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে জাতি বিনাশী কর্মকা-ে লিপ্ত করা হচ্ছে। ইসলামের নাম দিয়ে বহু দিকে মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কেউ ধর্মের বিনিময়ে অর্থ রোজগার করে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করছেন, কেউ অপরাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করে গোষ্ঠীস্বার্থ আদায় করছেন, কেউ সন্ত্রাসী জঙ্গিবাদী কার্যকলাপ করে জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড ঘটাচ্ছেন। এগুলোর কোনোটাই আল্লাহ রসুলের ইসলাম নয়। তাদের ইসলাম আর আল্লাহ-রসুলের ইসলাম যে এক নয় তা বোঝার জন্য রসুলের জীবনী থেকে দুইটি ঘটনাই যথেষ্ট। একদিন আল্লাহর রসুল (সা.) ক্বাবা ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। মুসলমানদের উপরে নির্যাতন তখন চরমে পৌঁছেছে। এক সাহাবী এসে অত্যন্ত কাতর কণ্ঠে রসুলকে (সা.) বললেন, হে রসুলাল্লাহ! আপনি দোয়া করুন যাতে এই মোশরেকরা ধ্বংস হয়ে যায়। এ কথা শুনে তিনি সোজা হয়ে বসলেন। তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী বললে? সাহাবি আবার বললেন। শুনে রসুলাল্লাহ বললেন, শোনো, শিগগিরই এমন সময় আসছে যখন একজন সুন্দরী যুবতী একা সানা থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করতে পারবে, তার মনে এক আল্লাহ এবং বন্য পশু ছাড়া আর কিছুরই ভয় থাকবে না।
বিশ্বনবীর (সা.) এই কথাটির ভেতরে প্রবেশ করুন। ইসলামের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে যায় একটি কথাতেই। তিনি কি বললেন? তিনি মূলত ইঙ্গিত দিলেন- এত বাধা, এত অত্যাচার সত্ত্বেও তিনি সফল হবেন এবং যাদের ধ্বংস করার জন্য ঐ সাহাবা দোয়া করতে বলছেন তারাই এমন বদলে যাবে এবং তাদের দিয়েই এমন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে একা একটা মেয়ে মানুষ কয়েক শ’মাইল পথ নির্ভয়ে চলে যেতে পারবে।
এতে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়। এক- ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা, দুই- আল্লাহর রসুল এত অত্যাচারের মুহূর্তেও চান নি অত্যাচারী মোশরেকরা ধ্বংস হয়ে যাক। এর দ্বারা তিনি তাঁর উম্মতের জন্য শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন যে, মানুষের বিনাশ নয়, মানুষের কল্যাণ সাধন করাই মুক্তির পথ।
আরেকটি ঘটনা তায়েফের। মক্কায় বছরের পর বছর প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর তিনি তায়েফবাসীর কাছে যান। সেখানকার গোত্রপতিদের সাথে রসুলাল্লাহর নিজ গোত্রের সুসম্পর্ক ছিল। তাই অতিথিপরায়ণ আরবদের কাছে তিনি অন্তত অসৌজন্যমূলক আচরণ আশা করেন নি। কিন্তু বাস্তবে সেখানে তাঁকে আরও নির্মমভাবে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। তায়েফের নেতৃস্থানীয়রা এলাকার বখাটে শিশু-কিশোরদের লেলিয়ে দেয় রসুলকে শারীরিক নির্যাতন করতে। তারা পাথর নিক্ষেপ করতে করতে রসুলের সারা শরীর রক্তাক্ত করে ফেলে। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সেদিন জিব্রাইল এসে রসুলকে বলেছিলেন- ‘আপনি যদি চান আমি তাদের উপর তায়েফের দু’দিকের পাহাড় একত্র করে তাদের ধ্বংস করে দেই।’ কিন্তু সেই রিপুজয়ী মহামানব বললেন- ‘না না, আমি আশা করি তাদের ভবিষ্যৎ বংশধর সত্য গ্রহণ করবে।’
রসুলাল্লাহ সেদিন তায়েফবাসীর মুর্খতার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়েছিলেন। বলেছিলেন- হে আল্লাহ, তারা অজ্ঞতাবশত এই কাজ করেছে, তাদেরকে পাকড়াও কর না। এই অতুলনীয় উদারতার মাধ্যমে সেদিন মানব ইতিহাসের বিস্ময়কর ওই মহামানব দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, ইসলাম ‘ধ্বংস’ নয়, শান্তির পক্ষে। আল্লাহর রসুলের ইসলাম আর সন্ত্রাসবাদীদের ইসলাম এক নয়। আজকে ইসলামের নাম করে যারা বিনাশের প্রলয়নাচন শুরু করেছে তাদের ইসলাম আর আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলামের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ, উদ্দেশের তফাৎ, প্রক্রিয়ার তফাৎ। প্রকৃত ইসলামে সংগ্রাম মানুষকে শান্তি দেওয়ার জন্য, আর এরা সেই মানুষকেই বিনাশ করে নিজেরা জান্নাতে যেতে চায়। আল্লাহ-রসুলের ইসলাম চায় মানবজীবনে সার্বিক নিরাপত্তা, এরা চায় আতঙ্ক-ভয়-ত্রাস। আল্লাহ-রসুলের ইসলাম চায় সম্প্রীতি, এরা চায় আক্রোশ-বিদ্বেষ আর রক্তপাত। প্রকৃত ইসলাম ঐক্যহীনকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, শত্রুকে ভাই বানিয়েছিল, স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক মানুষকে মানবতার কল্যাণে উৎসর্গিকৃতপ্রাণ করেছিল।
যারা এদেরকে দেখে ভাবছেন ইসলাম সন্ত্রাসীপনা শিক্ষা দেয়, নিরীহ মানুষ হত্যা সমর্থন করে এবং এটা দেখে ইসলামের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হচ্ছেন, তাদেরকে বলব- আপনারা ভুল বুঝবেন না, ওটা ইসলাম নয়। যারা ইসলামকে ব্যবহার করে স্বার্থোদ্ধার করে ও বিধ্বংস ডেকে আনে, তারা কেবল মানবতার শত্রুই নয়, তারা ইসলামেরও শত্রু।