রাকীব আল হাসান
শুষ্ক মরুভূমি, উত্তপ্ত বালুকারাশি। মাঝে মাঝেই সব ল-ভ- করে দিয়ে যাচ্ছে মরুঝড়। মানুষের হৃদয়গুলিও শুষ্ক, মেজাজ উত্তপ্ত। কারণে অকারণে মানুষ-খুন, হানাহানি, দাঙ্গা, যুদ্ধ। একবার যুদ্ধ বেধে গেলে যেন আর থামেই না। মানুষগুলো কেমন যেন অসভ্য-জানোয়ার প্রকৃতির। কারো জীবনের নিরাপত্তা নেই এতটুকু। নারীদের ন্যূনতম সম্মানটুকু নেই। যুলুম-নির্যাতন সীমা ছাড়িয়েছে। আপন লোককে হত্যা করা, গোত্রে গোত্রে বছরের পর বছর যুদ্ধ করা, পরস¤পদ লুট করা, নারীদের অমর্যাদা করা- এগুলো যেন কোনো অপরাধই না।
ব্যক্তিজীবনে ন্যূনতম শৃঙ্খলা নেই। চুল-দাড়ি উস্কখুস্ক, মুখ দুর্গন্ধযুক্ত, পোশাকগুলো অপরিচ্ছন্ন। অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসই তাদের ধর্ম। সত্য ধর্মকে বিকৃত করে কিছু প্রথার মধ্যে আবদ্ধ করে ব্যবসা করে খাচ্ছে এক শ্রেণির ধর্মব্যবসায়ীরা। দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত তাদের জীবন। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি তাদের অন্যতম পেশা। অশিক্ষিত, অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত বর্ববর আরব বেদুইন জাতি। আইয়্যামে জাহেলিয়াতের সেই আরব বেদুইনদের মাঝেই শান্তির সুশীতল বাতাস ছড়িয়ে দিতে এসেছিলেন আমার প্রাণপ্রিয় নবী মোহম্মাদুর রসুলাল্লাহ (সা.)।
সেই জাতিকে আমার নবী (সা.) সারা জীবনের অক্লান্ত পরিশ্রম, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর অটল অধ্যবসায়ের মাধ্যমে এমন এক জাতিতে পরিণত করলেন যারা অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে অর্ধ-পৃথিবীতে অনাবিল শান্তি, পূর্ণ নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত করে শ্রেষ্ঠ জাতির আসনে আসীন হলো। সেই অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, অবহেলিত, অশিক্ষিত আরব বেদুইনরাই হয়ে গেল শিক্ষকের জাতি। সেই জাতিকে রসুলাল্লাহ (সা.) এমন শিক্ষা দিলেন যে সমস্ত দিক দিয়ে তাঁরা উন্নতির চরম শিখরে আরোহণ করল। দুই-দুইটা পরাশক্তি রোমান ও পারস্যকে একই সাথে সামরিকভাবে পরাজিত করল। সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল তাদের কীর্তি।
কিন্তু সেই জাতি গঠনের মূলমন্ত্র কী ছিল? কোন জাদুর কাঠির পরশে জাতির এমন পরিবর্তন হলো? খুব সহজ। রসুলাল্লাহ (সা.) আইয়্যামে জাহেলিয়াতের অন্ধকারে নিমজ্জিত সেই জাতির কাছে প্রথম যে আহ্বান করেছিলেন, যে বালাগ দিয়েছিলেন তা হলো- তোমরা এই কথার উপর সাক্ষ্য দাও যে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলাল্লাহ” (সা.) অর্থাৎ “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রসুল।” এটাই হলো সেই অপরাজেয় জাতি গঠনের মূলমন্ত্র, জান্নাতে যাওয়ার চাবি, মো’মেন হওয়ার প্রথম শর্ত।
মহানবী (সা:) বলেছেন- “জান্নাতের চাবি হচ্ছে- আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই” (মুয়াজ বিন জাবাল থেকে আহমদ, মেশকাত)। অপর হাদীসে এসেছে- যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে “আল্লাহ ছাড়া কোনো হুকুমদাতা (ইলাহ) নেই এবং মোহাম্মদ (সা:) তাঁর প্রেরিত” তার জন্য জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। (ওবাদাহ বিন সাবেত থেকে মুসলিম, মেশকাত)। এছাড়াও অনেক হাদীস থেকে দেখান যাবে যে, তওহীদই জান্নাতের চাবি। কালিমা তথা তওহীদের স্বীকৃতি না দিলে যেমন মুমিন মুসলিম থাকা যায় না ঠিক তেমনই স্বীকৃতি দানের পর আবার তওহীদের ওপর থেকে সরে গেলেও আর মো’মেন মুসলিম থাকা যায় না, আর এটা সবাই জানে যে, মো’মেন মুসলিম না থাকলে সে জান্নাতে যেতে পারবে না, সে যতই ইবাদত করুক। দীনুল হকের ভিত্তি হচ্ছে তওহীদ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এই কালিমাটি, এ নিয়ে কারো কোন দ্বিমত নেই। তওহীদ ব্যতীত কোন ইসলামই হতে পারে না, তওহীদই ইসলামের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সেই শিক্ষকের জাতি আজ আবার ঘৃন্য দাসে পরিণত হয়েছে। সারা পৃথিবীব্যাপী অন্য জাতিগুলোর কাছে মার খাচ্ছে, অপমানিত হচ্ছে, ধর্ষিতা হচ্ছে, লাঞ্ছিত হচ্ছে তবু একটু প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারছে না, অথচ এরা সংখ্যায় ১৬০ কোটি। এর মূল কারণ হচ্ছে সেই মূলমন্ত্র ছেড়ে দেওয়া। আল্লাহ তওহীদ থেকে বহু দূরে অবস্থান করছে মুসলিম নামক এই জাতি। মুসলিম জাতিটি আজ তাদের সৃষ্টির যে উদ্দেশ্য ছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে। সেই উদ্দেশ্য ছিল সমস্ত পৃথিবীময় আল্লাহর তওহীদভিত্তিক (সার্বভৌমত্ব) সত্যদীন, জীবনব্যবস্থা, দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে মানবজীবন থেকে যাবতীয় অন্যায় অবিচার অশান্তি দূর করার সংগ্রাম করা। যতদিন না মানবজীবন থেকে যাবতীয় অশান্তি দূরীভূত না হয়, ততদিন মুসলিম জাতির উপর আল্লাহর অর্পিত এই পবিত্র দায়িত্ব বহাল থাকবে। সেই দায়িত্ব এই জাতি ভুলে গিয়ে ব্যক্তিগত আমল করে জান্নাতে যাওয়ার কোশেশ করছে। আর আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখান করে পশ্চিমা সভ্যতার সার্বভৌমত্বকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, মুসলিম বলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি তওহীদ সম্পর্কে যে ধারণা করে (আকিদা) তা ভুল। তাদের কাছে তওহীদ মানে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস করা এবং তাঁর ইবাদত বা উপাসনা করা। ‘তওহীদ’ এবং ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ এই আরবি শব্দ দু’টি একই মূল থেকে উৎপন্ন হলেও এদের অর্থ এক নয়। ‘ওয়াহদানিয়াহ্’ বলতে বোঝায় মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ যে একজন তা বিশ্বাস করা (একত্ববাদ-Monotheism), পক্ষান্তরে ‘তওহীদ’ মানে ঐ এক আল্লাহর সার্বভৌমত্ব মেনে নেওয়া, তাঁর ও কেবলমাত্র তাঁরই নিঃশর্ত আনুগত্য করা। আরবের যে মুশরিকদের মধ্যে আল্লাহর শেষ রসুল এসেছিলেন, সেই মুশরিকরাও আল্লাহর একত্বে, ওয়াহদানিয়াতে বিশ্বাস করত, কিন্তু তারা আল্লাহর হুকুম, বিধান মানত না অর্থাৎ তারা আল্লাহর আনুগত্য করত না। তারা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সামষ্টিক জীবন নিজেদের মনগড়া নিয়ম-কানুন দিয়ে পরিচালনা করত। এই আইনকানুন ও জীবন ব্যবস্থার উৎস ও অধিপতি হিসাবে ছিল বায়তুল্লাহ, কা’বার কুরাইশ পুরোহিতগণ। মূর্তিপূজারী হওয়া সত্ত্বেও তাদের এই ঈমান ছিল যে, এ বিশ্বজগতের স্রষ্টা আল্লাহ একজনই এবং তাদের এই ঈমান বর্তমানে যারা নিজেদেরকে মুমিন মুসলিম বলে জানে এবং দাবি করে তাদের চেয়ে কোন অংশে দুর্বল ছিল না (সুরা যুখরুফ ৯, আনকাবুত ৬১, লোকমান ২৫)। কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর প্রদত্ত হুকুম মানতো না, তাই তাদের ঐ ঈমান ছিল অর্থহীন, নিষ্ফল এবং স্বভাবতঃই আল্লাহর হুকুম না মানার পরিণতিতে তাদের সমাজ অন্যায়, অত্যাচার, অবিচার, নিরাপত্তাহীনতা, সংঘর্ষ ও রক্তপাতে পরিপূর্ণ ছিল, এ জন্য আরবের ঐ সময়টাকে আইয়্যামে জাহেলিয়াত বলা হয়। আল্লাহর হুকুমের প্রতি ফিরিয়ে আনার জন্যই তাদের মধ্যে প্রেরিত হয়েছিলেন শেষ রসুল মোহাম্মদ (সা.)। রাসুলও (সা.) সে কাজটিই করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে অন্যায় অশান্তিতে নিমজ্জিত সেই সমাজটি নিরাপত্তা, ন্যায়বিচার, সুখ-সমৃদ্ধিতে পূর্ণ শান্তিময় (ইসলাম অর্থই শান্তি) একটি সমাজে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং আল্লাহর আনুগত্য না করাই ছিল তাদের কাফের মুশরিক হওয়ার প্রকৃত কারণ। বর্তমানের মুসলিমরা উপলব্ধি করতে পারছে না যে প্রাক-ইসলামিক যুগের আরবের কাঠ পাথরের মূর্তিগুলিই এখন গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, একনায়কতন্ত্র, রাজতন্ত্র ইত্যাদির রূপ ধরে আবির্ভূত হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যাটি আল্লাহর পরিবর্তে এদের তথা এদের প্রবর্তক ও পুরোধা ‘পুরোহিতদের’ আনুগত্য করে যাচ্ছে। এই প্রতিটি তন্ত্র আলাদা আলাদা একেকটি দীন (জীবনব্যবস্থা), ঠিক যেমন দীনুল হক ‘ইসলাম’ও একটি জীবনব্যবস্থা। পার্থক্য হলো, এই মানুষের মস্তিষ্ক প্রসূত দীনগুলি মানবজীবনের বিশেষ কিছু অঙ্গনের, বিশেষ কিছু বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে, কিন্তু সঠিক সমাধান দিতে পারে না আর ইসলাম মানবজীবনের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় থেকে শুরু করে সামষ্টিক অঙ্গনের সকল বিষয়ে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা দিয়ে থাকে। আল্লাহর নিকট একমাত্র গ্রহণযোগ্য দীন ইসলাম। এটা ছাড়া আল্লাহ কোনো কিছুই গ্রহণ করবেন না। আল্লাহ বলেছেন, “ আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদরে দ্বীনকে র্পূনাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত সর্ম্পূণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদরে জন্যে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম” (সুরা মায়েদা- ৩)। অথচ বর্তমানের মুসলিম নামক জনসংখ্যাটি এই সকল মানবরচিত তন্ত্রের প্রতিমার আনুগত্য করে সেই পৌত্তলিক আরবদের মতই জাতিগতভাবে শিরক ও কুফরে নিমজ্জিত হয়ে আছে। এখন এই শতধাবিচ্ছিন্ন জাতিকে পুনরায় এক কলেমার উপরে, তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সবাইকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম, সার্বভৌমত্ব মানবো না। তবেই তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তি নিশ্চিত হবে।