মুস্তাফিজ শিহাব
সভ্যতার ক্রমবিকাশে বর্তমানে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে প্রগতির চূড়ায় অবস্থান করছি। এই সভ্যতা আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে কিন্তু ছিনিয়ে নিয়েছে সব থেকে প্রয়োজনীয় দুটি উপাদান এই দুটি উপাদান একজন মানুষের জন্মগত চাহিদা। উপাদান দুটি হচ্ছে শান্তি ও নিরাপত্তা। কয়েকটি পরিবার, গোত্র, দেশ ও দেশগুলির শিল্প-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি সব কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হয় সভ্যতা। সভ্যতার ক্রমবর্ধমান বিকাশে এই একটি জিনিসই বরাবরই হয়ে এসেছে। ছোট্ট পরিবার থেকে শুরু করে বিশাল সভ্যতা পর্যন্ত মানুষের প্রথম চাহিদা কিন্তু সেই দুটিই থাকে, শান্তি ও নিরাপত্তা। যখনই কোনো সভ্যতা এই দুটি চাহিদা পূরণে অপরাগ হয় তখনই ওই সভ্যতার ধ্বংস নেমে আসে।
বর্তমানে পৃথিবীময় চলছে ‘ইহুদি খ্রিষ্টান যান্ত্রিক বস্তুবাদী সভ্যতা’। যে সভ্যতায় শান্তি ও নিরাপত্তার অভাব স্পষ্ট। একের পর এক ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যেগুলোর মাধ্যমে বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট হয়। দেশে দেশে লেগে রয়েছে যুদ্ধ-বিগ্রহ। ন্যায়-অন্যায়ের বালাই নেই, আইনের প্রয়োগ নেই। এখানে শক্তিই সব, ‘Might is Right’। যে যেভাবে পারছে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য শক্তির প্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে কোনো সভ্যতাই টিকে থাকতে পারে না।
একাধারে ইরাক-সিরিয়া- লেবানন-আফগানিস্তান-সোমালিয়া-আরাকানে চলছে যুদ্ধাবস্থা। যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও সহিংসতায় প্রতিটি দেশ হয়ে উঠেছে জ্বলন্ত কয়লার স্তুপ। নির্বিচারে গণহত্যা চলছে, ধর্ষিত হচ্ছে কোটি কোটি নারী, বিতাড়িত হচ্ছে লাখো মানুষ। কিন্তু এর পিছনে কারণ হলো ইহুদি-খ্রিষ্টান সভ্যতার কর্ণধার পশ্চিমাদের ভূরাজনীতিক লীলাখেলা। তেলের জন্য, বন্দরের জন্য, সামরিক সুবিধার জন্য, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য, প্রভাব বিস্তারের জন্য সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা পরাশক্তি একের পর এক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করে যাচ্ছে যা আমাদের সকলের সামনেই স্পষ্ট। প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত হয়েও এত শরণার্থী দেশ ত্যাগ করেনি যত শরণার্থী সাম্রাজ্যবাদীদের এই সন্ত্রাসবাদী আচরণের জন্য হয়েছে। তাদের এই অতিমাত্রায় শোষণের কারণেই সভ্যতা তার মূল রূপ থেকে বিকৃত হয়ে গিয়েছে এবং ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে উপনীত হয়েছে। পুরো মানবজাতি আজ ত্রাহি সুরে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যই আর্ত-চিৎকার করছে।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বিষয়টি অধিক স্পষ্ট হয়। রোমান-পারস্য সভ্যতা যখন আজকের পাশ্চাত্য যান্ত্রিক সভ্যতার মতো ক্ষয়িষ্ণু, পতনোন্মুখ হয়ে পড়েছিলো, তখনই উন্মেষ ঘটে মুসলিম সভ্যতার। মুসলিম সভ্যতা ‘শান্তি ও নিরাপত্তা’ অধিকহারে নিশ্চিত করতে পেরেছিল এবং তার কারণেই দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী যাবৎ পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য ও উন্নত সভ্যতা বলতেই ছিলো মুসলিম সভ্যতা। বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রগতি মুসলিম সভ্যতারও অনন্য কৃতীত্ব ছিল, কিন্তু একমাত্র সম্বল নয়। মুসলিম সভ্যতার শেকড় প্রোথিত ছিল আল্লাহর হুকুম অর্থাৎ ন্যায় ও সত্যের ভেতরে। ভারতবর্ষের কথাও যদি চিন্তা করি তবে যুগ পরিবর্তনের মূল কারণই ছিল এই শান্তি ও নিরাপত্তা। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দ বংশের রাজা ধনানন্দকে পরাজিত করে মৌর্য সাম্রাজ্যের ভিত্তি গড়েন। সেই ধনানন্দের পরাজয়ের পিছনে অন্যতম কারণ ছিল তার বিদ্রোহী জনতা যারা অত্যাচারী রাজার শোষণে, নিপীড়নে অতিষ্ট হয়ে পরেছিল। অশান্তি ও অনিরাপদ অবস্থা তাদের এই বিদ্রোহে বাধ্য করে এবং চন্দ্রগুপ্তকে তারা সহেজই গ্রহণ করতে পারে।
হ্যাঁ এই সভ্যতা আমাদের থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা ছিনিয়ে নিলেও সভ্যতা আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে এ কথা স্বীকার করতেই হবে। শুরুতেই বলে এসেছি সভ্যতার ক্রমবিকাশে জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তিতে সভ্যতার চূড়ায় অবস্থান করছি। কিন্তু এই জ্ঞান-বিজ্ঞানের ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের কৃতিত্ব পুরোপুরি এই সভ্যতার নয়। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন একটি ক্রমবর্ধমান বিষয়। সেই প্রথম মানুষটি থেকেই এটা হয়ে আসছে এবং ক্রমে বৃদ্ধি হতে থাকবে। বর্তমান ইহুদি খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতার গোড়া প্রোথিত আছে প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায়। প্রাচীন গ্রিক সভ্যতা থেকেই পরবর্তীতে রোমান-পারস্য সভ্যতা, মিসরীয় সভ্যতা, মুসলিম সভ্যতা ও বর্তমান ইহুদি খ্রিষ্টান সভ্যতা। পাশ্চাত্য সভ্যতার পূর্বে মুসলিম সভ্যতা প্রযুক্তির যে উন্মেষ ঘটিয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেই বতর্মান পাশ্চাত্য সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে। আবার এই সভ্যতার প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের উপর ভিত্তি করে ভবিষ্যতে হয়ত গড়ে উঠবে অন্য কোনো সভ্যতা। সভ্যতার এই ভাঙাগড়ায় প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের চাইতে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করে শান্তি ও নিরাপত্তার জায়গাটি, যেই জায়গায় আজকের পাশ্চাত্য সভ্যতা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। খুবই স্বাভাবিক, কারণ ‘সভ্য’ থেকে সভ্যতা শব্দটির উৎপত্তি, আর যে সভ্যতায় ন্যায় অন্যায় বলে কিছু থাকে না, শান্তি ও নিরাপত্তাকে হার মানতে হয় শক্তিধরের স্বেচ্ছাচারিতার কাছে, সেই সভ্যতা তো সভ্যতাই হতে পারেনি, সেটি বড়জোর হতে পারে যান্ত্রিক প্রগতি। আজ যারা সেই প্রযুুক্তিগত প্রগতির দোহাই দিয়ে এ সভ্যতাকে বাহবা দিচ্ছেন তাদের বোঝা উচিত- সভ্যতার রদবদলে প্রযুক্তিগত উন্নতির পথ রুদ্ধ হয়ে যায় না। যদি এমনটিই হত তবে গ্রিসের পতন ঘটার সাথে সাথে গ্রিক দর্শন ও বিজ্ঞানও হারিয়ে যেত।
পাশ্চাত্য সভ্যতার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে। সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন এবং সাম্প্রদায়িক মনভাব যে হারে প্রকট হচ্ছে তাতে এ সভ্যতার ধ্বংস হতে বেশি দেরিনেই। একটি বিশ্বযুদ্ধই যথেষ্ট। হ্যাঁ, এ আত্মহীন, জড়বাদী, বস্তুবাদী সভ্যতা ধ্বংস হবে এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। প্রশ্ন হলো, তার সাথে আমরাও ধ্বংস হয়ে যাব নাকি তার আগেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে নিজেদের রক্ষার উপায় অন্বেষণ করব? আজকে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল হামলার ঘটনা কিংবা নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলার ঘটনাটাই বোধদয় হবার জন্য যথেষ্ট নয় কি? পরম শান্তি ও নিরাপত্তার দেশ হিসেবে খ্যাত দেশগুলোতে এমন ঘটনা ঘটার পরও কি আমরা ধরে নিতে পারি না- এই সভ্যতা পৃথিবীর কোনো স্থানকেই শান্তি ও নিরাপত্তার চাদরে ঢাকতে পারেনি? এরপরও আমরা চাইলেই উটপাখির মতো মাথা গুঁজে বসে থাকতে পারি, কিন্তু তার পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। সময় গেলে সাধন হবে না। যখন নিদানের কাল আসবে তখন কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে ‘দুর্বলচিত্তের মনুষ্যের ন্যায় বলিয়া উঠিতে হইবে- অদ্দিষ্টে যাহা আছে তাহাই হইবে।’
(মুস্তাফিজ শিহাব: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, facebook.com/glasnikmira13)