গতকাল যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী পন্নী বংশীয় সুলতানি পরিবারের উত্তরসূরী হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর এগারোতম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করেছে হেযবুত তওহীদ। রাজধানীর উত্তরাস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কনফারেন্স হলে এ উপলক্ষে একটি স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। তাঁর বক্তব্য ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সারাদেশের শাখাগুলোতে সম্প্রচার করা হয়। অনুষ্ঠানে এমামুয্যামানের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেন তাঁর সহধর্মিণী খাদিজা খাতুন, দুই কন্যা উম্মুত তিজান মাখদুমা পন্নী ও রুফায়দাহ পন্নী।
প্রতিবছর এই দিনটিতে হেযবুত তওহীদ স্মরণসভা আয়োজন করলেও গত রাতের প্রেক্ষাপট ছিল কিছুটা ভিন্ন। কারণ গতকাল হেযবুত তওহীদের সদস্যরা প্রকৃত ইসলামের সামনে বাধার প্রাচীর সৃষ্টিকারী অপশক্তির বিরুদ্ধে নতুন করে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হন। ২০১২ সনের এই দিনে প্রতিষ্ঠাতার প্রয়াণের পর হেযবুত তওহীদের সদস্যরা তাঁর জানাজা অনুষ্ঠানে অঙ্গীকার করেছিলেন যে, তারা বিশ্বের বুকে ছড়িয়ে পড়বেন এবং তওহীদের এই বাণীকে তারা পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে বহন করে নিয়ে যাবেন। পথহারা মানুষকে হেদায়াতের দিশা দান করবেন। বিগত এক দশক জুড়ে এই অঙ্গীকার পূরণ করতে গিয়ে তারা ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীর রোষাণলে পড়েছেন বহুবার। তাদের ফতোয়া, অপপ্রচার ও গুজবসন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছে তিনজন সদস্যকে। আর তাদের হামলায় আহত হয়েছেন, বাড়িঘর হারিয়েছেন শত শত সদস্য। শুধু গত বছরই অন্তত পঞ্চাশ জায়গায় হেযবুত তওহীদের উপর আক্রমণ করেছে ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠী। তাদের এসব সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়ায় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা গতকাল নতুন করে এই মর্মে শপথ গ্রহণ করেছেন এবং প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যে, আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা আর ঘরে ফিরবেন না। মিলনায়তনে এক কর্মী সভার আয়োজন করে হেযবুত তওহীদ। এর প্রস্তুতি হিসেবে বরিশালের ডিসি, পুলিশ কমিশনার, পুলিশ সুপারসহ সরকারের যাবতীয় দপ্তর থেকে লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়। কিন্তু অনুষ্ঠানের দিন চরমোনাই ইসলামী আন্দোলনের নেতা মাওলানা ওবায়দুর রহমান মাহবুব, ইসলামী আন্দোলন বরিশালের মুখপাত্র আব্দুল্লাহ্ আল মামুন টিটু, বরিশাল মহানগর সেক্রেটারী মুফতি সৈয়দ নাসির আহম্মেদ কাওসার, জয়েন্ট সেক্রেটারী মাওলানা মো. আবুল খায়ের এর নেতৃত্বে ২০-২৫ জন লোক গিয়ে থানা ঘেরাও করে। তারা থানায় গিয়ে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চাপ সৃষ্টি করে। এবং যেকোন অপ্রীতিকর ঘটনায় প্রশাসনকে দায়ভার নিতে হবে বলে হুমকি দেয়। এদিকে সম্মেলনের দিন সকাল থেকেই তারা অনুষ্ঠানস্থলের আশেপাশে লাঠিসোটা নিয়ে অবস্থান করে ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়। ফলে নগরীতে যানজট দেখা যায়। সংঘাতের আশঙ্কায় অনেকে দোকানের শাটার নামিয়ে দেয়। পুরো নগরী স্থবির হয়ে পড়ে।
থানা পুলিশের পক্ষ থেকে হেযবুত তওহীদের নেতাদের সেদিন সম্মেলন না করার অনুরোধ জানানো হয়। আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তারা সম্মেলন স্থগিত রাখে। তবে এই অন্যায়, জোরজবরদস্তিমূলক কার্যক্রমের প্রতিবাদে হেযবুত তওহীদের স্থানীয় নেতাকর্মীরা রাজপথে নেমে আসে। তারা বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সম্মুখে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। এসময় বক্তব্য রাখেন হেযবুত তওহীদের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. মাহবুব আলম মাহফুজ। মানববন্ধনে তিনি বলেন, “শিল্পকলা একাডেমিতে আমাদের অনুষ্ঠান বন্ধ করতে চরমোনাই পীরের অনুসারীরা যেভাবে উদ্ধত ও উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছে এবং থানায় গিয়ে যেভাবে প্রশাসনকে হুমকি-ধামকি দিয়েছে তা নজীরবিহীন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে, প্রশাসন তাদের অন্যায্য দাবির কাছে নত স্বীকার করেছে। কারণ আমরা প্রশাসনের সব ধরনের অনুমতি নিয়েই সভা করার প্রস্তুতি নিয়েছি। তারা আমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং প্রশাসনকে আরো শক্ত হাতে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার অনুরোধ করছি। তা নাহলে ভবিষ্যতে তারা আরো অচলাবস্থার সৃষ্টি করবে, যার সামাল দেওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে।” মানববন্ধন শেষে একটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মিছিলটি বরিশাল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্বর থেকে শুরু হয়ে বরিশাল সদর রোড প্রদক্ষিণ করে জেলখানা মোড়ে গিয়ে শেষ হয়।
এদিকে হেযবুত তওহীদের এই বিক্ষোভ কর্মসূচি দেখে চরমোনাইয়ের অনুসারীরা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা সেদিন সন্ধ্যার পর হেযবুত তওহীদের উপজেলা কার্যালয়গুলোর সামনে লোক জড়ো করে অবস্থান নেয়। এছাড়াও মসজিদে মসজিদে মাইকের মাধ্যমে হেযবুত তওহীদের অফিসে হামলা করার জন্য ঘোষণা দেয়। কাশিপুর বাজারে হেযবুত তওহীদের কার্যালয়ের সামনে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, মাগরিবের নামাজের পরপরই বিভিন্ন মসজিদ থেকে চরমোনাই পীরের অনুসারীরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তবে তারা এই এলাকার বলে মনে হয়নি। এসময় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা কার্যালয়ের ভিতরে অবস্থান করছিল। পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে একসময় হেযবুত তওহীদের সদস্যরা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পরে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে জেলা হেযবুত তওহীদ। সংবাদ সম্মেলনে চরমোনাইয়ের উগ্রবাদী, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ও মদদদাতাদের আইনের আওতায় আনা, হেযবুত তওহীদের সদস্যদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কর্মী সম্মেলন বানচালের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়সহ হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে ছয় দফা দাবি উপস্থাপন করা হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেযবুত তওহীদের বরিশাল বিভাগীয় আমির মো. আলামিন সবুজ দেশেরপত্রকে বলেন, “চরমোনাইয়ের অনুসারীদের এই অবৈধ, জবরদস্তিমূলক কার্যক্রম কোন সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া যায় না। সকালে তারা আমাদের প্রোগ্রাম পণ্ড করে দিল, আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তাদের সাথে কোন সংঘাতে গেলাম না। আমাদের নেতাকর্মীরা সবাই দলীয় কার্যালয়ে ফেরত চলে আসে। কিন্তু দিনের আলো না ফুরোতেই তারা কোন সাহসে আমাদের কার্যালয়ে হামলা চালানোর প্রয়াস করে। দেশে কি কোন আইন নেই? আমরা আইন মান্য করি বলে এটা আমাদের দুর্বলতা নয়। প্রশাসনের নিষেধ উপেক্ষা করে আমরাও অনুষ্ঠানস্থলে যেতে পারতাম। কিন্তু সেখানে রণক্ষেত্র সৃষ্টি হত। আমরা তা চাই না। বরিশাল তো আমাদেরও বাড়ি। আমাদেরও তো অধিকার আছে এখানে আন্দোলন করার, সংগঠন করার। বরিশাল তো শুধু চরমোনাইয়ের না, এটা হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিষ্টান, সরকারি দল, বিরোধী দল, বিএনপি, জামাত, আওয়ামী লীগ সবার জন্য বরিশাল। এখানে সবার অধিকার রয়েছে। আমাদেরও অধিকার রয়েছে। আমাদের ইসলাম সম্মত এবং বৈধ কার্যক্রমে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী বাধা দেবে, আমাদের সম্মেলনে হামলা করা হবে এটা তো হতে পারে না; এটা একদিকে যেমন আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড অপরদিকে ইসলামবিরোধীও। আমরা প্রশাসনের কাছে আমাদের কার্যক্রমে পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।”