মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আইএস ও জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে যে বৈশ্বিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক স্যামুয়েল পি. হান্টিংটনের ‘Clash of civilization’ তত্ত্ব। সারা পৃথিবী দাপিয়ে বেড়ানো পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতার সাথে ইসলাম বা মুসলিম সভ্যতার সংঘাত এখন স্পষ্ট। যদিও এ সংঘাত অনেক পুরোনো, তবে এতদিন তা ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল ছিল। এখন তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে উঠছে।
জঙ্গিবাদকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্যে ইসলামোফোবিয়া মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। ৯/১১ এর হামলার পর পশ্চিমা মিডিয়ায় ইসলামের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রকাশ্যে সমালোচনা হতো, ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম, সন্ত্রাসের স্রষ্টা, আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা বলে উল্লেখ করা হতো এখনকার অবস্থা অনেকটা তেমন। ইউরোপ-আমেরিকায় এমনিতেই মুসলিমদের সামাজিকভাবে হেয় করা হয়ে থাকে। আর এখন শুধু হেয় নয়, রীতিমতো তাদের নিরাপত্তার হুমকি তৈরি হয়েছে। এই সেদিনও অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবোট বললেন- ইসলামের মধ্যে মারাত্মক সমস্যা আছে।’ বিদ্বেষবশত ইসলামের মধ্যে সমস্যা দেখছেন অনেকেই। অবস্থাভেদে কেউ প্রকাশ করছেন কেউ করছেন না। যারা প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে আরেকজন হলেন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান দলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের মনোনয়নপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য প্রদান করে সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছেন। তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিমদের প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হোক।’ এখানে জেনে রাখা দরকার, তিনি এই মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য রেখেছেন নির্বাচনী প্রচারে। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সাধারণত একজন প্রার্থী কী ধরনের বক্তব্যকে প্রাধান্য দেন? অবশ্যই ওই এলাকার জনসাধারণের মানসিকতার উপযোগী বক্তব্য, যা প্রার্থীর প্রতি ভোটারদের আকৃষ্ট করবে। সে অর্থে ডোনাল্ড ট্রাম্প- এর ওই মন্তব্যকে যুক্তরাষ্ট্রের অমুসলিম সম্প্রদায়ের মুসলিমবিদ্বেষী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ বলাটাও অযৌক্তিক হয় না। বাস্তবেই তাই হয়েছে। জানা গেছে ওই মন্তব্যের পর রাতারাতি তিনি জনপ্রিয়তার নতুন মাত্রা লাভ করেছেন। এখন বলা হচ্ছে যদি তাকে রিপাবলিকান পার্টির পক্ষ থেকে মনোনয়ন না-ও দেয়া হয় তিনি স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলেও জয়ী হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি। দেশটিতে মুসলিমবিদ্বেষ কতদূর গড়িয়েছে তার নমুনা এটা। হয়তো এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব জঙ্গিবাদ দমনের অজুহাতে মুসলিম দেশগুলোকে ধ্বংস্তুপে পরিণত করার সাহস পায়। ইসলামবিদ্বেষের ফুয়েল খরচ করে চলে সাম্রাজ্যবাদের ইঞ্জিন।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এক বক্তৃতায় বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের চরমপন্থার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। আইএস চাচ্ছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে আমেরিকা ও ইসলামের মধ্যকার লড়াই হিসেবে চিত্রিত করতে। তেমনটা মনে করা অনুচিত হবে।’ প্রশ্ন হচ্ছে, বারাক ওবামার ভাষণে এ প্রসঙ্গ আসবে কেন? কেনই বা মুসলিমরা মনে করতে যাবে যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য শক্তিগুলো সন্ত্রাসের নাম করে আসলে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে? বস্তুত জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র (war on terror) নাম করে বর্তমানে যা চলছে ও অতীতে যা হয়েছে সে প্রেক্ষাপটই এমন সন্দেহের জন্ম দিয়েছে, এবং এ প্রশ্নের হালে পানি রয়েছে বলেই, প্রশ্নটি অতি বাস্তবসম্মত বলেই বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট তার সমাধান দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেছেন। সবাইকে আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু তার মনোভাব অন্তত যেটা তিনি মুখে প্রকাশ করেছেন তার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকদের কতটুকু মতের মিল আছে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ গেলো ইসলাম ও মুসলিম জাতির ব্যাপারে ইউরোপ-আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি। এবার জানা যাক মুসলিম বিশ্ব ইউরোপ-আমেরিকাকে কী দৃষ্টিতে দেখছে।
মুসলিম দেশগুলোতে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চলছে একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই। ঘটনাক্রমে তার তীব্রতা আরও বাড়ছে। ফলে বাড়ছে পশ্চিমাবিরোধী গণঅসন্তোষ। আর সে অসন্তোষের আগুনে ঘি ঢালছে জঙ্গিরা। খেলাফতের দাবিদার আই.এস পশ্চিমাদের ‘ক্রুসেডার’ আখ্যা দিয়ে তাদের ভাষায় জিহাদ ঘোষণা করেছে। তারা সারা বিশ্বের মুসলিমদের আহ্বান জানাচ্ছে আইএসের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কথিত জিহাদে শামিল হতে। ক্রুসেডারদের (পশ্চিমা খ্রিস্টানদের) হত্যা করে তারা চলতি শতাব্দীর লক্ষ লক্ষ মুসলিম নর-নারী হত্যার বদলা নিতে চায়। এসব আহ্বান শুনে মুসলিম বিশ্বের অনেক তরুণ-তরুণী ছুটে যাচ্ছে সিরিয়ায়, ইরাকে। আইএস আদতে কাদের তৈরি, কার স্বার্থ রক্ষা করছে- সেসব ভাবনা চিন্তা করারও প্রয়োজনবোধ করছে না তারা। এছাড়া প্রায় সব মুসলিম দেশেই আইএসের অনেক সমর্থক আছে যারা বিভিন্ন বাধা-প্রতিবন্ধকতার কারণে কথিত জিহাদে শামিল হতে পারছে না হয়তো, তবে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে জিহাদে ভবিষ্যতে সম্পৃক্ত হবে এ বাসনা বুকে ধরে আছে।
ইরাক আগ্রাসনের পূর্বে জর্জ বুশের মুখে উচ্চারিত ‘ক্রুসেড’ শব্দটা কিন্তু আজও ১৬০ কোটি মুসলমানের কানে বাজে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ক্রুসেড হয় না, যুদ্ধ হয়। ক্রুসেড হয় ইসলামের বিরুদ্ধে বা মুসলিমদের বিরুদ্ধে। কার্যত ইরাক হামলার পরিণতির দিকে তাকালে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ওই হামলায় সন্ত্রাসের ক্ষতি হয় নি, হয়েছে মুসলিমদের, ইসলামের। অর্থাৎ সেটা আদতেই ক্রুসেড ছিল। আফগানিস্তান হামলার সময় ক্রুসেডের ঘোষণা দেওয়া হয় নি, কিন্তু সেখানেও যা ঘটেছে এবং ওই হামলার পরিণতি যেখানে দাড়িয়েছে তার ধকল সহ্য করতে হচ্ছে মুসলিমদেরকেই। তালেবান-আল কায়েদার একটা পশমও ছিড়তে পারে নি কেউ। একইভাবে লিবিয়ায় মানবাধিকারের ধুয়া তুলে বিমান হামলা চালিয়ে একটা প্রতিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করা হলো। এখন দেশটিতে বলতে গেলে কোনো সরকার নেই, কর্তৃপক্ষ নেই, বিস্তৃত এলাকা দখলে রেখেছে জঙ্গিরা। আর তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে তেল কিনছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো। পশ্চিমারাও সেখানে নিজেদের স্বার্থ ঠিক খুঁজে নিয়েছে। অথচ এখন তাদের মিডিয়ায় খবর বেরোয়- গাদ্দাফি ছিল আফ্রিকার ত্রাতা। এর চেয়ে হাস্যকর আর কী হতে পারে। লিবিয়ার অধিবাসীরা জেনেছে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ কী জিনিস। ইরাক-সিরিয়ার আজকের পরিণতির জন্য, আইএসের উত্থানের জন্য কারা দায়ী? আর তার পরিণতি ভোগ করছে কারা? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে মুসলিম বিশ্ব।
একদিকে আইএসের বর্বরতা, অন্যদিকে পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ- উভয়ে মিলে যে নরকরাজ্য তৈরি করেছে ইরাক-সিরিয়ায়, তা থেকে পালিয়ে মুসলিমরা যখন ইউরোপে বা আমেরিকায় আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন মানবতাবাদীদের ঘুম হারাম হবার উপক্রম হয়েছে। গণতন্ত্রের প্রবক্তরা, অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা দাবি তুলছেন- নিরাপত্তার কারণে মুসলিম প্রবেশ নিষিদ্ধ হোক।
ক্রুসেডের নামে ইউরোপীয় মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মব্যবসায়ীদের চালানো দুইশ’ বছরের অযাচিত যুদ্ধের ইতিহাস মুসলিমরা ভুলে যায় নি। ইউরোপের বর্তমান মুসলিমবিরোধী রাষ্ট্রীয় নীতিমালা, দুঃসহ সামাজিক বৈষম্য বা বর্ণবাদ, ইসলামবিদ্বেষী অবাধ সাহিত্য-ম্যাগাজিন, কার্টুন, মুভি ইত্যাদি ইউরোপ-আমেরিকার মুসলিমবিদ্বেষের প্রতীক হয়ে আছে এখনও। এসব করা হচ্ছে মুসলিমদের বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নয়। ফলে মুসলিম বিশ্বের যারা আইএসের কাছে যাচ্ছে তারা তো যাচ্ছেই, যারা আইএসকে সমর্থন করে না, তারাও যে পশ্চিমাদের ভালো দৃষ্টিতে দেখছে তা কিন্তু নয়। পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে তাদেরও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কম নয়।
এভাবে ইউরোপ-আমেরিকার ভুল পররাষ্ট্রনীতি, আধিপত্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, পরিকল্পিতভাবে জঙ্গিবাদের উত্থান ও প্রসার ঘটানো এবং মুসলিম বিশ্বের ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করার ব্যর্থতা যে পরিণতির দিকে গড়াচ্ছে তাকে ‘সভ্যতার সংঘাত’ (Clash of civilization) হিসেবে চিহ্নিত করাটা অসমীচীন হবে কি?