বর্তমানে আমরা এক ভয়াবহ দুঃসময় অতিক্রম করছি। সামাজিক অন্যায়, নেতৃবৃন্দের অসততা, অঙ্গীকারভঙ্গ, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, হানাহানি ইত্যাদির মধ্যে মানবজাতি নিমজ্জিত হয়ে আছে। আমরা মনে করি এই অবস্থাটি সৃষ্টির পেছনে কেবল কোন একক ব্যক্তি বা দল দায়ী নয়, প্রধানত দায়ী হচ্ছে আমাদের সিস্টেম বা জীবনব্যবস্থা। সেটা কিভাবে?
আল্লাহর রসুল বলেন, প্রত্যেক মানবশিশু জন্ম নেয় ফেতরাতের (প্রকৃতির) উপর, অতঃপর তার বাবা-মা তাকে ইহুদী, খ্রিষ্টান অথবা যরোথুস্ট্রিয়ান (অগ্নিপূজক) বানিয়ে ফেলে [আবু হোরায়রা রা. থেকে বোখারী]। পরিবার একটি সিস্টেম। এই সিস্টেমের প্রভাবে পরিবার থেকে যেভাবে মানুষের ধর্মনির্ধারণ হয়, ঠিক তেমনি সমাজব্যবস্থাও মানুষকে নিজস্ব কাঠামো অনুযায়ী গড়ে তোলে। সমাজব্যবস্থা যদি বস্তুবাদী, ভোগবাদী হয়, মানুষও হবে বস্তুবাদী ও ভোগবাদী, সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, মানুষগুলিও ধীরে ধীরে হবে দুর্নীতিগ্রস্থ। পক্ষন্তরে সমাজব্যবস্থা যদি ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে, মানুষগুলিও হবে ন্যায়নিষ্ঠ। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কাদা মাটির ন্যায়। এই কাদামাটিকে যে ডাইসের (Mould, ছাঁচ) মধ্যে ফেলা হবে, কাদামাটি সেই ডাইসের রূপ, আকৃতি ধারণ করবে। সমাজব্যবস্থাও এমনই একটি ছাঁচ বা ডাইস। কখনও কোন মানুষ মায়ের গর্ভ থেকে চোর হয়ে, ডাকাত হয়ে, অন্যায়কারী, দুর্নীতিবাজ হয়ে জন্ম নেয় না। কিন্তু অন্যায় সমাজব্যবস্থার প্রভাবে ধীরে ধীরে তারা এমন অপরাধী চরিত্রের হয়ে যায়। যারা আইন শৃঙ্খলা বাহিনীতে চাকরি করতে যান তাদের অনেকেই এই অভিপ্রায় নিয়ে যান না যে ইচ্ছা মতো ঘুষ খাবেন, বরং সৎ জীবনযাপনের ইচ্ছা নিয়েই যান চাকুরিতে। কিন্তু সিস্টেমই তাদের অধিকাংশকে ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, অসৎ বানিয়ে ফেলে। তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হন যে অসৎ না হয়ে তাদের কোন উপায় থাকে না।
যারা ব্যবসা করতে যান তারা অনেকেই হয়তো এই নিয়তে যান না যে তিনি মাপে কম দিবেন, ভেজাল মেশাবেন; কিন্তু এক সময় তাকে বাজারে টিকে থাকার জন্য অন্যদের মতই সততা বিসর্জন দিতে হয়। রাজনীতিতে যারা যান তারাও হয়তো এই মানসিকতা নিয়ে যান না যে দুর্নীতি হলো, সন্ত্রাসী লালন হলো, জনগণের সম্পদ লুট হলো, বিদেশে টাকা পাচার হলো। এমন কি অনেকের হয়তো জনসেবা করার ইচ্ছাও থাকে কিন্তু পরে তাদের কী অবস্থা হয় সেটা সকলেরই জানা। প্রশ্ন হলো, কেন মানুষগুলো ধীরে ধীরে তার নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে ফেলে? কেন তারা সততা হারিয়ে দুর্নীতিবাজ, ওয়াদা খেলাফকারী হয়ে যায়, সন্ত্রাসী, মিথ্যাবাদী, মানুষের সম্পদ লুণ্ঠনকারী হয়ে যায়?
যে দেশের ছাত্ররা শিক্ষাগুরুর পায়ে হাত দিয়ে আশীর্বাদ নিত, শ্রদ্ধা জানাতো, শিক্ষককে পিতৃতুল্য জ্ঞান করত, সেই দেশের ছাত্ররাই এখন কেন শিক্ষককে আটক করে রাখে, মারধোর করে? যে ছাত্রদের শিক্ষা অর্জন করে মানবসেবার জন্য আত্মনিয়োগ করার কথা, সেই ছাত্ররা কেন টেন্ডারবাজী করে, সন্ত্রাসী করে, বোমাবাজি করে, ক্যাম্পাসের আধিপত্য নিয়ে পরস্পরকে খুন করে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সন্ত্রাসী হিসাবে ভাড়া খাটে? এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে, সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। সমাজের প্রচলিত সিস্টেমই তাদেরকে এমন বানায়। কোন চালক যদি চেষ্টা করে একটা গাড়িকে সোজা চালাতে, কিন্তু রাস্তাটা যদি বাঁকা হয় তবে সে শত ইচ্ছা করেও সোজা চালাতে পারবে না। চালাতে গেলে সে রাস্তা থেকে ছিটকে পড়ে যাবে। একইভাবে যদি রাস্তা সোজা থাকে তাহলে সে চাইলেও আঁকা-বাঁকা হয়ে চলতে পারবে না, রাস্তাই তাকে সোজা চলতে বাধ্য করবে।
এই রাস্তা হচ্ছে একটি সিস্টেম যা মানুষের জীবনের সমস্ত আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রভাবিত করে। সমাজের অধিকাংশ মানুষই হয়তো অন্যায় করতে চায় না। কিন্তু সিস্টেমের কারণে তারা অন্যায় করতে বাধ্য হচ্ছে। আপনি শত চাইলেও ভালো থাকতে বা ভালো করতে পারবেন না। সিস্টেমের যাঁতাকলে পড়ে আপনার চরিত্রের সব সৎগুণাবলী ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাবে, অন্যায়ের সাথে আপস করতে করতে একসময় ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ডই অস্বীকার করবেন।
হ্যাঁ, মানুষ আন্তরিকভাবে চাচ্ছে শান্তি আসুক; কেবল চাচ্ছেই না, তারা প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে আপ্রাণ চেষ্টা করছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সারা পৃথিবীতে, মসজিদে, মন্দিরে, চার্চে, সিনাগগে ধার্মিক লোকেরা প্রার্থনা করে যাচ্ছেন। শান্তির জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা হয়েছে, বিভিন্ন জাতীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠিত হয়েছে, নতুন নতুন নামে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৈরি করা হয়েছে, তাদেরকে আধুনিক অস্ত্র-শস্ত্রে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। অনেক সময় দেখা যায় এসব বাহিনীর সদস্যগণ সারারাত দায়িত্ব পালন করেন, গাড়িতে ঘুমান। কিন্তু তবুও আইন-শৃঙ্খলার দিন দিন অবনতিই হচ্ছে। অন্যায় অবিচার দিনকে দিন বাড়ছে। অপরদিকে রাজনৈতিক দলগুলি শান্তি প্র্রতিষ্ঠার শপথ নিচ্ছে। তারা নিশ্চয়ই চায় না যে দেশের মানুষ অশান্তিতে থাকুক, ভেজাল খাক, খাবারের সাথে বিষ খাক, জনগণের সম্পত্তি চুরি ডাকাতি হোক, মানুষ খুন হোক, ডোবা নালায় তাদের লাশ পড়ে থাকুক। হয়তো কোন সরকারই চায় না এসব ঘটুক। তা সত্ত্বেও এগুলিই ঘটে। আর এই অন্যায়গুলি হচ্ছে সিস্টেমের কারণে।
এ কেমন সমাজ ব্যবস্থা আমরা কায়েম করলাম যেখানে কৃষক কষ্ট করে ফসল ফলায় কিন্তু সিস্টেমের মারপ্যাঁচে পড়ে ন্যায্যমূল্য পায় না, অন্যদিকে মধ্যস্বত্বভোগীরা দিনকেদিন ফুলেফেঁপে ওঠে? অতি কষ্ট করে কয়েকশ টাকা রোজগার করলেন, পটেকমার পকেট কেটে নিয়ে যেতে পারে। যখন তখন ছিনতাই-রাহাজানি হতে পারে। শেয়ার বাজারে টাকা খাটালেন? যখন তখন গায়েব হয়ে যেতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দিলেন, বিভিন্ন কায়েদার চাঁদাবাজ এসে মূলধন গায়েব করে দিল। অসুখ হলে যে ঔষধ খাবেন সেটাও ভেজাল। নিজের পাওনা পেনশন আনতে যাবেন অফিসে, ঘুষ না দিলে পেনশন বন্ধ। দোকান থেকে এক কেজি গোশত কিনে বাসায় এনে দেখবেন দুইশ গ্রাম নেই অথবা পানি দিয়ে ওজন বাড়ানো হয়েছে। মাছ, তরকারি, আম, কাঁঠাল, কমলা যা খাবেন সবকিছুতেই বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অবিরাম মূল্যবৃদ্ধি মানুষের সহ্যসীমাকে অতিক্রম করে যাচ্ছে। টিভি খুলবেন, কিন্তু সপরিবারে দেখা যাচ্ছে না। অশ্লীল দৃশ্য দেখে দেখে সঠিক বয়সের আগেই দূষিত হয়ে যাচ্ছে শিশুদের নির্মল শৈশব। ছেলে-মেয়েদেরকে যতই লেখা পড়া শেখাচ্ছেন ততই যেন তারা অবাধ্য, আদব-কায়দাহীন, আন্তরিকতাহীন, মেকি আচরণে পারদর্শী হয়ে যাচ্ছে। মেয়েকে পাঠিয়েছেন শিক্ষকের কাছে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কে জানে তার কি পরিণতি হয়। এভাবে ক্রমাগত আতংক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আর কতকাল বসবাস করতে হবে?
এই অবস্থার জন্য কাকে দোষ দেবেন – সরকারকে? আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে? রাজনীতিকদের? ব্যবসায়ীদের? শ্রমিকদের? ছাত্রদের? গণমাধ্যম কর্মীদের? সবার সঙ্গে কথা বলেন, দেখবেন সকলের এক উত্তর- ‘কি করবো ভাই, আমরা তো পরিস্থিতির শিকার!’ হ্যাঁ, দায়ী আমরা সবাই। একদিনে হঠাৎ করে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় নি। আমরা যখন ব্রিটিশ খ্রিষ্টানদের গোলাম ছিলাম তখন থেকেই তারা আমাদের উপর আত্মাহীন, স্রষ্টাহীন বস্তুবাদী এক সিস্টেম চাপিয়ে দিয়েছে। ভৌগোলিকভাবে বর্তমানে স্বাধীন হলেও অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও মানসিকভাবে এখনও তারাই আমাদের প্রভু। সেই থেকে আজও তাদের দেওয়া সিস্টেমে আমাদের সবকিছু চলছে। এই সিস্টেমে বাস করে কেউ ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভাল হতে পারবে না; কোনভাবে আইন শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো যাবে না; ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট ইত্যাদি ঠেকানো যাবে না। বরং দিন দিন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ ও জটিল আকার ধারণ করবে, এটা জেনে বুঝেও উটপাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে পরিণতি অস্বীকার করার চেষ্টা করছি, আত্মকেন্দ্রিক জীবনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য ছুটে বেড়াচ্ছি। সমাজব্যবস্থা বা সিস্টেম পরিবর্তনের জন্য ভাবছি না। অনেকেই গালভরা আশার বাণী শোনাচ্ছেন, কিন্তু কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোনোকালে সমাজ পরিবর্তন হয় নি, হবেও না।
প্রচলিত সিস্টেম অনুসরণ করে হরতাল, অবরোধ, ঘেরাও, বিক্ষোভ, অনশন ইত্যাদি করা হয় ন্যায্য অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য। ঐ সমস্ত করে কবে কতটুকু দাবি আদায় হয় তা সকলেরই জানা, এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সৃষ্টি হয় সহিংসতা, দাঙ্গা, হাঙ্গামা, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও, অগ্নিসংযোগ, দিনশেষে আহত এতজন, নিহত এতজন–এই হলো তাৎক্ষণিক ফল; আর সুদূরপ্রসারী ফল হচ্ছে জাতির মধ্যে অনৈক্য, অসন্তোষ, বিদ্বেষ, শত্রুতা, বিশৃঙ্খলা- এক কথায় ভয়াবহ বিভীষিকা।
একদলের উপর অসন্তোষ হয়ে অন্যদলের ভোটের বাক্স ভরে দিচ্ছে জনতা, যাদেরকে নির্বাচিত করলো তারাও পরীক্ষিত দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাস লালনকারী, বিদেশে অর্থপাচারকারী, ওয়াদাভঙ্গকারী। যাদেরকে পরাজিত করলো তারাও এদেরই মতো। এই ক্ষমতার লড়াইতে কত প্রাণ গেল, কত রক্ত ঝরল, কত গাড়ি-বাড়ি পুড়লো, কত মানুষ পঙ্গু হলো, কতজন অন্যায়ভাবে জেলে পচলো। এসব করে সাধারণ মানুষ কি পেল? এ যেন বাঁচার জন্য কড়াই থেকে লাফ দিয়ে চুলোয় পড়া, আর চুলো থেকে উঠে আবার কড়াইতে পড়া। এই যে নির্বাচনের নামে, গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার লোফালুফি (Power Game), এ থেকে কি আমরা বেরিয়ে আসতে পারি না? সকলকে বোঝা উচিত গণতন্ত্রের নামে এক বিষাক্ত, জীবনঘাতি সিস্টেম আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে সিস্টেমে একজন সৎ, যোগ্য, প্রকৃত ওয়াদা রক্ষাকারী, আমানতদার, নিঃস্বার্থ মানবপ্রেমী কখনোই উঠে আসতে পারবে না; এই সিস্টেমে যে যত বেশি অন্যের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে পারে, মিথ্যা বলতে পারে, কালো টাকা ছড়াতে পারে, পেশীশক্তি ব্যবহার করতে পারে সেই জয়ী হয়; সে যত বড় দুর্নীতিবাজ, মিথ্যাবাদী, ওয়াদা খেলাফকারী, দেশের সম্পদ লুন্ঠনকারী, সন্ত্রাস লালনকারী হোক না কেন কোন অসুবিধা নাই।
প্রচলিত পদ্ধতির নির্বাচনে প্রথমে একজন টাকা দিয়ে মনোনয়ন পত্র কিনে প্রার্থী হয়, নিজের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপায়, নিজের গুণগান নিজেই প্রচার করে, মিছিল করে, ব্যানার টানায়, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়, মানুষকে তার পক্ষে নেয়ার জন্য বিভিন্ন প্রলোভন দেখায়, প্রয়োজনে প্রতিপক্ষকে খুন করার দৃষ্টান্তও বিরল নয়। নিয়মিত শান্তিÍÍ-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তো আছেই, নির্বাচনের কেন্দ্র এবং ভোটের বাক্স পাহারা দেওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীও মোতায়েন করতে হয়। পাহারা উঠিয়ে নিলেই বোঝা যায় কে কতটা সভ্য। তখন বোমা মেরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোটকেন্দ্র দখল, ভোটবাক্স লুট ইত্যাদি অনেক কিছুই ঘটে। গ্রাম্য মেম্বার থেকে শুর করে যে কোন পর্যায়ের নির্বাচনেই এসব ঘটনা ঘোটে থাকে। এটাই নেতা নির্বাচনের বর্তমান সিস্টেম, সারা দুনিয়াতে এই সিস্টেম প্রায় একই রকম, শুধু কোথাও সহিংসতা কম, কোথাও বেশি। যারা নেতা নির্বাচিত হন তাদের ১০০% ই খারাপ তা অবশ্য নয়, কিছু কিছু ভাল মানুষও যদি কালে ভদ্রে নেতা হন, তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। আর তারাও বেশিদিন তাদের সততা ধরে রাখতে পারেন না; সিস্টেমটাই এমনভাবে তৈরি যে, কেউ ভালো থাকতে চাইলেই ভালো থাকতে পারেন না।
সর্বোপরি প্রশ্ন হলো- এই সব করে কী পেয়েছে জনতা? সেই তো অবহেলা, বঞ্চনা, দুর্ভোগ দিনকে দিন আরও বাড়ছে। এই জীবন ব্যবস্থা বা সিস্টেম এর মধ্যে যতদিন থাকবেন ততোদিন কোনো মুক্তি নাই।
আমাদের সমাজে একটি কথা চালু আছে, “আগে নিজে ভালো হন, তারপর দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে”। এই কথাটি সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কারণ একটি জীবনব্যবস্থায় মানুষের সামষ্টিক জীবনের গুরুত্ব সর্বাধিক। ব্যক্তি কখনও সামষ্টিক সিস্টেমের বিরদ্ধে পথ চলতে পারে না। জাতীয় ও সামষ্টিক জীবনের চাপে ব্যক্তি তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলে। বিশাল এক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তি যমুনা নদীর তুলনায় এক টুকরো শোলার মতো। সমাজব্যবস্থা, রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়, সেটা দ্বারা ব্যক্তিও কমবেশি প্রভাবিত হতে বাধ্য। কাজেই জাতীয়ভাবে আজ আমাদের এমন একটি সিস্টেম দরকার যেখানে শত চেষ্টা করেও কেউ ঘুষ খেতে পারবে না, অন্যায় করতে পারবে না, ওয়াদা খেলাফ করতে পারবে না; কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় ঘুমাবে এমন অবিচার সৃষ্টি হওয়ার কোন সম্ভাবনাও যেখানে থাকবে না। এজন্য আমাদের এই সিস্টেমকে পাল্টাতে হবে।
প্রশ্ন হলো, এমন সিস্টেম কোথায় পাওয়া যাবে? এর উত্তর হলো, স্রষ্টা আল্লাহর দেওয়া দীনুল হক, সত্য জীবনব্যবস্থাই হচ্ছে সেই সিস্টেম। মানুষ নামক এই প্রাণী সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ, কাজেই কোন রাস্তায় বা সিস্টেম-এ সে সুখে থাকবে সেটা ভালো জানেন মহান আল্লাহ। আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমই হচ্ছে সরল পথ, কাজেই এর নামই আল্লাহ রেখেছেন সেরাতুল মোস্তাকিম বা সহজ-সরল পথ।
আল্লাহর অসীম দয়ায় সেই প্রকৃত, অবিকৃত ইসলামের জ্ঞান, আকিদা (Comprehensive Concept) আবার হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমাম, এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি প্রকৃত ইসলামের যে রূপরেখা অঙ্কন করে গেছেন, আমরা যদি সে মোতাবেক আমাদের জীবন পরিচালিত করি, আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সমষ্টিগত জীবনে পরিপূর্ণ শান্তিতে, প্রগতিতে বাস করতে পারব। তবে এখানে মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে তওহীদ ও জেহাদ-বিহীন, শুধুই ব্যক্তিগত কিছু আমলসর্বস্ব বিকৃত বিপরীতমুখী যে ইসলামটা দুনিয়াতে চালু আছে আমরা সেই ইসলামের কথা বলছি না। আল্লাহর দেওয়া প্রকৃত ইসলাম মহানবী যেভাবে পৃথিবীতে রেখে গিয়েছিলেন সেটি গত ১৩০০ বছরের কালপরিক্রমায় বিকৃত হতে হতে বর্তমানে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। তথাকথিত আলেম শ্রেণি এই বিকৃত ইসলামটিকে তাদের রুটি-রুজির মাধ্যম বানিয়ে নিয়েছে। একদা লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, অখণ্ড উম্মতে মোহাম্মদী আজ ফেরকা, মাজহাব, মাসলা মাসায়েল ইত্যাদির কূটতর্ক নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, হানাহানিতে লিপ্ত হয়ে হাজারো ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে; আরেকটি অংশ ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে মানুষকে ইসলামের বিষয়ে বীতশ্রদ্ধ ও উদাসীন করে তুলেছে। জাতির বৃহত্তম অংশটি শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ঐ বিকৃত ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে। এর কোনটাই আল্লাহ, রসুলের প্রকৃত ইসলাম নয়। কেননা ইসলাম শব্দের আক্ষরিক অর্থই শান্তি। অর্থাৎ যারা ইসলামের অনুসারী হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা শান্তিতে থাকবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা ঠিক এর বিপরীত। আমরা হেযবুত তওহীদ আল্লাহর রহমে সেই প্রকৃত ইসলাম মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন রকম জীবনব্যবস্থা একটা একটা করে প্রয়োগ করে দেখা হয়েছে। রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়ে গেছে। দুনিয়াতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এর প্রত্যেকটাই ব্যর্থ হয়েছে। এখন অধিকাংশ রাষ্ট্রে ধনতান্ত্রিক গণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। এর ফলও আমরা দেখছি। পৃথিবী বর্তমানে গত এক বা দুই শতাব্দী আগের চেয়ে অনেক বেশি অন্যায় এবং অবিচারে পূর্ণ। গরীব ও ধনীর ব্যবধান অনেক বেশি প্রকট। মানুষে মানুষে সংঘর্ষ ও রক্তপাত বহুগুণে বেশি। গত এক শতাব্দীতেই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ করে কোটি কোটি লোক হতাহত হয়েছে। এই নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকের একটি দিনও যায় নাই যেদিন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও যুদ্ধ, রক্তপাত চলে নাই।
শান্তিময় ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হচ্ছে জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা। তারপর ক্রমান্বয়ে আসে অর্থনৈতিক সুবিচার, রাজনৈতিক, সামাজিক ইত্যাদি সুবিচার। আল্লাহর সত্যদীন মানুষকে ১৪০০ বছর আগে এই প্রতিটি ক্ষেত্রে চূড়ান্ত শান্তি ও ন্যায়ের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল এবং কেয়ামত পর্যন্ত একইরূপ সমাজ উপহার দিতে সক্ষম। মানব জাতির এই সঙ্কটকালে আমরা হেযবুত তওহীদ এই ডাক দিচ্ছি যে, সবগুলি জীবনব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার পর স্রষ্টার দেওয়া জীবন বিধান মেনে নেওয়া ছাড়া শান্তি নিরাপত্তার আর কোন পথ নেই।