মো. মশিউর রহমান
মানুষের সমাজটি এক অর্থে মানবদেহের মতোই। দেহ যেমন রোগাক্রান্ত হলে যথাসময়ে চিকিৎসা করতে হয় তেমনি সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের মধ্যেও নানাবিধ সমস্যা রোগের মতোই কুপ্রভাব বিস্তার করে। সেই সমস্যাকে বয়ে না বেড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়। কোনো ওষুধে যদি মানুষের অসুখ ভালো না হয় তখন ওষুধ পরিবর্তন করতে হয়। অকার্যকর ওষুধ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ চিকিৎসক বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেন না, কারণ তাতে রোগীর জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। মানবসমাজের ক্ষেত্রেও তেমনিভাবে একটি সমস্যার সমাধান করার জন্য একটার পর একটা উপায় গ্রহণ করতে হয়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়।
কিন্তু আমাদের সমাজব্যবস্থার দিকে দৃষ্টিপাত করলে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা এমন একটি জীবনব্যবস্থার চর্চা করে যাচ্ছি যুগ যুগ ধরে যা আমাদেরকে একদিনের জন্যও শান্তি দিতে পারেনি। তথাপিও আমরা অথর্বের মতো সেই অকার্যকর জীবনব্যবস্থারই চর্চা চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে আমরা একেবারে ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি, তবু একে পরিবর্তন করার কথা ভাবছি না। একটি জীবনব্যবস্থা শান্তি দিতে সক্ষম কি অক্ষম সেটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যবেক্ষণ তো কম হয়নি! আর কতদিন পরীক্ষা চালানো দরকার?
আমাদের সামনে আবারও জাতীয় সংসদ নির্বাচন। হয়তো কোনো একক দল ক্ষমতায় আসবে, অথবা জোটবদ্ধ দল আসবে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, কেউ কি হলফ করে বলতে পারবেন, যারা ক্ষমতায় আসবে তারা নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে দেশ পরিচালনা করতে পারবে, আর কোনো হরতাল, অবরোধ, জ্বালাও পোড়াও ভাঙচুর হবে না, পেট্রোল বোমা মারা হবে না, মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করা হবে না, দ্রব্যমূল্য গরিব মানুষের নাগালের মধ্যে আসবে, সন্ত্রাস কমবে, মিথ্যা মামলা কমবে, দুর্নীতি কমবে, আর কেউ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে না, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ভিন্ন রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করবে না, আরো কমে যাবে শূণ্যের কোঠায় চলে আসবে? কেউ এই কথাগুলো হলফ করে বলতে পারবে না যে, তারা ক্ষমতায় আসলে কেউ আর বিদেশে অর্থপাচার করবে না, চারদিকে শান্তির ফল্গুধারা বইবে, মানুষ গান গাইবে- আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে? এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। বরং সবাই জানে ও বিশ্বাস করে, যে দলই ক্ষমতায় আসুক, পরিস্থিতি একটুও পাল্টাবে না। বস্তুগত উন্নতি করা হলেও সর্বরকম অপরাধ, লুটপাট, দমন-পীড়ন, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির চর্চা বরাবর যেমন হয় তেমনই হবে। আমাদের বিগত অভিজ্ঞতা এমনই, শাসক পাল্টায় কিন্তু দিন পাল্টায় না। তাহলে নির্বাচন নিয়ে এত হুলুস্থুলের তাৎপর্য কী? তাৎপর্য হলো- গণতন্ত্র এখন একটি বাণিজ্যিক সূত্র। নির্বাচন হলো নেতানেত্রীদের বাণিজ্যের মৌসুম। জনগণ এখানে দর্শকমাত্র। তাদেরকে পুতুলনাচ নাচিয়ে ফায়দা লুটছে রাজনৈতিক মহল। এই হলো সরল অঙ্ক। সর্বসুখের গণতন্ত্র কেতাবেই আছে, গোয়ালে নাই। যারা গণতন্ত্রের ফেরিওয়ালা সেই পশ্চিমারা বহু আগেই পেশীতন্ত্র মেনে নিয়েছে। যার সামরিক শক্তি, অর্থনৈতিক শক্তি বেশি সেই বিশ্বের মোড়ল। এর উদাহরণ ইরাক হামলার সময় ভেটো ক্ষমতার অধিকারী চারটি পরাশক্তিধর দেশ এই হামলার বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু কেবল যুক্তরাষ্ট্র একাই নিজ সিদ্ধান্তে মিত্রদের নিয়ে হামলা চালিয়ে দশ লাখ মানুষসহ ইরাক ধ্বংস করে দিয়েছে। কোথায় রইল সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের গণতন্ত্র?
এই মুহূর্তে সবার ভিতরে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে অনেকরকম আশঙ্কা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। যার কারণ বিগত দশ বছরে বাংলাদেশের ব্যাপক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। হুজুগপ্রবণ ধর্মীয় দলগুলো একটি বড় নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে এই নির্বাচনে। আমাদের কথা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মধ্যে যদি মিল না থাকে তাহলে ইসলামের পরিভাষায় আমরা হবো মোনাফেক, সাধারণ অর্থে ভণ্ড, কপট, বিশ্বাসঘাতক, বেঈমান। আর মোনাফেকের স্থান জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে। আমরা সংবিধানে লিখেছি যে, আমরা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখি। এই পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের মানে কী? এ কথাটার মনে হচ্ছে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করতে পেরেছেন, প্রতিকূল পরিবেশে বাঁচিয়ে রেখেছেন, প্রতিনিয়ত আলো বাতাস পানি সরবরাহ করে যাচ্ছেন, যাঁর হুকুমে গোটা সৃষ্টিজগৎ আমার সেবায় নিয়োজিত হয়ে আছে সেই তিনিই আমার চাইতে ভালো জানেন আমি কীভাবে ভালো থাকব, কোন পথে চললে শান্তি-সুখ লাভ করব, আমার আত্মিক প্রশান্তি যেমন থাকবে তেমিন থাকবে আর্থিক স্বচ্ছলতা ও সুবিচার। তিনিই ভালো জানবেন কী করে আমার সমাজ থেকে রাজনৈতিক সংকট দূর হবে, কোন আইন-কানুন-দণ্ডবিধি আমার সমাজের সঙ্গে খাপ খায়, আমাদের যুদ্ধনীতি, বাণিজ্যনীতি কী হওয়া উচিত এক কথায় মানবজীবনের সর্বাঙ্গনে যা লাগবে তার সবকিছুরই সঠিক সমাধানও তিনি দিতে পারেন। এবং তিনি তা দিয়েছেন। তিনি আমাদের পুর্ণাঙ্গ জীবনবিধানদাতা বা এলাহ। তিনি যেমন খালেক হিসাবে আমাদেরকে সৃষ্টি করতে পেরেছেন, রাজ্জাক হিসাবে আমাদের প্রয়োজন পুরণ করে চলেছেন তেমনি তিনি এলাহ হিসাবে আমাদের সার্বভৌমত্বের মালিক হওয়ার একমাত্র অধিকারী। তিনি আমাদেরকে সর্ববিষয়ে হুকুম দিতে পারেন। এই যে বিশ্বাসটাই হলো সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা। এর বাইরে আস্থা বলতে আর কী বোঝায় আমার জানা নেই, কারো জানা থাকলে বলতে পারেন।
আমরা আল্লাহর উপর অন্তরে ও মুখে বিশ্বাস লালন করেই তাঁর নির্দেশ মেনে নামাজ পড়ি, রোজা রাখি, হজ করি। কিন্তু আমরাই আবার সম্পূর্ণ স্থির মস্তিষ্কে, সুচিন্তিতভাবে জাতীয় জীবনসংক্রান্ত তাঁর সমস্ত বিধানাবলিকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা ভুলে গেছি, আল্লাহর হুকুম অমান্য করার কারণে অর্থাৎ আমাদের কর্মফলে চারশত বছর আগে আমরা ইউরোপের খ্রিষ্টান জাতিগুলোর গোলামে পরিণত হয়েছিলাম। তারা আমাদেরকে এমন শোষণ করেছে আর নির্যাতন চালিয়েছে, লক্ষ লক্ষ নারিদেরকে বেশ্যালয়ে বিক্রি করেছে, লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে গুলি করে, বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে যা মানব ইতিহাসে অদ্বিতীয়। তারপর তাদেরও পতন ঘটল দুটো বিশ্বযুদ্ধের মাধ্যমে। বিশ্বযুদ্ধগুলো করে তারা একদিকে যেমন দুর্বল হয়ে পড়েছিল, অপরদিকে দীর্ঘদিন তাদের পদানত থেকে আমাদের জাতির মধ্যে থেকে মুক্তির আন্দোলনও বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। সব মিলিয়ে তারা দেখল যে, এত বড় ভূখণ্ড সরাসরি শাসন করার অবস্থা তাদের নেই। তারচেয়ে ভালো হয় এদেশীয় তাবেদার একটি শ্রেণির হাতে দেশচালনার ক্ষমতা হস্তান্তর করে দূরে বসে কলকাঠি নাড়া। এই ভেবে তারা নামেমাত্র স্বাধীনতা দিয়ে যার যার দেশে ফিরে গেল, যাওয়ার সময় তাদের তৈরি পুঁজিবাদী সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা এদেশে চালু করে রেখে গেল। আমরও প্রভুভক্ত জাতি। তাদের এই পুঁজিবাদকে পরিবর্তন করার কথা মাথায়ও এলো না একবার। এ যুগে নাকি পুঁজিবাদ ছাড়া চলাই যাবে না। এর ফল কী হলো? দিনে দিনে অর্থ ও সম্পদ পুঞ্জিভূত হয়ে উঠল একটি শ্রেণির হাতে, যারা কল্পনার চেয়েও বেশি ধনী হয়ে উঠল। অপরদিকে অধিকাংশ মানুষ কেবল মৌলিক চাহিদা যেমন বাড়িভাড়া আর খোরাকি যোগাড় করতে করতে দিশেহারা। যে ফসল কৃষক বিক্রি করছে পাঁচ টাকায়, সেই ফসল পঞ্চাশ টাকার নিচে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। পঁয়তাল্লিশ টাকা চলে যাচ্ছে পুঁজিপতিদের পেটে। ওদিকে কৃষক চড়াসুদে ঋণ নিয়ে পূর্বের ঋণ পরিশোধ করছে। ছোট্ট একটা দেশ বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরে আমরা বিদেশের কাছে ৬৫০ লক্ষ কোটি টাকা ঋণী। এই অর্থ কে শোধ করবে, কবে শোধ করবে তা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এই বছরই আমাদেরকে ৫০ হাজার কোটি টাকা কেবল সুদ দিতে হবে বিদেশি মহাজনদেরকে। ২০ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ভারতের সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল প্রকাশ কাতোচের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে তিনি বলেছেন, “আঞ্চলিক পরাশক্তি চীন অলক্ষে অথচ দৃঢ়ভাবে ঋণের জালে জড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে এবং দেশগুলোর কিছুই বলার থাকছে না। যেমন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শ্রীলঙ্কায় আট বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন এবং এই ঋণ পরিশোধ করা শ্রীলঙ্কার জন্য একেবারেই অসম্ভব। এখন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবসৃষ্টির অভিপ্রায় নিয়ে চীন যদি শ্রীলঙ্কাকে নিজেদের চাহিদামাফিক ব্যবহার করতে চায় তাহলে এই দ্বীপরাষ্ট্রটির চীনের দাবার ঘুঁটিতে পরিণত হতে হবে।” ভূরাজনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানও খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরাও গার্মেন্টসহ বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগ, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের দিক থেকে চীনের উপর নির্ভরশীল। সুতরাং আমাদেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
প্রাক্তন প্রভুদের রেখে যাওয়া বিচারব্যবস্থার সমস্তকিছুই আমরা টেনে চলেছি। শাসকের শাসনের চেয়ে দাসের শাসন ভয়ানক, যার নমুনা আমরা পদে পদে টের পাচ্ছি। অবদমন থেকে প্রাপ্ত জ্বি হুজুর চরিত্র, স্বার্থপরতা, দেশপ্রেমহীনতা, পূর্বপুরুষের দারিদ্র ইত্যাদি আমাদের জাতীয় চরিত্রের উপর ভীষণ প্রভাব ফেলেছে। আমাদের জাতীয় মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে, কেরানি মানসিকতার সৃষ্টি হয়েছে। উদ্ভাবনী শক্তি, নেতৃত্বের যোগ্যতাসহ সকল মহৎগুণ বিদূরিত হয়ে সর্বপ্রকার নীচুতা ভিতরে বাসা বেঁধেছে। এখানে যারা ক্ষমতার স্বাদ লাভ করছেন তারাই যেন রাবণ বনে যাচ্ছেন। ফলে দিন দিন আমাদের সিস্টেমগুলো ধসে পড়ছে।
তিনশ আসনে নির্বাচন করার জন্য ইতোমধ্যেই দশ হাজারের অধিক মানুষ নমিনেশন পেপার ক্রয় করেছেন। জঘন্য চরিত্রের কোনো লোক আর রাজনীতির বাইরে থাকছে না। কোন মধুর লোভে তাদের এই প্রতিযোগিতা সেটা সবারই জানা। সৎ, ভদ্র, মার্জিত ও বিবেকবান মানুষ জঘন্য মানুষের লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছে রাজনীতির মঞ্চ থেকে। যতই বলা হোক অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কিন্তু দিনশেষে সেই পেশীশক্তি আর কালো টাকারই জয় হবে এটা সর্বজনবিদিত। কারণ আজ রাজনীতিতে চলে বিদেশি লবিং, চলে অপবাদ আরোপ করে একে অপরের চরিত্রহনন। বিশ্বরাজনীতিতে এখন চলছে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর একে অপরের উপর অর্থনৈতিক/বাণিজ্যিক অবরোধ আরোপ। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখেয়াল। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শ স্খলনের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে এতদিনের শত্রুদলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হচ্ছে কেবল স্বার্থহাসিলের জন্য। এটাই নাকি গণতন্ত্রের চর্চা। এই চর্চা আমাদের জাতিকে ভেঙে খান খান করে ফেলছে, কীভাবে শক্তিহীন দুর্বল করে ফেলছে তা নিয়ে ঐ রাজনীতিকদের কোনো মাথাব্যথা নেই।
ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা ভোগবাদী, আরামপ্রিয়, বস্তুবাদী জনগোষ্ঠী গড়ে তোলে। লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে- এই হলো শিক্ষার পূর্বঘোষিত লক্ষ্য। সুতরাং এই শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ যে কোনো প্রকারে অর্থ রোজগার করবে, প্রয়োজনে নিজের দেশের কৃষক, শ্রমিক জনতার টাকা হাতিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদেশে বাড়ি বানাবে এটাই কি স্বাভাবিক নয়? সেই শিক্ষাব্যবস্থা আমরা সানন্দে বয়ে চলেছি। এই শিক্ষিত মানুষেরাই গত ১০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ৩৮ লক্ষ কোটি টাকা পাচার করেছেন (২০ নভেম্বর ২০১৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত)। এই পরিমাণ টাকা দেশের জাতীয় বাজেটের নয়গুণ। এ ছাড়াও এই টাকা দিয়ে ১১৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব। এসব কোনো কিছুরই তোয়াক্কা করছে না পাচারকারীরা। ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া শিক্ষাব্যবস্থা যে উন্নত মানুষ তৈরি করতে অক্ষম সেটা বুঝতে আমাদের আর কত বছর লাগবে? যে শিক্ষা জাতিকে চোর বানায়, দুর্নীতিবাজ বানায় সেই শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা কার স্বার্থে বয়ে বেড়াচ্ছি। তাদের এইসব ব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য মানানসই নয় তবু আমরা জোর করে সেটার সঙ্গে নিজেদেরকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এর সম্মিলিত ফলটা কী হচ্ছে? ফল হচ্ছে আমরা সর্বদিক থেকে আক্রান্ত হয়েছি।
সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বড়ই হতাশাব্যঞ্জক। আমরাও হতাশ হতাম যদি দেখতাম আমাদের সামনে সমস্যা সমাধানের কোনো দৃষ্টান্ত নেই, কোনো অতীত নেই, গৌরবময় ইতিহাস নেই, আমাদের এমন কোন জীবনবিধান নেই যার উপর ভিত্তি করে আমরা আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি। তা তো নয়। আমরা এটা ভুলে গেছি যে আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটা অবিকৃত বিধান আছে কোর’আন, যেটা অবিকৃত থাকবে আজীবন (সুরা হিজর ৯)। এটা কেবল তাত্তি¡ক কেতাবই নয়, এর বাস্তবায়ন কী করে হবে আর কী করেই বা এই কেতাব সমাজ পরিবর্তন করেছিল তা জ্বলজ্যান্ত ইতিহাস।
পাশ্চাত্য দাজ্জালীয় ‘সভ্যতা’ যে গ্রিক সভ্যতার দর্শনকে আশ্রয় করে দাঁড়িয়ে আছে সেই গ্রিক সভ্যতার সূচনা হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৮০০ বছর আগে অর্থাৎ আজ থেকে ২৮০০ বছর আগে। আমরা সেই সভ্যতাকে আদর্শ জ্ঞান করে মেনে চলতে পারি অথচ মাত্র কয়েক শতক আগের ইসলামের সভ্যতা সম্পর্কে কেন আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি না? আমরা রসুলাল্লাহর মতো করে দাড়ি রাখার চেষ্টা করি, নিখুঁতভাবে ওযু করি, হজ করি, ডান কাত হয়ে শুই, খাবার আগে নিমক খাই, খাবার পরে মিষ্টি খাই। তিনি যেভাবে হাসতেন, যেভাবে কাঁদতেন, যেভাবে হাঁটতেন তার সব অনুসরণ করি কিন্তু তিনি যে জীবনব্যবস্থাটা জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করে আইয়ামে জাহিলিয়াতের সমাজকে শান্তিময় সমাজে পরিবর্তিত করে দিয়ে গেলেন সেই জীবনব্যবস্থাকে আমরা অনুসরণ করি না। ইসলামপূর্ব আরবের সমাজ ছিল কামড়া-কামড়িতে পূর্ণ, অত্যাচার, অবিচার, অন্ধত্ব, দারিদ্র্যে, ক্ষুধায় পূর্ণ সেই সমাজকে তিনি সমৃদ্ধ করলেন, তাদেরকে শক্তিশালী করলেন। তাদের সৃষ্ট জোয়ারে ভেসে গেল রোমান পারস্য সম্রাজ্য। মূর্খ আরবরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি অঙ্গনে সকল জাতির শিক্ষকের আসনে আসীন হলো। যারা নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির পূজা করত তারা যুক্তিশীল একটি জাতিতে পরিণত হলো। যারা কিছুদিন আগে মেয়ে সন্তানকে জীবন্ত কবর দিত তারাই নারীদেরকে বিপুল মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করল, তাদের নারীরা সামরিক সামাজিক সবক্ষেত্রে বিপুল অবদান রাখল। যে আদর্শের ভিত্তিতে তিনি একটি পতিত সমাজকে উন্নত সভ্যতায় পরিণত করলেন সেই আদর্শ তো আমাদের কাছেও আছে। তাহলে কেন আমরা সেই ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ব্যর্থ জীবনব্যবস্থার দিয়ে নিজেদের জীবন পরিচালনা করছি?
সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, মানবজাতির এই দুর্দিনে যাদের উচিত ছিল ইসলামকে আবার বিকল্প জীবনব্যবস্থা হিসাবে প্রস্তাব করা সেই ধর্মের ধারক বাহকরা তাদের ধর্মীয় মাসলা-মাসায়েলের জ্ঞানকে পুঁজি করে ব্যবসা করতে নেমে পড়েছেন। যেহেতু আমাদের দেশের মানুষের ধর্মানুভূতি অত্যন্ত প্রবল, তাই রাজনৈতিক নেতারা মসজিদ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ভোটপ্রার্থী হয়ে থাকেন। অধিকাংশ মসজিদে তারাই হন কমিটির পরিচালক, তাদের কথাতেই ইমাম সাহেবরা ওঠেন বসেন। তাদের দানে-অনুদানের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন। তারা এ প্রশ্ন তুলতে সাহস পান না যে, নেতাদের ঐ অর্থ কি চাঁদাবাজি, দুর্নীতি করে প্রাপ্ত কিনা। অথচ ইমাম সাহেবসহ ধর্মের সকল ধ্বজাধারীদের দায়িত্ব ছিল যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করা। সেটা তারা করতে পারছেন না, কারণ অন্নদাতার ভুল ধরতে নেই। এভাবে তারা স্বার্থরক্ষার জন্য সত্যত্যাগে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, প্রভাবশালীর অন্যায়ের সঙ্গে আপস করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, ধর্মের মিম্বরে দাঁড়িয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার হিম্মৎ হারিয়ে ফেলেছেন। ফলে ধর্মের উপর আস্থা রাখার শেষ জায়গাটিও হারিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় হেযবুত তওহীদ সেই মহাসত্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে, জাতির সামনে তুলে ধরছে তাদের মুক্তির আদর্শ জীবনব্যবস্থা প্রকৃত ইসলাম।
আমাদের কথা স্পষ্ট। এখন জাতিকে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এই প্রচলিত জীবনব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কাজটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। আমাদের শাসকবর্গও জানেন যে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা কেবল উপাসনার পথ দেখায় না, এ দিয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থাও পরিচালনা সম্ভব। কিন্তু বর্তমানে তাদের সামনে যে ইসলামটি বিরাজ করছে তা দিয়ে কোনো সভ্য সমাজ চলতে পারে না, রাষ্ট্র চলতে পারে না। প্রচলিত ইসলাম অন্ধত্ব আর মূঢ়তায় পূর্ণ বিজ্ঞানবিরোধ যুক্তিহীন এক ইসলাম। শত শত বছর ধরে হাজারো বিকৃতির সমাবেশ ঘটেছে এই ধর্মতত্ত্বের মধ্যে যা একে যুক্তিহীন অযোগ্য একটি মতবাদে পরিণত করেছে। এটি একাধারে বিকৃত সুফিবাদী ইসলাম, জঙ্গিবাদী ইসলাম, মোল্লাতান্ত্রিক ইসলাম, বিকৃত রাজনৈতিক ইসলাম প্রভৃতি নানারূপে বিরাজ করছে। কোন রূপটি সঠিক সেই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে আরো শত শত বছর পার হয়ে যাবে। তাই যাদের হাতে রাষ্ট্র চালাবার কলকাঠি তারা ধর্মকেই বর্জন করেছেন। কিন্তু তাদেরকে এখন বুঝতে হবে যে তাদের গণতন্ত্রও আর পারবে না মানুষকে শান্তিময় সমাজ উপহার দিতে। বরং দিনকে দিন পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হবে। সেই ভয়ানক পরিস্থিতিতে যেন পড়তে না হয় সেজন্যই হেযবুত তওহীদ তার প্রস্তাবিত আদর্শটি বিবেচনা করার দাবি তুলেছে।
[লেখক: সাধারণ সম্পাদক, হেযবুত তওহীদ। ফোন: ০১৬৭০-১৭৪৬৪৩, ০১৬৭০-১৭৪৬৫১]