স্বাধীনতার ৪৭ বছর চলছে। এই দীর্ঘ সময়েও আমাদের জাতীয় সংহতি গড়ে উঠতে পারেনি, যার জন্য বিশেষভাবে দায়ী ধর্মকে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারকারী একটি গোষ্ঠী। একেক জন একেকভাবে ইসলামকে ব্যাখ্যা করছে। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি প্রিয় ধর্ম ইসলামের অপব্যাখ্যা করে বিভিন্ন ধরনের জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে। অথচ মানুষের ঈমানকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ উদ্ধার করা, জঙ্গিবাদী কর্মকান্ড, গুপ্তহত্যা করা, মানুষের ধর্মানুভূতিকে উত্তপ্ত করে বিভিন্ন ইস্যুতে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ইত্যাদি ধর্ম নয়। কিন্তু একটি শ্রেণি ধর্মের অপব্যাখা করে এগুলোকে ইসলামের নামে চালু করে দেয়। অধিকাংশ মানুষের ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে সাধারণ মানুষ তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মনে করে যে এগুলো ধর্মরক্ষার কাজ। এভাবেই একটি অন্যায় কাজকে ধর্মের নামে জায়েজ করে সকল ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কেউ পাচ্ছে না। যেই তাদের ভুল ধরবে তার বিরুদ্ধেই তারা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে সে ব্যক্তি হোক, বা রাষ্ট্রই হোক।
অর্থাৎ সিদ্ধান্ত দাঁড়াচ্ছে এমন যে, স্বার্থান্বেষী ঐ শ্রেণিটি ইসলামের যে ব্যাখা দেবে, যেটাকে ইসলামের কাজ বলবে, যেভাবে করতে বলবে সেটাই হবে ইসলাম, সেটাই সবাইকে মানতে হবে। কারণ তারা সংখ্যায় বেশি, মানুষের ঈমানী চেতনা তাদের হাতে বন্দী। কোনো গবেষক, কোনো চিন্তাশীল মানুষ, আলেম, সুশীল সমাজ বা গণমাধ্যম যারাই তাদের ভুল ধরবে তাদেরকেই তারা নাস্তিক কাফের মুরতাদ আখ্যা দিয়ে জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদি অবলীলা শুরু করে দেবে। কোথায় কী কথা বললে মানুষ উত্তেজিত হবে তারা তা ভালো করেই জানে। তাই ঠিক সেই কথাটি বলে তারা ধর্মবিশ্বাসী মানুষকে সহিংস কাজে প্ররোচিত করে। মিথ্যা কথা বলে উন্মাদনা সৃষ্টি করা কখনোই মহানবীর (দ.) শিক্ষা হতে পারে না। তারা জবরদস্তিমূলকভাবে তাদের ধ্যান-ধারণাকে মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। তাদের নানা কূপমণ্ডূকতার পরিণামে ইসলাম এখন শান্তি ও মুক্তির পরিবর্তে যেন একটি সঙ্কটে পরিণত হয়েছে।
এখন সময় এসেছে ধর্মের নামে এসকল অধর্মের বিরুদ্ধে জনগণকে সোচ্চার হওয়ার। কোর’আন ও রসুলের জীবনাদর্শের বাইরে গিয়ে পরবর্তী যুগে বিভিন্ন মাজহাব-তরিকার বিশেষজ্ঞদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে লক্ষ লক্ষ ফতোয়া, মনগড়া মাসলা মাসায়েলের পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলোর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে যত মতবিরোধ, হানাহানি, অন্ধত্ব। অথচ মুসলিম জাতির মূল পথপ্রদর্শক হবে কোর’আন ও সুন্নাহ।
আমরা হেযবুত তওহীদ বলছি, এই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীটি যেটাকে ইসলাম বলবেন সেটাই ইসলাম, সেটাই সবাই মেনে নিতে বাধ্য এ অন্যায় দাবি আমরা মানি না। আমরা মনে করি, আল্লাহ কোর’আনে যা বলেছেন এবং রসুল যা করেছেন সেটাই হচ্ছে ইসলাম। যে বিষয়ে আল্লাহ-রসুলের কোনো বক্তব্য আছে, তার বিপরীত কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর এটাই কলেমা, তওহীদের মর্মবাণী।
আমরা আরো বলছি, একেকজন একেকভাবে ইসলামের কাজ করে অর্থগ্রহণ করে। কিন্তু এটা ইসলামে বৈধ নয় (সুরা বাকারা ১৭৪, সুরা ইয়াসিন ২১), অন্যের উপর জোর করে কোনো মতামত, পোশাক-আশাক বা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়া ইসলামের নীতি নয় (সুরা বাকারা ২৫৬), শালীনতা রক্ষা করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও জাতীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে একত্রে কাজ করতে পারে। ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে যে জঙ্গিবাদ ও ধান্দাবাজির রাজনীতি চলছে সেগুলো ইসলামের নীতিবহির্ভূতভাবে করা হচ্ছে। কীভাবে সেটাও আমরা তথ্য, যুক্তি, প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছি। ইসলাম বিরোধী, আইন-শৃঙ্খলা পরিপন্থী এবং মানুষের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ হেযবুত তওহীদ কোনোদিন করেনি, করা সম্ভবও নয়। আমরা চাই প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা মানুষ পাক, ইসলামের নামে যাবতীয় অন্যায় বন্ধ হোক। যারা যা খুশি তাই ইসলামের নামে চালিয়ে দেবে, আর সেটাকেই অন্যদের মেনে নিতে হবে এটা অন্যায়। এ অন্যায়ের অবসান হোক। বরং কোর’আনে আল্লাহ যা বলেছেন এবং রসুল যেভাবে তার বাস্তবায়ন করেছেন সেটাই হচ্ছে প্রকৃত ইসলাম। তাদের যে কথা ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সে কথাকে আমরা অবশ্যই মানি।
ধর্মোন্মাদনা সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থা এখন প্রায়শই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এ বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে জাতিকে উদ্ধার করতে এখন সকল ধর্মপ্রাণ মানুষ, সাংবাদিক ও সচেতন মানুষের এগিয়ে আসা অপরিহার্য। শক্তি প্রয়োগ করে এই শ্রেণিটিকে দমন করা যৌক্তিক নয়, সম্ভবও নয়। কারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। অপরদিকে তাদের অন্যায়কে সমীহ করে প্রশ্রয় দেওয়া হলে ধর্মের নামে সৃষ্টি করা উন্মাদনা জাতিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে। যেহেতু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই, তাই একটাই উপায় আছে, তা হলো ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা তাদের সামনে তুলে ধরা, তাদের ধর্মবিশ্বাসকে জাতীয় রাষ্ট্রীয় উন্নয়নে, মানবতার কল্যাণ সাধনে কাজে লাগানো। এর জন্য প্রথমেই দাঙ্গা বিস্তারকারীদের অন্যায় ও অধর্মগুলোকে কোর’আন হাদীসের আলোকে মানুষের সামনে সুস্পষ্ট করে তুলতে হবে।
আমরা আমাদের ঈমানী কর্তব্য ও সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে ইসলামের নামে চলমান যাবতীয় অন্যায় ও ইসলাম-বহির্ভূত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছি। এ কারণে তারা আমাদেরকে অতীতে খ্রিষ্টান, কাফের, ইত্যাদি ফতোয়া দিত। বর্তমানে তারা দেশজুড়ে সীমাহীন অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে যে, আমরা নাকি ইসলামবিরোধী, কুফরি সংগঠন। তারা আমাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে, অনেকের বাড়িঘর লুট-পাট করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে, অনেকের অঙ্গহানী ঘটিয়েছে, আমাদের নির্মাণাধীন মসজিদ ভাঙচুর করেছে এমনকি প্রকাশ্য দিবালোকে তারা আমাদের কর্মীদের জবাই করে চোখ তুলে হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা করেছে এবং তাদের দেহ আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছে। তথাপি আমরা সত্য প্রকাশে পিছপা হই নি।
তাই আসুন আমরা সবাই মিলে সত্য প্রকাশের মাধ্যমে সমাজকে ইসলামের অপব্যাখ্যার থাবা থেকে উদ্ধার করি। মানবতার কল্যাণে, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রকৃত ইসলামের বিকল্প নেই।