ইসলামের সালাহ্ এবং মানবদেহের কঙ্কাল:
(রাশেদুল হাসান অন্তিক)
আল্লাহর রসুল ইসলামের সাথে ঘরের উপমা দিয়েছেন বোলেছেন – ইসলাম একটা ঘর, সালাহ তার খুঁটি, জেহাদ তার ছাদ। তেমনি হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা, এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী ইসলামের সাথে মানুষের শরীরের বিভিন্ন কিছুর উপমা দিয়েছেন। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমি তাঁর প্রদত্ত উপমা সম্পর্কে একটি পর্যালোচনা কোরছি।
মানুষের শরীরের প্রধান অংশ কি? এটি হোল আত্মা বা জীবন। যতক্ষণ হৃৎপিণ্ড সচল থাকে মানুষ ততক্ষণ জীবিত থাকে। তাই ইসলামের আত্মা, প্রাণ বা হৃৎপিণ্ডের তুলনা হয় তওহীদের সঙ্গে। আর রক্ত চলাচল সব সময় শরীরকে উষ্ণ রাখে, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত শরীরের প্রতিটি কোষকে জীবিত রাখে এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গের বৃদ্ধি (Development) ঘটায়। জেহাদ ফি সাবিলিল্লাহ হোল ইসলামের এই রক্ত চলাচল। ইসলাম প্রসার, দীন প্রতিষ্ঠা, ইসলামের উন্নতি (Development) সব ঘটায় জেহাদ। জেহাদ বন্ধ মানেই ইসলাম শেষ ঠিক যেমন রক্ত চলাচল বন্ধ হোলে মানুষ মৃত, একমুহুর্তও আর বাঁচতে পারবে না। এই দুইটা একদম অপরিহার্য, আত্মা আর রক্ত চলাচল। ইসলামেরও এই দুইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ – তওহীদ ও জেহাদ। এই দুইটাই মো’মেনের সংজ্ঞায় আল্লাহ দিয়ে দিয়েছেন- আল্লাহ ও তাঁর রসুলের প্রতি ঈমান অর্থাৎ তওহীদ এবং এ তওহীদ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই হোল জেহাদ। মো’মেনের সংজ্ঞা ইসলামের সংজ্ঞা একই। আবার মানবদেহের মধ্যে যেমনBrain (মস্তিষ্ক ) এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। একটা মানুষ যত শক্তিশালী হোক, স্বাস্থ্যবান হোক তার মস্তিষ্ক যদি বিকৃত হয়, সে কি কাজ কোরবে, কখন কোরবে, কিভাবে কোরবে, কার সঙ্গে কি ব্যবহার কোরবে, কিসের গুরুত্ব বেশি, কোনটা মূল্যবান, কোনটা মূল্যহীন তা বুঝবে না। একইভাবে দীনের আকিদা যদি বিকৃত হয় সবকিছু ওলটপালট হোয়ে যাবে। কোন্ এবাদত কি জন্য, ইসলামের কোন বিষয়টা কি জন্য, সালাহ কি জন্য, হজ্ব কি জন্য, যাকাত কি জন্য এটা মোসলেম জাতির ধারণায় আর থাকবে না। জাতির দিকনির্দেশনা (Direction) উল্টে যাবে। শুধু তাই না, কি জন্য, কেন আল্লাহ তাকে সৃষ্টি কোরছেন, কেন আল্লাহ সালাহ দিয়েছেন, কেন আল্লাহ সওম দিয়েছেন, কেন হজ্ব দিয়েছেন, কেন যাকাত দিয়েছেন – এগুলো সে কিছুই বোলতে পারবে না। অর্থাৎ আজকে এই জাতির যে অবস্থা ঠিক সেইটা হবে। তেমনি সালাহ হোচ্ছে ইসলামের কঙ্কাল-স্বরূপ। মানুষের শরীরের মাংস, রক্ত, ধমনী, শিরা-উপশিরাগুলো (Vein, artery) ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড, মগজসহ দেহের প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কলা সমস্ত কিছু অবস্থিত আছে, দাঁড়িয়ে কঙ্কালের (Skeleton) উপরে। এই যে মানুষ দৌঁড়াদৌঁড়ি কোরছে, হাঁটাহাঁটি কোরছে অর্থাৎ যথাযথভাবে (Properly) যে জিনিসটা যে জায়গায় থাকা দরকার, চামড়া, মাংস, রক্তের শিরা-উপশিরা, রক্ত চলাচল, মস্তিস্ক, ফুসফুস, কিডনি, যকৃৎ (Liver), হৃৎপিণ্ড (Heart) এইগুলো যেটা যেখানে থাকা দরকার সেইভাবে যথাযথ স্থানে রাখে এই কঙ্কাল। কঙ্কালটা যদি সরিয়ে ফেলা হয় তখন কি হবে? সব চামড়া, মাংস, শিরা, ধমনী, রক্ত স্তুপিকৃত হয়ে যাবে। কিছুই তার নিজের জায়গায় থাকবে না অর্থাৎ ধসে পড়বে, স্তুপিকৃত হোয়ে পড়বে। ইসলামেরও যদি সালাহ না থাকে সব কিছু ধসে পড়বে। আকিদা নষ্ট হোয়ে যাবে, রক্ত চলাচল বন্ধ হোয়ে যাবে, সংগ্রাম থাকবে না তওহীদ হারিয়ে যাবে। কিভাবে? একটা উদাহরণ দিচ্ছি। যেমন যতক্ষণ কঙ্কালের কাঠামোর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে ততক্ষণ রক্ত চলাচলকারী শিরা দিয়ে রক্ত চলাচল ঠিকমত হয়, এগুলি মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঠিকমত রক্ত সংবহন কোরে যাচ্ছে। পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে যেটা যেই জায়গায় থাকা দরকার ঠিক থাকছে। ঠিক যেমন একটা লাউ গাছ ঠিক মত থাকে একটি মাচার উপর বা বাঁশের একটি কঞ্চির উপর। একটা শক্ত কঞ্চি বেয়ে যখন একটি লাউ গাছ বড় হোয়ে ওঠে তাকে মাচার উপর রাখা হয়, তখন এতে লাউ ধরে এবং ঠিক যেমনভাবে থাকা উচিৎ সেইভাবে থাকে। এমন অবস্থায় সুদৃঢ়, শক্ত কঞ্চিটি সরিয়ে ফেললে কি হয়? পুরো গাছটি ধসে পোড়ে স্তুপিকৃত হোয়ে যায়, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। তেমনি কোরে মানবদেহের রক্ত সংবহনতন্ত্রগুলো দাঁড়িয়ে থাকে কঙ্কালের উপরে। কঙ্কাল সরিয়ে ফেললে সেইগুলি শিরা-ধমনীগুলি ধসে পড়বে। ইসলামের বেলায় তেমনি জেহাদ। সালাহ না হোলে প্রথমত ‘ইসলামের জেহাদ’ থাকবে না কারণ জেহাদের যে চরিত্র দরকার সেটা তৈরি করে ‘সালাহ’। সালাহ না থাকলে জেহাদই থাকবে না। আজকে দুনিয়াময় বহু
দল আছে যারা জেহাদ বা সংগ্রাম কোরছে। অর্থাৎ জেহাদ কিন্তু একরকমের আছে। প্রকৃত সালাহ না থাকার কারণে যেটা হয় তা হোল সেই জেহাদ আর ‘ইসলামের জেহাদ’ থাকে না, সেটা হোয়ে যায় জেহাদের নামে সন্ত্রাসবাদ, জবরদখল, অন্যের সম্পত্তি দখল লুটপাট, দেশ দখল। যে ইসলামের জন্য যেভাবেই যে কাজই কোরুক, তাকেই জেহাদ হিসাবে মনে কোরছে। কেউ আত্মার বিরুদ্ধে জেহাদ কোরছে আবার কেউ গণতান্ত্রিক রাজনীতির আদলে নির্বাচন কোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কোরতে চাচ্ছে। তারা নির্বাচনকেই জেহাদ হিসাবে আখ্যায়িত কোরছে। মানে জেহাদ বিষয়টি ইসলামের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও এর রূপ পরিবর্তিত হোয়ে রসুলাল্লাহ ও আসহাবগণের জেহাদে ফি সাবিলিল্লাহ, আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর জন্য জান মাল দিয়ে দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ থাকে না। জেহাদ নামে একটা কিছু থাকে, সংগ্রামও চলে কিন্তু সেই সংগ্রামটা হোয়ে যায় সন্ত্রাসবাদ, অন্যের অশান্তির কারণ হয়, দেশ দখল হয়, সম্পত্তি দখল হয়। অথবা হোয়ে যায় আত্মার সঙ্গে জেহাদ, বা আত্মরক্ষাত্মক জেহাদ। অর্থাৎ সোজা কথা হোল এটা যথাযথভাবে জেহাদে ফি সাবিলিল্লাহ থাকে না, সেটা ধসে পড়ে। ধসে পড়ে কেন? সঠিক সালাহটা না থাকার কারণে জেহাদের জন্য যে চরিত্রটা দরকার সেটা তৈরি না হওয়ায় জেহাদ ধসে পড়ে।
আরেকটি উদাহরণ। সালাহ না থাকলে জাতির আকিদাও নষ্ট হোয়ে যাবে। দীনের কোন কাজটা কিসের জন্য তার সম্পর্কে একটি সঠিক ধারণা থাকা হোচ্ছে আকিদা। সালাহ নষ্ট হোয়ে যাওয়ার সাথে সাথে অনেক বিষয় সম্পর্কে জাতির আকিদাও বিকৃত হোয়ে যাবে। ইসলামের সেনা অধিনায়কদের বলা হয় আমীর (আদেশকারী)। এখনও যেমন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে আমীর বলা হয়, রাষ্ট্রগুলিকে বলা হয় আমীরাত। উম্মতে মোহাম্মদীর আকিদা বিকৃত হোয়ে যাওয়ার অনেক পরেও বিভিন্ন জায়গায় উমাইয়া, আব্বসিয়া ফাতেমীয় শাসকদের আমীর বলা হোত। রাজতন্ত্র যখন চলে তখনও তাদের পদবি আমীরই ছিল। এখনও আরবে অনেক জায়গায় এটা আছে, তারা তাদের শাসককে ইসলামের আমীরই মনে করে। কিন্তু এই আমীর আর উম্মতে মোহাম্মদীর চেইন অফ কমান্ডের যে আমীর এদের রূপটা এক নয়। এদের কাছে ইসলামের আমীরাতের যে প্রকৃত আকিদাটা, রূপটা সেটা নাই, সেটা ধসে পোড়েছে। এই সব আমীরাত এখন পরিণত হোয়েছে জুলুমে। তারা স্বৈর-শাসকের মত তাদের প্রজাদের উপরে নিজেদের হুকুম জোর কোরে চাপিয়ে দেয়। অধীন লোকদের এই আমীররা আর মোজাহেদ মোজাহেদা মনে করেন না, মনে করেন কর্মচারী, নিজের গোলাম, দাস-দাসী। জোর করে তাদের কাছ থেকে কর আদায় করে আর নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়ে। অর্থাৎ প্রকৃত ইসলামের আমীরাত আর নেই। আল্লাহ যেই চেইন অফ কমান্ডের আমীর দিয়েছেন অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো, রসুলের আনুগত্য করো এবং আনুগত্য করো তোমাদের আমীরের (উলিল আমরে মিনকুম) (সুরা নেসা ৫৯)। আল্লাহর দীনের যে আমীররা যুদ্ধের মাঠে ঝড় সৃষ্টি কোরতেন বর্তমানে সেই আমীর নাই। সুতরাং ইসলামের সেই আমীরাত ধসে পোড়েছে। বাংলা ভাষায় এবং মধ্যপ্রাচ্যে আমীর বোলতে বিরাট ধনী লোক বুঝায়, আমীর ওমরাহ মানেই অগাধ ধন সম্পদের মালিক। এই আমীরাতের আসল রূপটা এমন ধসে পোড়েছে ঐ সালাহ না থাকার কারণে। দেহ থেকে কঙ্কাল সরিয়ে ফেললে যেমন হয় তেমনি। কোনো কোনো দেশে এই গত শতাব্দীগুলোতে কোর’আনের আইন-কানুন, বিচার ব্যবস্থা চালু ছিল, কিছুদিন আগেও আফগানস্তানেও চালু করা হোয়েছিল ইসলামের শরিয়াহ আইন। এই শরিয়াহ আইন তো সর্বশ্রেষ্ঠ আইন, সর্বোত্তম আইন, এটা প্রতিষ্ঠা করাই তো আল্লাহর অভিপ্রায়, তবু এই ব্যবস্থা কেন টিকতে পারলো না, কেন এগুলি ধসে পড়লো? শত্র“র এক আঘাতেই চূর্ণ বিচূর্ণ হোয়ে গেল, শত্র“র সামনে দাঁড়াতেই পারল না। এর প্রথম কারণ তারা যেটাকে প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম কোরল সেটা আল্লাহর ইসলামই নয়, তাই আল্লাহ একটি আঙ্গুল তুলেও তাদেরকে সাহায্য করেন নি। অথচ মোমেনকে সাহায্য করা আল্লাহর কর্তব্য ও অপরিবর্তনীয় নীতি [সুরা রূম ৪৭, ফাতাহ ২৩]। যেহেতু সেটি আল্লাহর ইসলাম নয় তাই সেই বিকৃত শরিয়াহ মানুষের অধিকার রক্ষা কোরতে পারে নি। কারণ কি? কারণ ১৩০০ বছর আগেই সালাহর প্রকৃত উদ্দেশ্য হারিয়ে যাওয়ায় গায়ের জোরে শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা করা গেলেও সেই শরিয়ার কোন কিছুই আর তার সঠিক অবস্থানে নেই। ফলে তদের ঐ দীন ধসে পোড়েছে এবং জনগণও সেটাকে ভালোবেসে গ্রহণ করে নি। প্রকৃত সালাহ উম্মতে মোহাম্মদীকে এমন দুর্ধর্ষ, লৌহকঠিন ঐক্যবদ্ধ, শৃঙ্খলা, আদেশ পালনে নিজের সকল সহায় সম্পদ এমন কি প্রাণ উৎসর্গ কোরতে আকুলপ্রাণ (Utter Desire for death) কোরে তোলে যে শত বাধার মুখেও তারা থাকে নির্ভয়, অটল, সংসপ্তক। সেই সালাহ ছাড়া মোসলেম জাতি একটি জড়, স্তুপিকৃত জনসংখ্যার পিণ্ডবিশেষ। এটা কখনওই বেঁচে থাকতে পারে না ঠিক যেমন কঙ্কালহীন মানবদেহ মাংস, রক্তের একটি পিণ্ড ছাড়া কিছুই নয়, সবকিছু থাকলেও তার চলার ক্ষমতা নেই, আকৃতি নেই, তার মধ্যে জীবন থাকবে না।
সালাহ যদি কায়েম থাকে অর্থাৎ সঠিক সালাহ যে চরিত্র সৃষ্টি করে সেটা যদি জাতির মধ্যে বর্তমান থাকে তবে আমীর থাকবে একেবারে আল্লাহর প্রদর্শিত পথে। তার কোন ভুল ভ্রান্তি হোলে তার জাতি তাকে সেটা ধরিয়ে দিতে পারবে, সেই পরিবেশ থাকবে। এবং আমীরা পরবর্তী সালাহর সময় নিজের সেই ত্র“টি বিচ্যুতিগুলি সংস্কার কোরে নিবেন। এভাবেই তার খেলাফত হবে ঠিক আল্লাহর খেলাফত, তার জেহাদ হবে ঠিক উম্মতে মোহাম্মদীর জেহাদে ফি সাবিলিল্লাহ। সঠিক সালাহই ইসলামকে সঠিক আকৃতিতে দাঁড় কোরিয়ে রাখবে, প্রতিষ্ঠিত কোরে রাখবে। এই জন্যেই উদাহরণস্বরূপ বলা যায় “সালাহ ইসলামের কঙ্কাল”। (চোলবে…)
[ইসলামের প্রকৃত সালাহ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে যামানার এমাম জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা “ইসলামের প্রকৃত সালাহ” বইটি পড়ার অনুরোধ কোরছি।]