ইসলামী জীবনব্যবস্থায় হজ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবাদত। বর্তমানের মুসলিম নামধারী এই জাতিটির নামাজ, রোযা, যাকাত ইত্যাদির মতো হজ সম্পর্কেও আকিদা বিকৃত হয়ে গিয়েছে। তাদের বিকৃত আকিদার হজ আজ সম্পূর্ণরূপে একটি আধ্যাত্মিক ব্যাপার, আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করার পথ। তাই যদি হবে তাহলে আল্লাহ তো সর্বত্র আছেন, সৃষ্টির প্রতি অণু পরমাণুতে আছেন; তবে তাঁকে ডাকতে, তাঁর সান্নিধ্যের জন্য এত কষ্ট করে দূরে যেতে হবে কেন? শুধ্ ুতাই নয়, তিনি বলেছেন- নিশ্চয়ই আমি তোমাদের অতি সন্নিকটে (সূরা আল বাকারা ১৮৬), তারপর আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, আমি তোমাদের গলার রগের চেয়েও সন্নিকটে (সুরা ক্বাফ ১৬)। যিনি শুধু নিকটেই নয় একেবারে গলার রগের চেয়েও নিকটে তাঁকে ডাকতে, তাঁর সান্নিধ্যের আশায় এত দূরে যেতে হবে কেন?
যদি বলেন কাবা আল্লাহর ঘর তাই সেখানে যাওয়া, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ঘরের মালিকই যখন আমাদের সাথে আছে তখন বহু দূরের পাথরের ঘরে যাবার দরকার কি? আজকে হজের যে আকিদা অর্থাৎ “আল্লাহর ঘরে গিয়ে তাঁকে ডাকা” তাহলে আরো একটি প্রশ্ন থেকে যায় যে, একা একা যেয়ে তাঁকে ভালোভাবে ডাকা যায় নাকি সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায়, অপরিচিত পরিবেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ের ধাক্কাধাক্কির মাঝে তাকে ভালোভাবে মন নিবিষ্ট করে ডাকা যায়? ইসলামের উদ্দেশ্য, উদ্দেশ্য অর্জনের প্রক্রিয়া অর্থাৎ সামগ্রিক রূপ যাদের মস্তিষ্ক থেকে বিদায় নিয়েছে, এক কথায় যাদের আকিদা বিকৃত হয়ে গেছে তাদের কাছে এই প্রশ্নগুলোর কোন উত্তর নেই। দীন অর্থ জীবনব্যবস্থা। যে আইন কানুন, দণ্ডবিধি মানুষের সমষ্টিগত, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটাই হচ্ছে দীন বা জীবনব্যবস্থা। এটা আল্লাহর সৃষ্টিও হতে পারে আবার মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূতও হতে পারে। আল্লাহ প্রদত্ত দীন হচ্ছে ভারসাম্যযুক্ত। সেই দীনের প্রতিটি আদেশ নিষেধও হয়ে থাকে ভারসাম্যযুক্ত। তাতে যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদির ব্যবস্থা আছে তেমনি আত্মার উন্নতির, পরিচ্ছন্নতারও ব্যবস্থা আছে। যেমন হজ। নির্জনে বলে আল্লাহকে ডাকায় বেশি মনসংযোগ, নিবিষ্টতা হওয়া সত্ত্বেও হজের আদেশ হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষের কোলাহলে জনতার সাথে একত্র হয়ে তাঁর সামনে হাজির হওয়া। কারণ আগেই বলেছি ইসলাম আল্লাহর সৃষ্ট দীন কাজেই এর প্রতিটি আদেশ নিষেধ ভারসাম্যযুক্ত। কোন নির্দেশই একতরফা অর্থাৎ আত্মার ধোয়া মোছা, পরিষ্কার পবিত্রতা নয়। শেষ ইসলামের প্রথম এবং মুখ্য দিকটা হচ্ছে রাষ্ট্রীয়, জাতীয়, ব্যক্তিগত দিকটা গৌণ যদিও ভারসাম্যযুক্ত।
বর্তমানের মুসলিম নামধারী জাতির আকিদার সাথে না মিললেও চূড়ান্ত সত্য হচ্ছে এই যে, মুসলিমদের ইহজীবন এবং পরজীবনের, দেহের এবং আত্মার কোন বিভক্তি থাকতে পারে না। মুসলিম জাতির সমস্ত কর্মকাণ্ড হচ্ছে এক অবিচ্ছিন্ন এবাদত। জামাতে নামাজের উদ্দেশ্য হলো মুসলিম পাঁচবার তাদের স্থানীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদে একত্র হবে, তাদের স্থানীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা পরামর্শ করবে। তারপর সপ্তাহে একবার বৃহত্তর এলাকার জামে মসজিদে জুমার নামাজে একত্র হয়ে ঐ একই কাজ করবে। তারপর বছরে একবার আরাফাতের মাঠে পৃথিবীর সমস্ত মুসলিম জাতির নেতৃত্বস্থানীয়রা, একত্র হয়ে জাতির সর্বরকম সমস্যা, বিষয় নিয়ে আলোচনা করবে, পরামর্শ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে। এভাবে স্থানীয় পর্যায় থেকে ক্রমশ বৃহত্তর পর্যায়ে বিকাশ করতে করতে জাতির কেন্দ্রবিন্দু মক্কায় একত্রিত হবে। একটি মহাজাতিকে ঐক্যের সুদৃঢ় বন্ধনে বেঁধে রাখার কী সুন্দর প্রক্রিয়া।
কিন্তু বর্তমানের এই জাতি সেই ঐক্যের বন্ধন ধোরে রাখতে পারে নি। এক সময় এই দীনের অতি বিশ্লেষণ করে, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসলা মাসায়েল উদ্ভাবন করে জাতিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে একে এক মৃতপ্রায় জাতিতে পরিণত করে দেওয়ার পরও এর সব রকম কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র মসজিদ ও কাবাই ছিল, কারণ তখনও এই দীনকে জাতীয় পর্যায়ে আর ব্যক্তি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয় নি। সামগ্রিক জীবনই এই দীনের দ্বারা পরিচালিত হতো। তারপর যখন ঐ ঐক্যহীন ছিন্ন বিচ্ছিন্ন জাতিটিকে আক্রমণ করে ইউরোপীয় জাতিগুলো দাসে পরিণত করে শাসন এবং শোষণ করলো তখন এই জাতির জাতীয় এবং ব্যক্তিগত জীবনে ভাগ করা হলো যার ফলে রাষ্ট্রীয় এবাদত জুমা, হজ পরিণত হয়েছে উপাসনাতে, শুধু আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়ায়। এখনকার হাজীরা আর তাদের আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানকল্পে নিজ নিজ অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়ে কেন্দ্রীয় এমামের কাছে যান না তারা আজকে হজ করতে যান শুধুই মাত্র পরকালীন মুক্তির আশায় যে উদ্দেশ্যে ইসলাম আসার আগে মক্কার মোশরেকরা হজ করতো। তাদের এই হজ যে আল্লাহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন তা বোঝার ক্ষমতাও আজ এদের নেই। এই জাতি বুঝতে পারছে না যে তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের যতই চেষ্টা করছে ততই তারা আল্লাহর লা’নত ডেকে আনছে কারণ জাতীয় জীবন থেকে আল্লাহর হুকুমকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে তারা ইহুদি খ্রিষ্টান সভ্যতার হুকুমকে তসলিম করে নিয়েছে যার ফলে তারা মূলত কাফের মোশরেকে পরিণত হয়েছে। তাদের পরিচয় আজ তারা নিজেরাই জানে না। সমস্ত পৃথিবীতে শান্তি আনা যাদের দায়িত্ব সেই তারাই এখন সমস্ত পৃথিবীতে অশান্তিতে দিনানিপাত করছে। সাম্প্রতিক একটি ঘটনার উদাহরণ দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। কয়েক বছর আগে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজাফফর নগরে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গায় ৩৭ জনেরও অধিক লোক নিহত হয়েছে। সেখানে দীর্ঘকাল অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করেছে। পরিস্থিতির এতটাই অবনতি হয়েছিল যে কেন্দ্রীয় সরকার সেখানে সেনা মোতায়েন করতে বাধ্য হয়েছিল।
মূলত এই ধরনের ঘটনাকে ভারতে, মিয়ানমারে দাঙ্গা বলে চালিয়ে দিলেও আসলে সেগুলো সারা পৃথিবীতে চলমান মুসলিম নিধনেরই অংশ, এর পেছনে মূল উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। যাই হোক, দাঙ্গা পরিস্থিতিতে ঐ এলাকার মুসলিমদের কী করা উচিত ছিল? নিশ্চয়ই শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত ছিল। উভয়পক্ষকে সহিংসতা পরিহার করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা উচিত। কিন্তু না, সেখানকার অতি মুসলিমরা এই দুনিয়াদারি কর্মকাণ্ডে না ঢুকে তারা যাচ্ছেন হজ করতে, আত্মার ময়লা পরিষ্কার করতে, নিষ্পাপ হতে। আর সেই হাজীদের বিদায় দিতে গিয়ে ঐ উত্তর প্রদেশের তরুণ মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব হজযাত্রীদেরকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, “আপনারা মক্কায় গিয়ে এখানকার দাঙ্গা পরিস্থিতির উন্নতির জন্য দোয়া করবেন।” কি হাস্যকর! মনে হয় যেন তারা দোয়া করলেই আল্লাহ আসমান থেকে সশস্ত্র মালায়েক বাহিনী পাঠিয়ে দিবেন যারা দাঙ্গাবাজদের মেরে ধরে থামিয়ে দেবেন আর অবস্থার উন্নতি হয়ে যাবে। যে কাজের ভার আল্লাহ মুসলিমদেরকে দিয়েছেন সেই কাজের দায়ভার আবার তারা আল্লাহর কাছে ফেরত পাঠিয়ে নিজেরা যাচ্ছেন হজে। এই লক্ষ লক্ষ হাজীদের দোয়া যে আল্লাহ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন তার প্রমাণ বর্তমানে সারা পৃথিবীতে মুসলিম নামক জাতিটির শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলমান করুণ দুর্দশা ও দাসত্বের জীবন।