বছরের ৩৬৫ দিন আমাদেরকে একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হেযবুত তওহীদের মেয়েরা কেন রাস্তায় নেমে পত্রিকা এবং বিক্রি করে? কেন তারা সভা সমাবেশে অংশ নেয়? এ প্রশ্নের জবাবে কোনো তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়ে সোজাসুজি বলতে হয়, মুসলমানসহ গোটা মানবজাতি আজ হুমকির মুখে। যেভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো একটার পর একটা দেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে তাতে কারো ভবিষ্যৎই নিরাপদ নয়। এ বিষয়টা আমরা নয় কেবল অনেকেই বলে থাকেন। তেমন কিছু হলে আমরা নারীরা ঘরের ভেতর কালো বোরখা পেঁচিয়েও আত্মরক্ষা করতে পারব না, সবাইকে ধর্ষিত হতে হবে, দেশ থেকে বিতাড়িত হতে হবে, অথবা মরতে হবে – এই উপলব্ধিও অনেকের আছে। তাদের সবার সাথে আমাদের পার্থক্য হলো, আমরা এটা বুঝে ঘরে বসে না থেকে এই নিষ্ঠুর পরিণতি এড়ানোর জন্য সংগ্রামে নেমেছি।
ধরা যাক, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে আমরা বেঁচেই গেলাম। তারপরও বিপদ কেটে যাচ্ছে না। আমরা অভ্যন্তরীনভাবে এমন এক সিস্টেমের মধ্যে পড়ে গেছি যে, ঘর থেকে বেরোলে আমাদের ফিরে আসার নিশ্চয়তা নেই। ঘরের ভেতরেও নিরাপত্তা নেই। ধর্মীয় রাজনৈতিক বিভেদের কারণে আমাদের জাতি বিভক্ত। পালাক্রমে একদল অপর দলকে বিনাশের চেষ্টায় আছি। এমন পরিস্থিতিতে কে নারী কে পুরম্নষ সেটা ভাবার সময় আছে? এখন প্রত্যেকের দায়িত্ব সংকট থেকে বাঁচার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। হেযবুত তওহীদের নারীরা সেটাই করছে।
বিকৃতমনাদের চোখে হেযবুত তওহীদ একটি নারী সর্বস্ব দল। রহস্যময় কারণে আমাদের হাজার হাজার পুেরুস চোখে পড়ে না। তাদের চোখে পড়েন না, গুটিকয় নারী সদস্য দেখলেই তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তখনই তাদের ভিতরের পশু, তাদের নোংরামিগুলো বাইরে বেরিয়ে আসে। ভাবখানা এমন, নারীরা গণতন্ত্র করবে, সমাজতন্ত্র করবে, দেশ চালাবে, স্পিকার হবে সব ঠিক আছে কিন্তু ইসলামের কথা কেন বলবে? ইসলাম তো ফতোয়াবাজদের পৈত্রিক সম্পত্তি। হেযবুত তওহীদের মাননীয় এমাম নারীদেরকে অচলায়তন ভেঙে বের করে এনেছেন। তাই প্রতিনিয়ত তীব্র বাক্যবাণে তাঁকে বিদ্ধ করা হচ্ছে। যারা করছে তাদের অধিকাংশই মাদ্রাসাশিক্ষীত অথবা ধর্মব্যবসায়ীদের অন্ধ অনুসারী। সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ছড়াচ্ছেন আমাদের ধর্মীয় বক্তারা। নোংরা ঘাঁটলে দুর্গন্ধই ছড়ায়। তাই তাদের এসব অশ্লীল কথা ও কুৎসিত অভিব্যক্তি নিয়ে কথা বাড়াচ্ছি না। যারা মানবজাতির বিপদ আঁচ করতে পারেন নি তারা মসজিদ-মাদ্রাসা কিংবা হুজরার জানালা দিয়ে মুখ বের করে নারীরা কেন মাঠেঘাটে সেই প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কিন্তু আত্মা জগতের সাথে যারা সম্পর্ক রাখেন তারা এই প্রশ্ন না করে এই আত্মত্যগী নারীদেরকে সেলুট জানাবেন। তারা বুঝতে সড়্গম হবেন এই নারীরা নিজেদেরকে প্রদর্শন করতে বের হননি। তারা নেমেছেন মানুষের মুক্তি সংগ্রামের সৈনিক হিসাবে। তারা একটি আদর্শ পৌঁছে দিচ্ছেন সবার হাতে। যে আদর্শ অকাট্য সত্য, যে আদর্শ পাল্টে দিতে পারে পৃথিবীর চেহারা।
এদের মাঝে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা রয়েছেন, পেশাজীবী নারীরা রয়েছেন তেমনি রয়েছেন বয়স্ক নারীরাও। রাস্তায় হলে সব ধরনের টিটকিরি, ইভ টিজিং, অশস্নীল কথা, মানুষের বাঁকা দৃষ্টি ও তাচ্ছিল্য সহ্য করার মানসিকতা নিয়েই তারা নেমেছেন। যদি এ কাজকে তারা নিজেদের ধর্মীয়, মানবিক ও সামাজিক কর্তব্য বলে না ভাবতেন, তবে অর্থ কেন, কোনো কিছু দিয়েই তাদেরকে মাঠে নামানো যেত না। কিন্তু এখন তারা সাংসারিক কাজের পাশাপাশি আদর্শিক লড়াইয়ের কাজও করছেন।
অন্যদিকে যারা প্রশ্ন তুলছেন ‘নারীরা’ কেন মাঠেঘাটে – মূলত সেই অংশটারই মাঠে থাকার কথা ছিল। তারা যদি একটি নিরাপদ সমাজ গড়ে তুলতে পারতেন তাহলে নারীদের আজ মাঠে নামা লাগতো না। কিন্তু তারা মাঠে নেই, তারা আছেন সমালোচনাকারীর ভূমিকায়। অথচ আজ পর্যন্ত ধর্ষিতা নারীকেও, একটি শিশুকেও তারা সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন নি। আর মাদ্রাসায় মক্তবে শিশুরা কাদের দ্বারা প্রতিদিন জঘন্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছে তা সকলেরই জানা। আমরা একটি মহা সংকটকাল অতিক্রম করছি। একটি যুগের সমাপ্তি হবে, নতুন যুগের সূচনা হবে। মানুষের তৈরি সব জীবনব্যবস্থা ব্যর্থ হয়ে গেছে। ধর্ম হয়ে গেছে পরকালের বিষয়। বাস্তবজীবনে মানুষ আর ধর্মের দ্বারা সামজিক শান্তি নিরাপত্তার প্রত্যাশা করে না। এখন মানুষ সময়ের চৌরাত্মায় দাঁড়িয়ে। কোন দিকে যাবে সে? এই গুরুতর সময়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিলে সে ভুলের মাশুল আর দেওয়া সম্ভব হবে না। শাস্ত্রকানারা নারীদেরকে নাকমুখ ঢেকে, হাতমোজা, পা মোজা পরে ঘরে বসে থাকার কথা বলবে। কিন্তু নারীদেরকে রক্ষা করা দূরে থাক, তারা নিজেদেরকেও রক্ষা করতে পারবে না। তারা মুখে অনেক বড় বড় কথা বলতে পারবে কিন্তু স্বভাবে তারা কাপুরুষ আত্মাবীমুখ। তারা দুটো ভাতের জন্য ধর্ম বিক্রি করে। তারা ঐক্যহীন, একে অপরের ছিদ্র অন্বেষণে ব্যস্ত। ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান নারীরা আমাদের দেশের নারীদের থেকেও বেশি পর্দানশিন। তাদের দেশেও মুফতি, মুহাদ্দিসের অভাব ছিল না, কথিত ধার্মিকও কম ছিল না। কিন্তু কেউ তাদেরকে রড়্গা করতে পারেনি।
সুতরাং নারীকে নিরাপত্তা দিতে যে সমাজব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে তা পরিবর্তন করে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এখন নারীকেও করতে হবে, নিজেদেরই নিরাপত্তার স্বার্থে। ঘরে বসে থাকলে কাল ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবে। বোঝার সুবিধার জন্য ছোট্ট একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। সারা দেশের থানাগুলোতে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা রেকর্ড করেছে পুলিশ। স্বভাবতই এর প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এসব মামলার কয়টাতে ন্যায়বিচার পাচ্ছেন নারীরা?
সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন থেকে বাঁচতে সিরিয়া, মায়ানমার, লেবাননের অধিবাসীরা যেমন বাধ্য হয়েছে ছোট ছোট নৌকায় উঠতে, ডুবে মরতে, উদ্বাস্তু শিবিরে অমানবিক জীবনযাপন করতে, তেমনি আজ নয় কাল আমাদের পর্দানশিন নারীদেরকেও বঙ্গোপসাগরে নামতে হতে পারে। সুতরাং ঘর থেকে যেহেতু বের হতেই হবে, সেহেতু আগেই বেরিয়ে যদি বাঁচা যায়, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে জাগানো যায় তাহলে সেটাই কি ভালো নয়? উপরন্তু কোর’আনের আয়াত ও রসুলালহর শিক্ষা আনুযায়ী নারীদের বাইরের জনসমাগমে চলায় নিষেধাজ্ঞা নেই। শালীন সভ্য পোশাক পরে তারা বাইরে যেতে পারেন। রসুলালস্নাহর (সা.) জীবদ্দশায় এবং তার পরেও নারীরা যুদ্ধের ময়দানে যেতেন, যুদ্ধ করতেন, রসদ সরবরাহ ও আহতদের চিকিৎসা ও সেবা দিতেন। কোনো কারণে মুসলিমরা পিছু হটলে তাদেরকে কখনও আঘাতের ভয়, কখনও অনুপ্রেরণা দিয়ে আবার ময়দানে ফেরত পাঠাতেন। আলস্নাহ বলেন, “মো’মেন পুরুষ ও মো’মেন নারী, তারা একে অপরের বন্ধু বা সহযোগী। তারা সৎ কাজের আদেশ দেয়, এবং অসৎ কাজের নিষেধ করে। সালাহ কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, আলস্নাহ ও তাঁর রসুলের আনুগত্য করে। [আল কোর’আন: সুরা তাওবা ৭১] সুতরাং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে বাধাদানের দায়িত্ব পুরুষদের একার নয়, নারীরও। কোনো ইজমা কিয়াস করে আলস্নাহর এই সুস্পষ্ট নীতিকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া যখন আলস্নাহর দীনই জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত নেই, তখন দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামই মুসলিম জাতির প্রধান দায়িত্ব। এ মুহূর্তে পর্দার বাড়াবাড়ি করে অর্ধেক জনশক্তিকে সংগ্রামে বিরত রাখা আত্মক্ষাতী কাজ। এখন সংগ্রাম করতে গিয়ে কারো যদি কোনো ত্রুটি হয়েও যায়, সেজন্য আল্লাহর নিশ্চয়ই রক্ষা করবেন।
তাই যে যত ইচ্ছা গালিগালাজ করে করুক। এসব ‘মহান গালিবাজদের’ হাত থেকে নবী-রসুলরাও রেহাই পান নি, আমরা তো সামান্য মানুষ। তবে একটা প্রশ্ন রাখতে চাই, যারা নারীদের নিয়ে অশ্লীল মন্তব্য করে বিকৃত আনন্দ পেতে চান তারা কি ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক কাজ করছেন? আমি যা বোঝাতে চেষ্টা করলাম তা হলো, এখন সময় সংগ্রামের। সকল অন্যায় অবিচার – সেটা ধর্মের নামেই হোক বা কোনো তন্ত্রের নামেই হোক, আমরা তার বিরুদ্ধে যদি এক হতে পারি, তাহলে দীনের বিজয়, মানবতার বিজয় সুনিশ্চিত ইনশাল্লাহ।