হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?

মোহাম্মদ আসাদ আলী

এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? মানুষ কেন এত হিংস্র হয়ে উঠছে? কেন সমাজ থেকে দয়া-মমতা জিনিসটা উঠে যাচ্ছে? যে মানুষ নিজেকে সৃষ্টির সেরা জীব বলে গর্ব করে, সেই মানুষ কেন পশুর চেয়েও নির্মম ও নিষ্ঠুর আচরণ করছে নির্বিকারভাবে?
গত সাত দিনের মধ্যে কমপক্ষে দশটি খুন/ধর্ষণের ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে যে ঘটনাগুলো বিশ্বাস করা কঠিন। ভাই ভাইকে হত্যা করেছে, সন্তান বাবা-মাকে হত্যা করেছে, বাবা মা সন্তানকে হত্যা করেছে, স্বামী তার স্ত্রী/সন্তানকে হত্যা করেছে, বাবা তার মেয়েকে ধর্ষণ করেছে- এ যেন কোনো মানুষের সমাজের চিত্র নয়, বরং ভয়াবহ এক নরকের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে পত্রিকার পাতায় পাতায়। এই অবস্থা প্রমাণ করে হিংস্রতা, নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও স্বার্থপরতার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে আমাদের সমাজ।
গত ৩১ আগস্ট রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে এক গৃহবধূ ও তার দেড় বছর বয়সী শিশুর মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থানার এসআই হুমায়ুন কবির বলেন, ধারণা করা হচ্ছে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামী অহিদ তার স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যা করেছে।
একই দিন পুলিশ কক্সবাজারের উখিয়ায় এক দম্পতিকে গ্রেফতার করে, যাদের কর্মকাণ্ড জেনে হতবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাদের পৈশাচিকতা পিশাচকেও হার মানিয়ে দেয়। সৎ বাবা ও আপন মা মিলে চার বছরের শিশুকে পৈশাচিক নির্যাতন করে হত্যা করেছে বলে পুলিশ জানায়। শিশুটির সৎ বাবা ও মা প্রায় দুই মাস ধরে শিশুটিকে বিভিন্ন সময়ে অমানবিক নির্যাতন করত। কখনো প্লাস্টিকের রশি দিয়ে ঘরের চালের তীরের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে, কখনো মাথায় আঘাত করে, কখনো গালে কামড় বসিয়ে আবার কখনো বা পেটে-পিঠে ঘুষি মেরে চালানো হত অমানবিক পৈশাচিক নির্যাতন। অসহনীয় ব্যথায় শিশুটির চিৎকারেও ঘাতক বাবা নুরুল হক কিংবা মা বুলবুল আক্তারের মন গলেনি। তাদের পাশবিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে মারা যায় সুমাইয়া আক্তার। এরপর শিশুটিকে ঘরের মেঝেতে পাটির উপর শুইয়ে কম্বল চাপা দিয়ে ঘর তালাবদ্ধ করে ঘাতক বাবা ও মা পালিয়ে যায়। একজন মা কীভাবে তার অবুঝ সন্তানকে হত্যা করতে পারে, তা ব্যাখ্যা করার সামর্থ্য হয়ত কারো নেই।
এদিকে গত ৩ সেপ্টেম্বর তিনটি নৃশংস ঘটনা পত্রিকার পাতায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয়, যে ঘটনাগুলো শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। প্রথম ঘটনাটি নড়াইলের। বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে রাজি না হওয়ায় হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে পাষণ্ড স্বামী রকিবুলের বিরুদ্ধে। একই দিন মাদারীপুরের কালকিনিতে বড় ভাইকে হত্যার অভিযোগে ছোট ভাই কালাম বেপারীসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অন্যদিকে যশোরে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চাচাতো ভাইয়ের হাতে খুন হন ইমামুল আলম নামের এক ব্যক্তি।
এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর আরও তিনটি পৈশাচিক ঘটনার খবর গণমাধ্যমের পাতায় শিরোনাম হয়। বর্বরোচিত এই ঘটনাগুলো হলো- যশোরের ঝিকরগাছায় পরকিয়ার জেরে স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই খুন, নেশার টাকা না পেয়ে ছেলের হাতে বাবা খুন, এবং চাচাকে গালাগালির প্রতিবাদ করায় বাবাকে খুন। খেয়াল করে দেখুন কে খুন করছে, কাকে খুন করছে, কেন খুন করছে!
এগুলো কি শুধুই একেকটি সংবাদের শিরোনাম? নাকি একটি সমাজের ধ্বংসের আলামত? কোথায় হারিয়ে গেল আমাদের পারিবারিক বন্ধন? কোথায় হারিয়ে গেল পবিত্রতম ভালোবাসার সম্পর্কগুলো?
না, এখানেই শেষ নয়। আমাদের সমাজের ঘৃণ্য বাস্তবতার আরেক রোমহর্ষক দৃশ্য এখনও বাকি আছে। গত ৫ আগস্টের ঘটনা। ফরিদপুরের সালথা উপজেলায় একটি মেয়ে বিষ পান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। মেয়েটি সুস্থ হয়ে ওঠে, কিন্তু কেন সে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল সে প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি যা বর্ণনা দেয় তা জানার পর কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ স্থির থাকতে পারে না। মেয়েটি জানায় তার বাবার অপকীর্তির কথা। মেয়েটিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে প্রায়ই ধর্ষণ করা হত, আর তা করত আপন জন্মদাতা পিতা। এই কথা মেয়েটি কারো কাছে বলতেও পারত না, মেনেও নিতে পারত না। এক পর্যায়ে সে আত্মহত্যা করার পথ বেছে নেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের পাল্লা ভারি হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার সামাজিক অপরাধ বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মারামারি, সংঘাত ইত্যাদি লেগেই আছে। আমাদের দেশেও এসমস্ত অপরাধ তুঙ্গে। এই অবস্থায় পরিবারই মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল ও নিরাপদ অবলম্বন হয়ে টিকে ছিল এতদিন। এক ভাই আরেক ভাইয়ের সাহস বাড়াত, পিতার আশীর্বাদের হাত পুত্রের মনে ভরসা যোগাতো, মা বাবা ভাই বোন চাচা দাদা সবাই মিলে একে অপরের বিপদে আপদে হাসি আনন্দে সাধে আহ্লাদে এগিয়ে আসত। এই পারিবারিক সম্পর্কগুলো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ও মমতায় ঘেরা এমন এক নিরাপদ শান্তির বলয় তৈরি করে দিত যা কখনও টাকা দিয়ে কিনতে পাওয়া যায় না। কিন্তু সেই সুন্দরতম সম্পর্কগুলোও আজ স্বার্থপরতা ও হিংস্রতার থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠছে কেন তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।
যখন কোনো ভাই তার ভাইয়ের হাতে নিরাপদ থাকে না, কন্যা তার পিতার কাছে নিরাপদ থাকে না, পিতা তার সন্তানের কাছে নিরাপদ থাকে না, স্বামী তার স্ত্রীর কাছে নিরাপদ থাকে না, সন্তান তার মায়ের কাছে নিরাপদ থাকে না- তখন সেই সমাজে দ্রুতই হতাশা, ক্ষোভ, বিদ্বেষ, হিংস্রতা ও পাশবিকতা ছড়িয়ে পড়ে এবং দিনকে দিন তা লাগামহীনভাবে বাড়তেই থাকে। এভাবেই একটি সমাজ ধ্বংস হয়, জাতি ব্যর্থ হয়, সভ্যতার পতন ঘটে।
মানুষের ইতিহাস ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্বের ইতিহাস। এই ইতিহাস পরিক্রমায় এমন সময় এসেছে যখন সমাজে ন্যায়ের রাজত্ব কায়েম হয়েছে, মানবিক গুণসম্পন্ন বিশুদ্ধ চরিত্রের মানুষের প্রচেষ্টায় সমাজ হয়েছে আলোকিত। আবার কখনও এমন সময় এসেছে সমাজে অন্যায় ও অসত্যের জয় হয়েছে, অধিকাংশ মানুষ হয়ে উঠেছে পাশবিক চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু তারপরও বলতে হয়- আজ একবিংশ শতাব্দীর মানুষ নৈতিক চরিত্র হারাতে হারাতে যেখানটায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। অতীতে কখনও মানুষ এতটা পাশবিক হতে পেরেছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
এই অবস্থার কারণ হিসেবে অনেক বিশ্লেষক দায়ী করছেন প্রচলিত ভোগবাদী ও বস্তুবাদী জীবনদর্শনকে। এই বস্তুবাদী জীবনদর্শন মানুষকে কেবল জীবনের একটি দিক শেখায়- দেহের দিক, বস্তুর দিক, ভোগের দিক, ইহকালের দিক। কিন্তু জীবনের অন্যদিকটি অবহেলায় অনাদরে পড়ে থাকে।
মানুষের দেহ ছাড়াও আত্মা আছে, ইহকালের পর পরকালও আছে। সেই আত্মা ও পরকাল ভুলে গিয়ে মানুষকে এমন এক মরীচিকার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে যেখানে মানুষ সবকিছু পেতে গিয়ে সবকিছুই হারিয়ে ফেলছে। সামান্য ইন্দ্রীয়-সম্ভোগ বা বৈষয়িক স্বার্থের পেছনে দৌড়তে গিয়ে পবিত্র সম্পর্কগুলো অকাতরে নষ্ট করে দিচ্ছে। তারপর একুল ওকুল দুকুলই হারাচ্ছে। কারণ এই বস্তুবাদী জীবনদর্শন মানুষের সামনে অসীম চাহিদা ও অসীম ক্ষুধা সৃষ্টি করে দেয়, যে ক্ষুধা কোনোদিনই মিটবে না। সারা পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ পেয়ে গেলেও সে ক্ষুধার্তই থাকবে, তার চাই চাই ফুরাবে না। আর সুখ ও শান্তি নামক সোনার হরিণটাও সে কোনোদিন খুঁজে পাবে না।
এই ভোগবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন মানুষকে দিনশেষে আত্মপ্রতারণা ছাড়া কিছুই দিতে সক্ষম নয়- কিন্তু সেটা বোঝার আগেই মানুষ তার দেশ, সমাজ, পরিবার এমনকি নিজের জীবনকে ধ্বংস করে ফেলছে, যার আশু সমাধান খুঁজে বের করা সময়ের দাবি নয় কেবল, মানবজাতির অস্তিত্বের প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...