মোহাম্মদ আসাদ আলী
মহান আল্লাহ সুরা ইয়াসীনের ২১ নং আয়াতে বলেছেন, “তোমরা তাদের এত্তেবা (আনুগত্য, পেছনে দাঁড়ানো, অনুসরণ) করো, যারা তোমাদের কাছে বিনিময় চায় না এবং যারা হেদায়াতে আছে।” শুধু এই একটি আয়াতই নয়, সমস্ত কোর’আন জুড়েই এমনভাবে ছড়িয়ে আছে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লাদের সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশনা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- ‘যে হাদিস-কোর’আনে ধর্মব্যবসায়ীদের কুৎসিত চেহারা প্রকাশ করা হয়েছে, সত্যান্বেষী মানুষের প্রকৃত মুক্তির দিশা দেওয়া আছে সেই ধর্মগ্রন্থসমূহই আজ ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে কুক্ষিগত। ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তারা ধর্মের প্রকৃত রূপকে আড়াল করতে এতটুকু দ্বিধা করেন না, নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে, ইচ্ছার রঙ্গে রাঙ্গিয়ে ধর্মকে রঙ্গিন করে মানুষের সামনে পেশ করে ব্যবসা করাই হলো তাদের নিত্য দিনের কাজ। উপরোক্ত আয়াতে আমরা দুইটি বিষয়ের ধারণা পাই। এক, যারা ধর্মের বিনিময় নেয় তাদের অনুসরণ করা যাবে না। দুই, অনুসরণ করতে হবে তাদের যারা হেদায়াতে আছে। প্রথমে ধর্মের বিনিময়ের বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। যেকোনো চিন্তাশীল মানুষই অস্বীকার করতে পারবেন না যে, ধর্ম আজ ব্যবসায়ীক পণ্যে পরিণত হয়েছে। যারা সকাল-সন্ধ্যা, উঠতে বসতে ধর্মের বুলি আউড়িয়ে থাকেন সেই মোল্লা-পুরোহিতরাই বর্তমানে ধর্মের মাঝে শত শত ব্যবসায়ীক সিন্ডিকেট তৈরি করে রেখেছেন। টাকা ছাড়া ধর্মের চাকা এখন মোটেও ঘুরে না। মো’মেন-মুসলিম ও উম্মতে মোহাম্মদী হিসেবে জাতির দায়িত্বকে ভুলিয়ে দিয়ে আলেম নামধারী এই মহা মুসলিমগণ জাতির লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। তাদের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ফলশ্রুতিতে জাতি আজ মাকড়সার দুর্ভেদ্য জালে আটকা পড়ে রয়েছে, যে জাল হতে বের হবার কোন চেষ্টাও তারা করছে না। কারণ এই জাতির ধর্মীয় চোখ অন্ধ। তারা ধর্মকে দেখে থাকেন এই আলেম-মাওলানা শ্রেণির চোখ দিয়েই। স্বার্থবাদী এই শ্রেণিটি তাদের ধর্মব্যবসাকে চাঙ্গা করতে যে যে ফতোয়া দেয় তাই এই কোর’আন-হাদিস সম্পর্কে অনবহিত বৃহত্তর জনসাধারণ অকাট্য সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। প্রকৃত ইসলামের যারা ধারে কাছেও নেই সেই ফতোয়াবাজদেরই তারা নবী-রসুলদের উত্তরসূরী হিসেবে জ্ঞান করে থাকে। আর এই সুযোগেই এই শ্রেণিটি তাদের আখের গুছিয়ে চলেছে। উপরোক্ত আয়াত (ইয়াসিন-২১) মোতাবেক এই ধর্মব্যবসায়ী শ্রেণিটির অনুসরণ করা কতটুকু যথোপযুক্ত?
এবারে আসি দ্বিতীয় বিষয়ে অর্থাৎ, আল্লাহর ভাষ্যমতে অনুসরণ করতে হবে তাদেরকে যারা হেদায়াহপ্রাপ্ত। সুতরাং এখন জানা দরকার হেদায়াহ কী? এই হেদায়াহ সম্পর্কেও আজকের আলেম মাওলানারা বিভ্রান্তির শেষ রাখেন নি। বর্তমানের ধর্মব্যবসায়ী বিকৃত ইসলামের শেখানো আকিদায় ধর্মকর্ম করে না এমন একটি লোককে যদি উপদেশ দিয়ে নামাজ, রোজা করানো যায়, যাকাত দেওয়ানো যায়, মিথ্যা পরিহার করানো যায়, সত্য কথা বলানো যায়, এক কথায় সমস্ত রকম অন্যায়-মিথ্যাচার থেকে বাঁচিয়ে পবিত্র জীবন-যাপন করানো যায়, তবে বলা হয় লোকটি হেদায়াহ পেয়েছে। ভুল বলা হয়, সে হেদায়াহ পায় নি, সে তাকওয়া অবলম্বন করেছে অর্থাৎ মুত্তাকী হয়েছে। হেদায়াত ও তাকওয়া দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। হেদায়াত অর্থ সঠিক পথে চলা। আল্লাহ ও রসুল (সা.) যে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন, যে গন্তব্য স্থান নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন সেই পথে চলা। সেটা কোন পথ? সেটা হলো ‘‘সেরাতুল মোস্তাকিম’’ সহজ সরল পথ। ‘সেরাতুল মোস্তাকিম’ কী তা সংক্ষেপে আলোচনা করার দরকার। ইবলিস আল্লাহকে চ্যালেঞ্জ করেছিল যে- মাটি দিয়ে তৈরি আদমকে সে আল্লাহর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত করে তাকে তার নিজের তৈরি করা পথে নিয়ে যাবে যে পথে চললে তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হবে মানুষের জীবনের প্রতি ক্ষেত্রে অশান্তি, অবিচার এবং যুদ্ধ ও রক্তপাত। (ফাসাদ ও সাফাকুদ্দিমা)। আল্লাহ ইবলিসের ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন এবং তাকে বললেন, আমি যুগে যুগে নবী রসুল পাঠিয়ে মানবজাতিকে সঠিক পথ দেখাব যে পথে চোললে তারা ঐ অশান্তি-অবিচার, অত্যাচার ও রক্তপাতের মধ্যে পড়বে না। তারা সুবিচার পাবে এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এই পথের নামই তিনি দিলেন- সেরাতুল মোস্তাকিম; সহজ সরল পথ, “লা এলাহা এল্লাল্লাহ” আল্লাহ ছাড়া আর কোন এলাহ, বিধানদাতা নেই, প্রভু নেই। জীবনে চলার পথে যেখানে আল্লাহর কোন কথা আছে সেখানে আর কারও কোন কথা না মানা অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব। আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে মেনে চললেই মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে এবং ইবলিস পরাজিত হবে। মূল বিষয়টি এখানেই। এই আল্লাহর সার্বভৌমত্বই হলো হেদায়াহ ও পথভ্রষ্টতার মানদণ্ড। যারাই তাদের সমষ্টিগত জীবনে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠিত রেখে জীবন পরিচালনা করবে তারাই সঠিক পথপ্রাপ্ত, হেদায়াহপ্রাপ্ত। আর যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অস্বীকার করবে তারাই পথভ্রষ্ট, ইবলিসের দলে। তারা যতই নামাজ, রোজা করুক না কেন যত বড়ই আলেম মাওলানা হোক না কেন – তারা হেদায়াহ প্রাপ্ত নয়। এই হিসেবে আমাদের আলেম মাওলানা, মোফাসসের, মোহাদ্দেস, পুরোহিত শ্রেণি কি হেদায়াহপ্রাপ্তদের মাঝে পড়েন? এটা কোন নতুন কথা নয় যে, আজকের এই ধর্মজীবী আলেম মোল্লাদের কাছে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কোন বিষয়ই নয়। কার তৈরি সিস্টেমে জাতীয় জীবন পরিচালিত হচ্ছে, কোন আইন-দণ্ডবিধি মোতাবেক তাদের রাষ্ট্র চোলছে, কোন অর্থনৈতিক সিস্টেমে তাদের অর্থনীতি চোলছে সে সম্পর্কে তারা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করেন না বরং তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ রোয়েছে কোন পা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে হবে, তারাবীহ নামাজ কয় রাকাত পড়তে হবে, কোরবানির গরু কীভাবে জবাই দিতে হবে, কোন সুরা পড়লে কত নেকী পাওয়া যাবে, পাঞ্জাবী-পাজামা কীভাবে পরতে হবে ইত্যাদি তুচ্ছ বিষয়াবলীর প্রতি। সংগ্রাম করে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে প্রতিষ্ঠা করার কথা তারা স্বপ্নেও ভাবেন না। ভাবেন না, কারণ রাষ্ট্রীয়ভাবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গেলে অনেক কষ্ট করতে হবে, কোরবানি করতে হবে, জীবন হারাতে হবে কিন্তু নামাজ পড়াতে, ওয়াজ করতে, যেকের করতে ও মিলাদ পড়াতে কোন কোরবানির প্রয়োজন পড়ে না, উল্টো টাকা-পয়সা, ভালো খাবার-দাবার পাওয়া যায়। তাহলে যে আলেম নামধারী কার্যতঃ ইবলিসের অনুসারী এই শ্রেণিটি হেদায়াহর ধারে কাছেও নেই, তাদের অনুসরণ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?
যুক্তিযুক্ত তো নয়ই বরং তা আল্লাহর হুকুম অমান্য করা। কাজেই সময় এসেছে এই ধর্মজীবীদের হাত থেকে জাতির মুক্ত হবার, সময় এসেছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত হেদায়াতে ফিরে যাবার, যে হেদায়াহ ছাড়া সারা মাসের রোজা এবং সারা রাত্রির নামাজও গ্রহণ করা হবে না।