দাজ্জালীয় সভ্যতার গোলামী ছেড়ে আল্লাহর হুকুমের উপর জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে আলেমদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম। গতকাল রাজধানীর উত্তরা ফ্রেন্ডস ক্লাব মিলনায়তনে আলেমদের নিয়ে হেযবুত তওহীদের এক মতবিনিময় সভায় মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য দানকালে তিনি এ আহ্বান জানান। ‘অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনে আলেমদের ভূমিকা’ শীর্ষক এই মতবিনিময় সভায় দেশবরেণ্য আলেমগণ উপস্থিত ছিলেন।
সভায় তিনি বলেন, বর্তমান মুসলিম নামধারী জনগোষ্ঠী আজ থেকে কয়েকশ’ বছর আগেই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব বাদ দিয়ে দাজ্জালের সার্বভৌমত্ব গ্রহণ করে নিয়েছে। আজ তাদের সমগ্র জীবন চলে দাজ্জালের হুকুমে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তারা নামাজ, রোজা, হজ্ব, ঢিলা, কুলুখ, টুপি-পাগড়ি ইত্যাদি আমল করেই জান্নাতে যাওয়ার দিবাস্বপ্ন দেখছেন। আপনারা যারা হক্কানি আলেম আছেন তারা এই অন্ধত্বের কারাগার ভেঙে জাতিকে মুক্ত করুন।
এ সময় হেযবুত তওহীদের এমাম মুসলিম জাতির উত্থান পতনের ইতিহাস ও সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের উপর বিষয়ভিত্তিক বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, ‘আলেম হচ্ছে দুই প্রকার। হক্কানী আলেম ও ধর্মব্যবসায়ী আলেম। হক্কানী আলেমগণ নবী-রসুলদের ওয়ারিশ। তারা জ্ঞানার্জন করেন মানবতার কল্যাণের জন্য এবং জ্ঞান বিতরণও করেন মানবতার কল্যাণের জন্য। কোনো স্বার্থের তালাশ করেন না। আরেকদিকে আছে ধর্মব্যবসায়ী আলেম। তারা এলেমকে রোজগারের হাতিয়ার বানিয়ে নেয় এবং আল্লাহর দ্বীনকে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে, সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়, ধর্মকে ব্যবহার করে অপরাজনীতি করে। হেযবুত তওহীদ এই ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে দিয়েছে। ফলে এরা হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে।’
ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারের নমুনা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন আগে একটি মসজিদের খতিবের ভিডিও বক্তব্য দেখলাম। তিনি অগণিত মানুষের সামনে একটি ডাহা মিথ্যা কথা অনায়াসেই বলে দিলেন যে, হেযবুত তওহীদ নাকি মাত্র দুই ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। এত বড় মিথ্যা বলার আগে তার একটুও আত্মা কাঁপল না! এভাবেই হাজার হাজার মিথ্যা অপবাদ তারা হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে ছড়িয়ে দিচ্ছে যা আমরা কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। তাদের মিথ্যাচারের কারণে কী পরিমাণ নির্যাতিত, নিপীড়িত আমরা হয়েছি সেটা একমাত্র আমরাই জানি। আমার বাড়িতে এ পর্যন্ত চারবার হামলা করেছে মানুষ। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কেন আমাদের বিরুদ্ধে লেগেছে? কারণ প্রথমত তাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে। হেযবুত তওহীদের কারণে তাদের লেবাসের অন্তরালের কুৎসিত চেহারা মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। আর দ্বিতীয়ত- অহংকার। আমরা এত বছর মাদ্রাসায় পড়েছি, এত বড় আলেম হয়েছি, আমরা ইসলাম বুঝি না তোমরা বোঝো? এই জ্ঞানের অহংকার!’
হেযবুত তওহীদের এমাম বলেন, ‘যে জ্ঞান মানবতার কল্যাণে কাজে লাগে না সেটা বিষাক্ত। ‘ধর্মব্যবসার ফাঁদে’ নামের একটি বই প্রকাশ করেছি আমরা। দ্বীনের কাজ করে কোনো বিনিময় গ্রহণ করা হারাম এটা যে আমাদের মনগড়া কথা নয়, আল্লাহর কথা সেটা বইটি পড়লে বুঝবেন। আমরা কোর’আন থেকে তুলে ধরেছি, হাদিস তুলে ধরেছি, বিভিন্ন আলেমদের মতামত তুলে ধরেছি। সবকিছুর রেফারেন্স আছে। আমার একটা লাইনকেও আজ পর্যন্ত কেউ মিথ্যা প্রমাণ করতে পারে নাই। যেটা সত্য সেটাই লিখেছি। আর এজন্যই ধর্মব্যবসায়ীরা সরাসরি আমাদের সামনে দাঁড়ায় না, আমাদেরকে যৌক্তিকভাবে মোকাবেলা করতে ভয় পায়। তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে অপবাদ রটায়।’
এমাম বলেন, ‘আজকে ইসলামের ভিন্ন ভিন্ন রূপ দাঁড়িয়ে গেছে। যেমন, রাজনৈতিক ইসলাম, সুফিবাদী ইসলাম, জঙ্গিবাদী ইসলাম, ব্যক্তিগত ইসলাম ইত্যাদি। রাজনৈতিক ইসলামের নামে অনেকগুলো দল। একেক দলের একেক মার্কা। আমার প্রশ্ন হলো কোন মার্কায় ভোট দিলে জান্নাত পাওয়া যাবে? জান্নাতের রাস্তা কি এতগুলো? আরেকদিকে সুফিবাদী ইসলামে পীরের ছড়াছড়ি। হাজার হাজার পীর, হাজার হাজার তরিকা। আল্লাহর রসুলের তরিকা কি এতগুলো? আরও আছে হাজার হাজার জঙ্গিবাদী দল। আর এইসবের বাইরে বৃহত্তর জনসাধারণ কোনো দিকে না তাকিয়ে, সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে ব্যক্তিগত নামাজ রোজা ইত্যাদি করেই জান্নাতে যাবার স্বপ্ন দেখে। কার হুকুমে সমাজ চলছে, আল্লাহর নাকি ইবলিসের সেটাও তাদের দেখার বিষয় নয়। অথচ ইসলামের ভিত্তিই হলো- আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম মানব না।’
তিনি উপস্থিত আলেমদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, ‘আমি সবার কাছে জানতে চাই- আল্লাহর রসুল কেন দুনিয়াতে এসেছিলেন? তিনি কি পীর দরবেশ তৈরির জন্য এসেছিলেন? রাজনীতিক নেতা তৈরি করতে এসেছিলেন? ওয়াজ মাহফিলের বক্তা তৈরি করতে এসেছিলেন? মোটেও নয়। তিনি কেন এসেছেন সেটা আল্লাহ বলেছেন পবিত্র কোর’আনে, ‘সমস্ত দ্বীনের উপর হেদায়াহ ও সত্যদ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য।’ দ্বীন মানে হলো জীবনব্যবস্থা। অর্থাৎ আমার ফ্যামিলি কীভাবে চলবে, সমাজ কীভাবে চলবে, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, আইন-কানুন, দ-বিধি ইত্যাদি কীভাবে চলবে সেটার সিস্টেম বা ব্যবস্থাই হলো দ্বীন। এটা সামষ্টিক বিষয়। এজন্যই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা করতে হয় সবার আগে। প্রতিষ্ঠা করতে হয় পুরো মানবজীবনে। আর এই কাজটি করার জন্যই আল্লাহর রসুলের আগমণ। সারা পৃথিবীতে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে অন্যায়, অবিচার, অশান্তি, রক্তপাত, বৈষম্য বন্ধ করে দিয়ে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহর রসুল এসেছিলেন।’
তিনি আরবদের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ‘আরবে চলছিল ‘মাইট ইজ রাইট’ এর শাসন। শক্তিমানের কথাই বিবেচিত হত ন্যায় হিসেবে। সেখানে বঞ্চিত জনগণের কোন অধিকার ছিল না, সেখানে সুবিধাভোগীরাই ছিলেন সমাজের হর্তাকর্তা, সেখানে ধর্মের নামে চলত অধর্ম, আল্লাহর নির্দেশনা ভুলে গিয়ে তারা নিজস্ব মনগড়া বিধান দিয়ে সমাজ পরিচালনা করত। এই অবস্থায় মানুষের না ছিল সামাজিক নিরাপত্তা, না ছিল ঘরে নিরাপত্তা, না ছিল বাহিরে নিরাপত্তা। সেই অবস্থা নিরসনকল্পে রসুলল্লাহ ন্যায়ের ঘোষণা দিলেন। যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের ঘোষণাই হল কলেমা তওহীদের মূল কথা। এক আল্লাহর হুকুম ছাড়া কারো হুকুম চলবে না, তোমাদের কারো মত চলবে না, কারো মাতব্বরি চলবে না, কারো মনগড়া কথা চলবে না। যেটা ন্যায় সেটা ন্যায়, যেটা হক সেটা হক, যেটা সত্য সেটাই সত্য। আল্লাহ হলেন সেই ন্যায়ের ধারক। তার হুকুম চলবে। এই কথাটা বলার সাথে সাথে তৎকালীন ধর্মব্যবসায়ী কাবার পুরোহিতরা দেখল- সর্বনাশ, আমাদের কায়েম করে রাখা এই সমাজ ব্যবস্থা তো থাকবে না, আমাদের ভোগ বিলাসিতা শেষ হবে, আমরা জনগণকে বোকা বানিয়ে রেখেছি এটা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই তারা রসুল (স.) কে প্রতিহত করা শুরু করে দিল।’
বর্তমান মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ‘নামধারী মুসলিম’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘আজ সারা পৃথিবীতে মুসলিম জাতির জীবনে অমানিশার ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে। একটির পর একটি মুসলিমপ্রধান দেশ ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। মাত্র দু’ মুঠো অন্নের জন্য মুসলিম মা-বোনরা নিজেদের ইজ্জত বিক্রি করছে। পেটের দায়ে নারীর শরীরবিক্রির উদাহরণ বহু আছে, কিন্তু মুসলিম পুরুষরাও দেহব্যবসায় নামতে বাধ্য হচ্ছে যখন, তখন বোঝা যায় কতটা নিরুপায় এই জাতি। ধর্ম ত্যাগ করা লাগলেও তারা ইউরোপে পাড়ি জমাতে দ্বিধা করছে না। এসব আপনাদের অজানা নয়। উম্মাহর জীবনের এতবড় অমানিশার অন্ধকার আগে কখনও আসে নাই। তাহলে এত আলেম ওলামা, এত লেবাস, এত জিকির আজগার, এত ওয়াজ-মাহফিল, এত মসজিদ-মাদ্রাসা, এত পীরের আস্তানা- এসবের কী মূল্য থাকল? এতকিছুর পরও কেন উম্মাহর আজ এই দশা? এর কারণ আমার জানা ছিল না। আমি জানতে পারি এমামুযযামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর কাছ থেকে। তিনি বলেছেন, ওহে মুসলমান, তোমরা যেটাকে ইসলাম মনে করে পালন করছো, প্র্যাক্টিস করছো সেটা প্রকৃত ইসলাম নয়। আল্লাহ রসুলের সংজ্ঞা মোতাবেক তোমরা মুসলিম নও।’
হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম ধর্মব্যবসায়ী আলেমদের ব্যাপারে বলেন, ‘তাদের প্রধান ভুলটা হলো- জাতি যখন দাজ্জালের গোলামি করছে, আল্লাহর হুকুম কোথাও চলে না, তারা এই অবস্থাতেও মানুষকে সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে যে, তোমরা মুসলমান, তোমরা ঠিকই আছো, কিছু গুনাহ হলেও সেটা মাফ হয়ে যাবে, জান্নাতে চলে যাবে। তোমরা প্রকৃত ইসলামেই আছো। ব্যস। মানুষ আর চোখ মেলে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করছে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর চেতনাবোধ হারিয়ে ফেলছে। এরা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কিন্তু কোনো বিকার নেই। এর দায় কি ধর্মব্যবসায়ীরা অস্বীকার করতে পারবেন?’
বক্তব্যের এক পর্যায়ে হেযবুত তওহীদের এমাম আলেমদের প্রতি প্রস্তাবনা পেশ করেন। তিনি হক্কানী আলেমদের প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা ধর্মব্যবসায়ীদের অপপ্রচারের ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক করেন।