শেখ মনিরুল ইসলাম
পৃথিবীর সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য, হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধ, রক্তপাত ইত্যাদি নির্মূল হতে পারে একমাত্র ঐক্যের সূত্র ধরে। এখন প্রয়োজন শুধু নিজ নিজ ধর্মের শাশ্বত শিক্ষায় সকল ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। প্রশ্ন হচ্ছে- ধর্মের ঐ শাশ্বত শিক্ষা কী? এই শাশ্বত শিক্ষা হচ্ছে মানবতা। সকল ধর্মই মানবতার কথা বলে, মানবতার কল্যাণ সাধনে মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। প্রতিটি ধর্মের ধর্মগ্রন্থে যে মানবতাবোধ শিক্ষা দেওয়া হয়েছে তা যদি আজকের মানবজাতি অনুধাবন করতে পারত, সে অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালনা করতে সক্ষম হতো তাহলে সম্পূর্ণ পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যেত। আজ যেমন মানুষ অন্যায়-অবিচারের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে তার ঠিক বিপরীত পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো, অর্থাৎ মানুষ শান্তির চির আকাক্সিক্ষত বাস্তবিক রূপ দেখতে পেত। মানবতা হলো ধর্মের আত্মা। দেহ থেকে আত্মা পৃথক করা আর ধর্ম থেকে মানবতা পৃথক করা একই কাজ। পরিণতিও অভিন্ন, অর্থাৎ মৃত্যু। যে দেহে আত্মা নেই সে দেহের কোনো মূল্য থাকে না, অচিরেই তা পচে-গলে নষ্ট হয়ে যায়, এক সময় তার আর অস্তিত্ব থাকে না। একইভাবে আজকের পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগুলো মানবতা থেকে বহু দূরে সরে যাওয়ায় ধর্মগুলো মানুষের কোনো উপকারে আসছে না, বরং ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা ধর্মের ব্যর্থতা নয়, ধর্মকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে মানুষের ব্যর্থতা।
বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় জাতি হলো খ্রিস্টান। পৃথিবীতে প্রায় দু’শ কোটির অধিক খ্রিস্টধর্মের অনুসারী রয়েছেন। তারা যদি সত্যিকার অর্থেই যিশু খ্রিস্টের প্রদত্ত শিক্ষাকে অনুধাবন করে কার্যক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটাতে পারতেন তাহলে পৃথিবীর অশান্তির কিছুটা হলেও প্রশমিত হতো। যিশু খ্রিস্ট কী শিক্ষা দিয়েছেন? আসুন বাইবেলে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তা জানার চেষ্টা করি।
পথ দিয়ে যাবার সময় ঈসা (আ.) একজন অন্ধ লোককে দেখতে পেলেন। অন্ধ ব্যক্তিটি জন্ম থেকেই অন্ধ ছিলেন। তাকে দেখে ঈসা (আ.) মাটিতে থুথু ফেলে কাদা করলেন। তারপর সেই কাদা তিনি অন্ধ লোকটির চোখে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও শীলোহের পুকুরে গিয়ে ধুয়ে ফেল। অন্ধ লোকটি তখন পুকুরে গিয়ে চোখ ধুয়ে ফেলল। সে অভিভূত হয়ে গেল কারণ, সে চোখে দেখতে পাচ্ছিল। তার দৃষ্টিশক্তি তৈরি হওয়ায় সাধারণ মানুষ অবাক হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল, এ কি সেই লোক, যে কিছুক্ষণ পূর্বে ভিক্ষা করছিল? দৃষ্টি ফিরে পাওয়া ব্যক্তিটি বললেন, হ্যাঁ, আমি সেই লোক। ঈসা (আ.) আমার দৃষ্টিশক্তি দান করেছেন।
বস্তুত দিনটি ছিল ইহুদিদের বিশ্রামবার। ইহুদি ধর্মের অন্যতম প্রধান বিধান হলো সপ্তাহে একদিন, শনিবার, জাগতিক কোনো কাজকর্ম না করে শুধু ধর্ম-কর্ম করা এবং সিনাগগে যেয়ে উপাসনা করা। এর নাম স্যাবাথ। ঈসা (আ.) দৃষ্টিহীনকে দৃষ্টিশক্তি দান করে সেই স্যাবাথের নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন। এতে ইহুদি ধর্মীয় নেতা ফরীসীরা প্রচণ্ড রেগে যায় এবং দৃষ্টি ফিরে পাওয়া ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বের করে দেয়। (new testament. john 9: 01-34)
স্যাবাথের আদেশ বাইবেলে (নিউ টেস্টামেন্টে) আছে এবং এটা যে রাব্বাই, ফারিসী অর্থাৎ পুরোহিতদের মনগড়া মতবাদ ছিল না তার প্রমাণ- এ কথা পবিত্র কোর’আনেও আছে (সুরা আন নহল- ১২৪)। এখন বাইবেলে (New Testament) পাচ্ছি যে, ঈসা (আ.) বছরের পর বছর ভিক্ষা করছে এমন একজন জন্মান্ধের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিলেন এবং দিলেন ঐ স্যাবাথের দিনে, শনিবারে। ঐ জন্মান্ধটি তো সারা জীবনই ঐ স্থানে বসে ভিক্ষা করছিলেন। জন্মান্ধকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেয়াই বা অলৌকিক শক্তি (মো’জেজা) দেখানোই যদি তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য হতো তবে ঈসা (আ.) শনিবার ছাড়া অন্য যে কোনোদিন কি তা করতে পারতেন না? পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে বেছে ঐ স্যাবাথের দিনটাতেই ঐ কাজ করলেন। এটা দ্বারা তিনি তাঁর জাতির জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
ঈসা (আ.) কর্তৃক সেদিনের বিধান ভঙ্গের অন্যতম কারণ ছিল এটা বোঝানো যে, ‘মানবিক কাজ বা মানবতার কল্যাণ সাধিত হয় এমন কাজ ঐ স্যাবাথের অর্থাৎ আইনের দোহাই দিয়ে বাদ দেয়ার অর্থ হলো ধর্মের আত্মাকে ধর্ম থেকে পৃথক করে রাখা। বস্তুত মানবতার জন্যই ধর্ম, কাজেই ধর্মের আইন-অনুশাসন কোনোভাবেই মানবতার কল্যাণের পথে বাধা হতে পারে না। যে ধর্ম মানবতার বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা ধর্ম নয়, অধর্ম। সেটা পালন করে স্বর্গে আরোহনণ করা যায় না। এটাই ঈসা (আ.) এর শিক্ষা।