“আপনার তাসবিহ পাঠ ও গুণকীর্তন করার জন্য আমরাই কি যথেষ্ট নই?”-যখন আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর খলিফা বা প্রতিভূ প্রেরণের ঘোষণা দিলেন তখন ঠিক এ প্রশ্নটিই করেছিল মালায়েক বা ফেরেশতাগণ। আল্লাহ বললেন, “আমি জানি, তোমরা জানো না।” (সুরা বাকারা ৩০)
বস্তুত আল্লাহ মানুষকে তাঁর তাসবিহ পাঠ ও গুণকীর্তন করার জন্য সৃষ্টি করেন নি। তিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। সেটা কীভাবে? সেটা হচ্ছে, আল্লাহ নিজে যে কাজ করেন সেই কাজটি পৃথিবীতে তিনি নিজে না করে মানুুষকে দিয়ে করাবেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, আল্লাহর কী কাজ? আল্লাহর কাজ হলো, তাঁর অসীম সৃষ্টিজগৎকে পরিচালনা করা। তিনি যা-ই হুকুম করেন, তাঁর সকল সৃষ্টিই সেটার আনুগত্য করে। আল্লাহর কোনো আদেশ অমান্য করার ক্ষমতাই তাদের নেই।
কিন্তু মানুষকে আল্লাহ নিজ রূহের মারফতে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। সে চাইলে আল্লাহর হুকুম মানতেও পারে, আবার চাইলে অমান্যও করতে পারে। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়ে সে কী করে সেটাই হচ্ছে মানুষের পরীক্ষা। পৃথিবী তার পরীক্ষার হল, এই জীবন তার পরীক্ষার জন্য বরাদ্দ সময়। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হলে তাকে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, এই জীবনে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করা। সেটা হচ্ছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে আগত হুকুম দিয়ে মানুষের সামগ্রিক জীবন পরিচালনা করা। অন্য সব সৃষ্টি আল্লাহর আনুগত্য করতে বাধ্য। সূর্য তার নির্দিষ্ট সময়ে উদিত হবে, পানি তার নির্দিষ্ট জীবনচক্রে আবর্তিত হবে। কিন্তু মানুষ আল্লাহর হুকুম মানবে স্বেচ্ছায়, জেনে বুঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে। তার মস্তিষ্কে মেধা ও চিন্তাশক্তি এজন্যই দেওয়া হয়েছে। সে চিন্তাহীন পশু নয়, প্রাণহীন জড়বস্তু নয়। তার ইচ্ছাশক্তিই তার পরীক্ষা, তার শ্রেষ্ঠত্বের কারণ।
এই ইচ্ছাশক্তি ব্যবহার করে সে যদি পৃথিবীতে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও হুকুম প্রতিষ্ঠা করে তাহলে সে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করল। তাহলে সে পৃথিবীতে শান্তিতে বাস করতে পারবে এবং পরকালেও পুরস্কৃত হবে। আর যদি সে নিজেই তার জীবনব্যবস্থা তৈরি করে সেটা দিয়ে মানবজীবন নির্বাহ করে তাহলে সে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করল না। সে প্রতিনিধিত্ব করল আল্লাহর বিরুদ্ধ শক্তির যাকে বলা হয় ইবলিস, শয়তান। এক্ষেত্রে সে পৃথিবীর জীবনে অশান্তিতে থাকবে এবং পরকালেও চিরস্থায়ী জাহান্নামের দণ্ড ভোগ করবে।
সুতরাং মানুষ কার প্রতিনিধিত্ব করছে সেটাই তার জান্নাত ও জাহান্নাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এখন যদি মানুষ আল্লাহর হুকুম দিয়ে জীবন পরিচালনা করে তাহলে সে জান্নাতে যাবে। তার ব্যক্তিগত পাপ আল্লাহ ক্ষমা করবেন। কিন্তু কেউ যদি মানুষের তৈরি জীবনব্যবস্থার অধীনে জীবনযাপন করে এবং সেটাকেই ন্যায়-অন্যায়ের মানদণ্ড বলে বিশ্বাস করে তাহলে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামে যাবে। তার কোনো ভালো কাজ বা আমলই তাকে জান্নাতে নিতে পারবে না।
সুতরাং প্রথম প্রশ্নই হচ্ছে, মানুষ কার প্রতি ঈমান রাখে। ধরে নেওয়া হচ্ছে, যার প্রতি সে ঈমান রাখে তার হুকুম দিয়েই জীবন পরিচালনা করবে। বাস্তব জীবনে আল্লাহর হুকুমকে, জীবনব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করে তাই সে ব্যক্তিগতভাবে যত নামাজ রোজাই করুক না কেন, সেগুলো আল্লাহ গোনায় ধরবেন না। সেগুলো নিষ্ফল আমল।
যখন মানুষ আল্লাহর হুকুমকেই ন্যায় ও অন্যায়ের মানদণ্ড হিসাবে গ্রহণ করবে তখনই বুঝতে হবে যে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে। আল্লাহর অস্তিত্বে ও গুণাবলীতে বিশ্বাস এক্ষেত্রে ঈমান বলে বিবেচিত হয় না। কারণ সেই বিশ্বাস ইবলিসেরও ছিল, আবু জাহেলেরও ছিল।