হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
পবিত্র ঈদ উল ফিতর উপলক্ষে হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে বাংলার ষোলো কোটি মানুষকে জানাই ঈদ মোবারক। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার পর আজ মুসলমানরা ঈদ উদ্যাপন করছেন। এই সওম বা রোজা হচ্ছে ইসলামের বুনিয়াদি পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে পঞ্চম বুনিয়াদ। এটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো মো’মেনের চরিত্রে কিছু গুণাবলী সংযোজন করা। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য একজন মো’মেনকে অবশ্যই চারিত্রিক পরিশুদ্ধি, সংযম, দৃঢ়তা, ক্ষুধার্তের প্রতি সহানুভ‚তি, নিজের ক্ষুধা-তৃষ্ণার বিষয়ে সহিষ্ণুতা অর্জন করা অপরিহার্য। এমন আরো বহুবিধ গুণাবলী মো’মেনের চরিত্রে এনে দেয় সওম। এই চরিত্র লাভ করলে আমরা স্রষ্টা কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালন করতে সমর্থ হবো। মানুষ সৃষ্টিলগ্নেই আল্লাহর খেলাফত অর্থাৎ প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব পেয়েছে। এই দায়িত্ব পালনের জন্য সে সত্য, সুন্দর পথে চলবে, ভ্রাতৃত্ব শিখবে, সত্য ও ন্যায়ের আনুগত্য করবে, সুশৃঙ্খল হবে, আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে শিখবে।
মো’মেনদের ক্ষেত্রে আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে বলেছেন, মো’মেনরা ভাই ভাই (সুরা হুজরাত ১০)। প্রথমে তারা আল্লাহর দেওয়া দীন অনুসরণ করে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন। তারা সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হবেন (সুরা সফ ৪)। তারা নিজেরা যেমন এই ঐক্যের মধ্যে থাকবেন তেমনি তারা একটি ঐক্যবদ্ধ জাতিও গড়ে তুলবেন। তারা যে আল্লাহর প্রতিনিধি, খলিফা তারা এর প্রমাণ দিবেন। পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মানুষকেও তারা ঐক্য, শৃঙ্খলা ও শান্তির মধ্যে রাখবেন। ঐক্যের মধ্যে শান্তি ও সুখ নিহিত। তাই তাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার ফলে সমগ্র পৃথিবীতে অনাবিল শান্তি-সুখ প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদেরকে আজ এ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য মোতাবেক আমরা মুসলিম দাবিদারগণ আজ পৃথিবীতে সংখ্যায় ১৮০ কোটি। এই ১৮০ কোটির মধ্যে সাড়ে ৬ কোটি কেবল উদ্বাস্তু। গত দুই দশকে এই জাতির অন্তত পঁচিশ লক্ষ মানুষ বৈদেশিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে তাদের বোমা ও বুলেটের আঘাতে, তাদের রাসায়নিক অস্ত্রের বিষক্রিয়ায় নির্মম মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের দেশগুলোয় আক্রমণ করে দেশবাসীকে বিতাড়িত ও হত্যা করে দখল করে নিচ্ছে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীরা। নতুন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র ‘উদ্বোধন’ করা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোতে। শত শত বছর থেকে চলে আসা শিয়া-সুন্নী ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত তো আছেই। হাজার হাজার ফেরকা, তরিকা, মাহজাবে বিভক্ত হয়ে এ জাতিটি আজ বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খল জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছে। ধর্মের নামে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মতের সৃষ্টি করে হরতাল, অবরোধ, ভাঙচুর, জ্বালাও পোড়াও ইত্যাদি জাতিবিনাশী কর্মকাণ্ড করে চলেছে। ফলে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরাজিত এই সমস্ত বিভক্তির প্রাচীর দিনকে দিন আরো পুরু হয়ে উঠছে। প্রতিটা সমাজে অন্যায়, অবিচার, ধর্ষণ, দ্বন্দ্ব , খুন, সন্ত্রাসবাদ এমনভাবে ভাইরাসের মতো বিস্তার লাভ করেছে যে, এখন পুরো জাতি দিশেহারা।
এ অবস্থায় আমাদের সবার জন্য জরুরি কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে জাতিকে আবারো সুখী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ করা। আমরা হেযবুত তওহীদ একজন মহান ব্যক্তির অনুপ্রেরণায় উজ্জীবিত হয়ে তওহীদের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়েছি। তিনি হলেন এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী, যিনি এই মাটিরই সন্তান টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী পন্নী পরিবারের একজন সদস্য। আমরা ইতিহাস থেকে জানি, আল্লাহর রসুলও (সা.) সেই আরবের বিশৃঙ্খল অসভ্য জাতিটিকে আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আমরা সেই সত্যটি লাভ করেছি যে মহাসত্য দিয়ে এই সমগ্র মানবজাতির জীবন থেকে অশান্তির আগুনকে নির্বাপিত করা যায়, পৃথিবীকে একটি শান্তির বাগিচায় পরিণত করা যায়। এ সত্য লাভের পর আমরা আর অন্যদের মত অলস নিষ্প্রাণ হয়ে বসে থাকতে পারি না। আমরাও পারতাম অন্যদের মতো সুখ-আহ্লাদে মেতে থাকতে, টিভিতে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আর খেলা দেখতে। কিন্তু আমরা তা পারি না, কারণ বিবেক আমাদেরকে স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হতে বাধা দিচ্ছে। যারাই একটু দৃষ্টি প্রসারিত করবেন, একটু তাকাবেন নিজের সমাজের দিকে, তাকাবেন এর রক্তস্নাত দুনিয়ার দিকে তারাই উপলব্ধি করবেন যে, এই মুসলমান জাতির এখন ঈদ করা সাজে না। প্রকৃতপক্ষে তারা তো একটি ঘৃণিত দাস জাতি। এই দাসত্ব রাজনৈতিক দাসত্ব, অর্থনৈতিক দাসত্ব, সাংস্কৃতিক দাসত্ব এবং কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু হিসাবে সরাসরি দাসত্ব। এই দাসত্বের জীবনে মানুষ কী করে আনন্দ পেতে পারে। তারা দেখতে পাবে আজ উদ্বাস্তু শিবিরে ঈদ নেই, সন্তানহারা মায়ের ঈদ নেই, এতিম রোহিঙ্গা শিশুটির ঈদ নেই, ধর্ষিতা নারীদের ঈদ নেই। তাদের কাছে এই দিনটি ভীষণরকম বিবর্ণ। আমরা যদি একমাস রোজা রেখে এই সহানুভ‚তিটুকুও নিজেদের হৃদয়ে পোষণ করতে না পারি তাহলে বৃথা আমাদের রোজা, বৃথা আমাদের মো’মেন দাবি করা। এই জন্যই বুঝি মহানবী (সা.) বলেছিলেন, সময় আসবে যখন রোজা রাখা হবে না খেয়ে থাকা আর তাহাজ্জুদ পড়া হবে ঘুম নষ্ট করা (ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)।
আমরা চাই মুসলিম জাতির জীবনে প্রকৃত ঈদ ফিরে আসুক। ঈদের দিনে যেন আমাদেরকে কোনো ক্রন্দনশীলা মায়ের আহাজারি শুনতে না হয়, কোনো ত্রাণপ্রত্যাশী শিশুর জীর্ণ মুখ আমাদের হৃদয়কে দীর্ণ না করে দেয়। আমাদের ঈদের আনন্দ যেন হয় অমলিন মাধুর্যে পূর্ণ। এই ঈদ তো এমনি এমনি আসবে না, সেজন্য আমাদেরকে বহু অশ্রু, রক্ত ও ঘামের নদী পাড়ি দিতে হবে, আমাদেরকে ধর্মব্যবসায়ীদের কায়েম করে রাখা বিকৃত ইসলামের শেকল থেকে প্রকৃত ইসলামকে মুক্ত করতে হবে, মানবজাতিকে মুক্ত করতে হবে দাজ্জাল অর্থাৎ ইহুদি খ্রিষ্টান ভোগবাদী বস্তুবাদী ‘সভ্যতা’র কারাগার থেকে। আমরা সেই সংগ্রামে নেমেছি। কিন্তু আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি ধর্মজীবী গোষ্ঠী, কারণ প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা মানুষ জেনে ফেললে তাদের ধর্মব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। তারা নানাভাবে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বাংলার ষোল কোটি মানুষের প্রতি আমাদের বিনীত অনুরোধ থাকবে, আপনারা আমাদের বক্তব্য কী, আমরা কী চাই তারা জানবেন ও বুঝবেন। আমাদের লেখাগুলি পড়বেন। যদি আমরা অযৌক্তিক কোন কথা বলে থাকি সেটা আমাদের কথা শুনলেই জানতে পারবেন। আপনারা আমাদের বক্তব্য শুনলেই বুঝবেন আমাদের এই প্রচেষ্টার উদ্দেশ্য কী। আপনারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন যে, একটি সমাজকে শান্তিপূর্ণ রাখতে হলে শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে, শক্তি প্রয়োগ করে সম্ভব হয় না। মানুষ যেমন দেহধারী তেমনি তার আত্মাও রয়েছে। মানুষ যেন অন্যায়কে ঘৃণা ও প্রতিরোধ করে, নিজে থেকেই অন্যায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে সেজন্য তাদের বিবেক ও চেতনাকে জাগ্রত করার জন্য একটি সঠিক ও নিখুঁত আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ করতে হয়। সেই সঠিক ও নিখুঁত আদর্শটি আমাদের কাছে আছে। সেটাই আমরা সর্বাত্মক উপায়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
বিশ্ব এখন নানাধরনের সংকট অতিক্রম করছে। গত দুই বছর ধরে চলমান করোনা মহামারি গোটা মানবজাতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। করোনা মোকাবেলায় অন্যান্য স্বাস্থ্যগত সতর্কতামূলক পদক্ষেপের পাশাপাশি সংক্রমণ এড়ানোর লক্ষ্যে লক ডাউন কার্যকর করার কারণে বিরাট কর্মহীনতা, বাণিজ্যিক ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমরা আমাদের সাধ্যমত নানাধরনের শিল্পভিত্তিক, কৃষিভিত্তিক, চিকিৎসামূলক উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ধর্ম কেবল উপাসনা করে জান্নাতে যাওয়ার পন্থা নয়, এটি আমাদের বাস্তব জীবনের বাস্তব সমস্যার সমাধান দিতেও সক্ষম।
আমাদের বক্তব্য খুব সরল, আমাদের স্রষ্টা আল্লাহ একজন, আমাদের রসুল একজন, আমাদের কেতাব একটি, আমাদের দীন একটি, আমাদের কেবলাহ একটি, আমাদের জাতিও হবে একটি, সেই জাতির নেতাও থাকবেন একজন, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হবে এক ও অভিন্ন, আমাদের পথ হবে একটি, সর্ববিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে একটি। এটাই রসুলাল্লাহ করে গিয়েছিলেন কিন্তু আজ এ জাতির মধ্যে হাজার হাজার মত, পথ, তরিকা। এদের একক কোন নেতৃত্ব নেই, উম্মতে মোহাম্মদীর সেই লক্ষ্য উদ্দেশ্য সম্পর্কেও তারা অনবহিত। পৃথিবীর একটা ইঞ্চি জায়গা নেই যেখানে আল্লাহর হুকুম চলে, উল্টো আমরা সকল জাতির কাছে লাথি খাচ্ছি, তাদের গোলামী করে জিন্দেগী পার করে দিচ্ছি। এ পরিস্থিতিতে জাতি যে মো’মেনই থাকে না সেটা আপনারা একটু চিন্তা করলেই অনুধাবন করতে পারবেন। আর পরকালে জান্নাতের আশায় যে হাজারো প্রকার আমল করে যাচ্ছি সেই আমলও আমাদেরকে জান্নাতে নিতে পারবে না, যদি না আমরা মানবজাতিকে এই অন্যায় অশান্তি থেকে উদ্ধার করতে না পারি।
পরিশেষে বলব, আসুন আমরা নিজেদেরকে স্বার্থপাশ থেকে মুক্ত করে এই নশ্বর জীবনকে আল্লাহর রাস্তায়, মানবতার কল্যাণে বিলিয়ে দেওয়ার শপথ নিই। মানুষের ঈমানকে শত শত বছর থেকে হাইজ্যাক করে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করা হয়েছে, স্বার্থসিদ্ধি করা হয়েছে। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার হই এবং এক আল্লাহ ছাড়া কারো হুকুম মানবো না, আমরা সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে হবো বজ্রকঠিন ঐক্যবদ্ধ ও সোচ্চার জাতি- এটাই হোক আজকের দিনের অঙ্গীকার। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন যেন আমরা মো’মেন হতে পারি, আমরা যেন কোনোপ্রকার অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করি। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, ধর্মব্যবসা, মাদক, অপরাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতাসহ সকল প্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে, মানবতার কল্যাণে আমাদের জীবন ও সম্পদকে উৎসর্গ করতে পারি, সাম্রাজ্যবাদী পরাশক্তিধর অস্ত্রব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলোর আগ্রাসন থেকে আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলার মাটিকে হেফাজত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারি। আল্লাহুম্মা আমীন।