হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলাম বুঝতে মাতৃভাষাই যথেষ্ট

শায়েখ গাজী শাহীদুল হাসান আইয়ুবী

পবিত্র কোর’আনে আল্লাহ পাক বলেন, “আমি নিজের বাণী পৌঁছানোর জন্য যখনই কোন রসুল পাঠিয়েছি সে তার নিজের সম্প্রদায়ের ভাষায় বাণী পৌঁছিয়েছে, যাতে সে তাদেরকে খুব ভালো করে পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে। তারপর আল্লাহ যাকে চান তাকে পথভ্রষ্ট করেন এবং যাকে চান হেদায়েত দান করেন। তিনি প্রবল পরাক্রান্ত ও জ্ঞানী (সুরা ইবরাহিম ৪)”।

মহান আল্লাহ পৃথিবীতে বহু ভাষা সৃষ্টি করেছেন। এই ভাষাবৈচিত্র্য মহান আল্লাহর এক অনন্য নিদর্শন। তিনি বলেন, “তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের পার্থক্য, অবশ্য তার মধ্যে বহু নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য (সুরা রুম ২২)।”

পৃথিবীর কোন ভাষায় স্রষ্টার নিকট অধিক পছন্দনীয় নয়, তিনি সব ভাষাই বোঝেন। এ কারণেই প্রত্যেক জনপদের নিজস্ব ভাষা দিয়ে নবী-রসুল ও কিতাব পাঠিয়েছেন। এর উদ্দেশ্য হলো সঠিক পথ ও পথভ্রষ্টতা, ন্যায় ও অন্যায়, হালাল ও হারামের পার্থক্য ভালোভাবে যেন জনগণের সামনে সুস্পষ্ট ভাবে তুলে ধরতে পারেন। অন্যথায় জনগণ ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে বলবে, এ কেমন রসুল যার ভাষা ও কেতাব আমরা বুঝি না। তাঁর কথা বোঝানোর জন্য তো দোভাষী লাগবে। দেখা যাবে সেই দোভাষী আবার নবীর বক্তব্যকে নিজের সুবিধামত বিকৃত করে মানুষের কাছে প্রকাশ করবে। এভাবে নবী-রসুল ও কেতাব প্রেরণের উদ্দেশ্যই নষ্ট হয়ে যাবে।

আল্লাহর নিকট মর্যাদার মানদণ্ড ভাষাজ্ঞান, পোশাক বা গায়ের রঙ নয়। বরং মানদণ্ড হলো তাকওয়া। আর তাকওয়া অর্জনের জন্য কোনো ভাষার পণ্ডিত হওয়া লাগে না। বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (সা.) সুস্পষ্ট করে বলেছেন, “কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই; মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত হবে তাকওয়ার ভিত্তিতে।” আর তাকওয়া অর্থ হচ্ছে, জীবনচলার পথে প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য-মিথ্যা, হালাল-হারাম, ন্যায়-অন্যায় বুঝে সাবধানে পথ চলা।

ইসলাম একটি উদার ও শাশ্বত জীবনদর্শন যা সমগ্র পৃথিবীর, সমগ্র মানবজাতির জন্য এসেছে। তাই এই দীন বুঝতে বা পালন করতে নির্দিষ্ট কোনো ভাষা জানতে হবে এমন সীমাবদ্ধতা থাকার প্রশ্নই আসে না। পৃথিবীজুড়ে হাজার হাজার ভাষা রয়েছে। যদি কোনো জীবনব্যবস্থাকে বুঝতে একটি নির্দিষ্ট ভাষা জানতে হয় তাহলে সেই জীবনব্যবস্থা আর সার্বজনীন থাকে না, সবার জন্য সহজ সরল বোধমগম্য ও গ্রহণযোগ্য থাকে না।

ইসলামের মূল বা ভিত্তি হলো তওহীদ তথা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্, মুহাম্মাদুর রাসুলাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া আর কোনো হুকুমদাতা নেই এবং মোহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বার্তাবাহক এই সাক্ষ্য প্রদান করা। এই সাক্ষ্য প্রদানের অর্থ হলো, জীবনের সকল ক্ষেত্রে যেখানে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কোনো বক্তব্য রয়েছে, সেখানে অন্য কারো হুকুম মানা যাবে না। এখানে ভাষার কোন গুরুত্ব রইল কি? আল্লাহর কেতাব আমাদেরকে জীবন চলার সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা দিয়েছে।

তওহীদভিত্তিক জাতির একজন নেতা বা এমাম থাকবেন। তিনি কোর’আনের সেই দ্ব্যার্থহীন বা সুস্পষ্ট (মুহকামাত) আয়াতগুলো মো’মেনদের দ্বারা বাস্তবায়ন করবেন। আর যে সমস্ত আয়াত দুর্বোধ্য, অস্পষ্ট (মুতাশাবিহাত) সেগুলোর অর্থ ও তত্ত্ব তালাশ করার পেছনে মো’মেনরা কেউ পড়ে থাকবে না। সেগুলো তারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের উপরে ছেড়ে দেবেন (সুরা ইমরান ৭)। বিগত ১৪শ’ বছরে কোর’আন ও হাদিসের বহু অনুবাদ হয়ে গেছে। আর সেগুলোই আল্লাহর হুকুম জানার জন্য যথেষ্ট।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, সালাতের মধ্যে আরবিতে কোর’আনের আয়াত তেলাওয়াত করা বা তাসবিহগুলো আরবিতে পড়ার যে নিয়ম সেটার কারণ কী? এর মূল কারণ হলো জাতীয় সংহতি রক্ষা করা ও কোর’আনের আয়াতগুলোকে অবিকৃতভাবে রক্ষা করা। সালাত হলো জাতির ঐক্যের একটি প্রশিক্ষণ। এখানে জাতির সদস্যদের মধ্যে কোনোরূপ তারতম্য রাখা যাবে না। একেক দেশের মানুষ একেক ভাষায় নামাজ পড়লে সেটাই বরং জাতির সদস্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি, বিভিন্নতা ও বিভাজন সৃষ্টি করবে। এর বাইরে আরবি ভাষায় কোনো কিছু করাই বাধ্যতামূলক নয়। যেমন খোতবা মাতৃভাষায় দিলেই সবার বোধগম্য হয় আর সেটাই কাম্য। মানুষ যদি খতিবের বা এমামের বক্তব্যই না বোঝে তাহলে সেটার উপর আমল করবে কীভাবে? ইসলামের প্রকৃত আকিদা হারিয়ে যাওয়ায় আমাদের দেশের মসজিদগুলোতে আরবিতে খোতবা দেওয়া হচ্ছে। যদি সাপ্তাহিক জুমার সালাতে, ঈদের সালাতে সহজ, সরল মাতৃভাষায় খোতবার প্রচলন হতো তাহলে ওয়াজ মাহফিল ও খোতবাকেন্দ্রিক ধর্মব্যবসারও অবসান হতো। কারণ জুমার খোতবার মাধ্যমেই জনগণের মধ্যে ইসলামের আলোকে করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে ধারণাগুলো প্রচার ও প্রসার লাভ করত। এজন্যই প্রকৃত ইসলামের যুগে জুমার বাইরে পৃথক ওয়াজ মাহফিলের কোনো প্রয়োজন পড়ত না।

লেখাটি শেয়ার করুন আপনার প্রিয়জনের সাথে

Email
Facebook
Twitter
Skype
WhatsApp
সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...