ওবায়দুল হক বাদল:
মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে হাজার হাজার, হয়ত লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ধর্ম দিয়েই মানুষের জীবন পরিচালিত হয়েছে। আমাদের এই ভারতবর্ষেও সুপ্রাচীন কাল থেকে রাজারা শাস্ত্র দিয়েই রাজ্য পরিচালনা করেছেন। ফেরাউন, নমরুদদের মতো স্বৈরশাসকরাও ধর্মের নাম দিয়েই রাজ্য চালাতেন। তবে ধর্মের অপ-ব্যবহার করার কারণেই ইতিহাসে খলনায়ক হয়েছেন ফেরাউন, নমরুদদের মতো অনেক অত্যাচারী শাসক। এমন অত্যাচারী শাসকদের হাত থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে আল্লাহ যুগে যুগে নবী-রসুল প্রেরণ করেছেন। তারা পুনরায় অসৎ আলেম সমাজ ও স্বৈরশাসকদের হাত থেকে মানুষকে উদ্ধার করে ধর্ম দিয়ে মানুষের জীবন পরিচালনা করেছেন। প্রত্যেক নবী-রসুলদের ভূমিকাই ছিল এমন। তারই ধারাবাহিকতায় আরবের আইয়্যামে জাহিলিয়াতের যুগে আল্লাহ পাঠালেন রহমাতাল্লিল আলামিন সর্বশেষ রসুল হুজুরে পাক (সা.) কে। তাকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা দিয়ে পাঠালেন যাতে তিনি অন্যান্য জীবনব্যবস্থার উপর একে প্রতিষ্ঠিত করেন। রসুল (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে জেহাদ (সর্বাত্মক প্রচেষ্টা) ও কেতালের মাধ্যমে জাজিরাতুল আরবে একে প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করলেন। তাঁর ওফাতের পর আসহাবগণ আল্লাহর হুকুম মোতাবেক রসুলের (সা.) দেখানো পথে এই সত্য জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে অর্ধপৃথিবীকে শান্তির ছায়াতলে নিয়ে আসেন।
আমরা গণতন্ত্র কোথায় পেলাম:
আমাদের তলিয়ে দেখতে হবে ‘গণতন্ত্র’ সিস্টেমটা আসল কোথা থেকে, কোথায় এর উৎপত্তি, কীভাবে এটি বিস্তার লাভ করল, কোন প্রেক্ষাপটে কবে থেকে এই সিস্টেমটা আমরা প্র্যাকটিস করতে শুরু করেছি। এই সিস্টেম কি আল্লাহ প্রদত্ত নাকি মানুষের তৈরি করা কোনো পদ্ধতি।
ইতিহাস বলে, আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিকরা প্রথম গণতন্ত্র নিয়ে একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছিলেন; তা ছিল ক্ষণস্থায়ী এবং অতি ছোট একটি শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রায় ৫ম শতাব্দী খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এথেন্সে নাগরিকরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। সেই উদাহরণ টেনেই পশ্চিমা সভ্যতা বিশ্বজুড়ে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে আসে। ব্রিটিশরা এখানে এসে প্রথমে ডিভাইড এন্ড রুল পদ্ধতিতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধিয়ে দিয়ে জাতির মধ্যে ফাটল ধরায়। জাতিটাকে দুর্বল করে শোষণ করতে থাকে। এরপরও মুজাহিদ আন্দোলন (১৮২০-১৮৪০) মধ্যবর্তীকালে বালাকোটের যুদ্ধ (১৮৩১), ফকির সন্ন্যাসী আন্দোলন (১৭৭০-১৮০৬), ফরায়েজি আন্দোলন (১৮২৮), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-১৮৫৬), কৃষক বিদ্রোহ (১৮৬০-১৯০০), সিপাহী বিদ্রোহ (১৮৫৭), স্বদেশী আন্দোলনের মুখে তারা যখন নাস্তনাবুত তখন তারা দাবি আদায়ের সিস্টেম শেখাতে গিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের পরামর্শ দেয়। অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউম নামে একজন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের উদ্যোগে ১৮৮৫ সনে ভারতের প্রথম রাজনৈতিক দল ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবে এই রাজনৈতিক দলটি হিন্দুদের স্বার্থই রক্ষা করেছিল। এরপর মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য ১৯০৬ সালে ভারতের বিভিন্ন মুসলিম নেতা এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর সহযোগিতায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রথম উপমহাদেশের এই জাতিটি আনুষ্ঠানিকভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যায় তখন তাদের সযত্নে গড়ে তোলা সেই অনুগত রাজনৈতিক দলগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দিয়ে যায়। ভারতে সরকার গঠন করে কংগ্রেস আর পাকিস্তানে মুসলিম লীগ। এই দুই দলের হাত ধরে উপমহাদেশে এখন শত শত রাজনৈতিক দল। অর্থাৎ শত শত ভাগে বিভক্ত জাতি। তো এই রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তো একটি শোষক গোষ্ঠীর কাছ থেকে পাওয়া। এটি তো আল্লাহ কিংবা আল্লাহর রসুলের (সা.) দেওয়া পদ্ধতি নয়।
যে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশে গণতন্ত্র রপ্তানি করল, তারা কারা? এক শতাব্দি আগেও কেমন ছিল তারা? তারা কোট টাই পরে সাহেব হয়ে এখানে এসে যে, এদেশে সম্পদ লুট করে নিয়ে গিয়ে ইউরোপে অট্টালিকা বানালেন আর এখানে সভ্যতা রপ্তানি করতে শুরু করলেন তারা আসলে কারা? ইতিহাস ঘেটে দেখুন ৩-৪শ’ বছর আগেও এরা গরু-ছাগলের মতো বাজারে বাজারে মানুষ বিক্রি করতো। একটা বর্বর জাতি পৃথিবীর সম্পদ লুট করে, ডাকাতি করে ধনী হয়ে সুট-বুট পরে সভ্যতা শেখাতে এসেছিল এখানে। তাদের চাপিয়ে দেওয়া একটা বিধ্বংসী রাজনৈতিক সিস্টেম আমরা চর্চা করছি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের এই সিস্টেম দেন নি। আল্লাহর রসুল (সা.), এই দলাদলির রাজনীতি আমাদের শেখান নি।
অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্যা পিপল:
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর মুসলীম লীগের প্রতি মানুষের আশা ছিল যে, এখানে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তারা তা করেনি। তারা ব্রিটিশদের দিয়ে যাওয়া সেই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বিচারিকব্যবস্থাই চালু রাখল। ইসলামের পরিবর্তে ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া গণতন্ত্রের উপরে আস্থা রাখলো তারা। গণতন্ত্র মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিবে এমন বিশ্বাস নিয়ে তারা ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া দলাদলির সিস্টেমই কায়েম রাখলো। পরবর্তীতে নানামুখী বৈষম্যের কারণে ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশেও ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া ব্যবস্থাগুলোই চালু রাখা হলো। স্বাধীনতা পরবর্তী এ দেশের ৫০ বছরের ইতিহাস হানাহানি, রক্তপাত, দলাদলি তথা অনৈক্যের ইতিহাস। গণতন্ত্র নাম করে ক্ষমতা ধরে রাখা ও ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর চিরচেনা দ্বন্দ্বের মাঝে পরে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। জনগণের ক্ষমতায়নের কথা বলে জনগণকে যে দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দেয়া হয় তার ব্যাখ্যা নেই কারও কাছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আজ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের স্বরূপ জানতে পারে নি। শিশু গণতন্ত্র চারদশক আগে যেমন শিশু ছিল, আজও তেমনই আছে। বরং পক্ষাঘাতগ্রস্ত ভগ্নস্বাস্থ্য রোগাক্রান্ত কঙ্কালসার সে শিশুর প্রাণশক্তিই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এই হলো- অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্যা পিপল এর নমুনা।
গণতন্ত্র, তা রোগা হোক, পাতলা হোক, কঙ্কালসার হোক, এমনকি জীবিত বা মৃত যা-ই হোক, আমরা ত্যাগ করতে পারি না। আমাদের এই হীনম্মন্যতা আমাদেরকে অনেক ভুগিয়েছে, অনেক রক্ত ঝরিয়েছে, অনেক স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটিয়েছে। তবু আমরা গণতন্ত্রের দাস। গণতন্ত্র আমাদের মারবে, কাটবে, পিষে ছাতু বানাবে- তবু আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী!
ভোটের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব বাছাই করা সম্ভব?
ভোটের মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত করা অধিকাংশ সময় অসম্ভব। একজন অশিক্ষিত রিক্সাওয়ালার ভোট আর ড. ইউনূসের ভোটের মূল্য কখনো এক হতে পারে না। তাই গণতন্ত্র সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এপ্লাই করার যেতে পারে যেখানকার মানুষ শতভাগ সুশিক্ষিত ও সচেতন। গণতন্ত্র প্রয়োগের পূর্বসূত্রই এটি।
আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতন্ত্র এক অভিশাপের নাম যেন। রাজনৈতিক দলাদলি, হানাহানি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির চাষ হয় যেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। এখানকার রাজনীতি পেশায় পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি-দুর্নীতি যেন ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের অঘোষিত বেতনভাতা। সুযোগ, সামর্থ্য, ও যোগ্যতা অনুযায়ী তারা জাতির টাকা আত্মসাৎ করে। সরকার পরিবর্তন হলে পরবর্তী সারকারও যেন দুর্নীতির প্রতিযোগিতায় নামে।
নির্বাচনে অংশ নিতে চলে মনোনয়ন বাণিজ্য। স্বার্থ রক্ষার স্বার্থে ব্যবসায়ীরা অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে। নিজ দলের রাজনৈতিক কর্মীরাও টাকা ছাড়া নেতার জন্য প্রচারণার কাজ করে না। ভোটাররা টাকা ছাড়া ভোট দেন না। অনেক ভোটার নগদ নারায়ণ চরিত্রের। টাকার বিনিময়ে প্রার্থী নির্বাচিত করেন তারা। যে প্রার্থী বেশি টাকা দিবে তাকেই ভোট দিবেনÑ এমন ভোটারের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। যেখানে শাসক থেকে শুরু করে নেতা-কর্মী এবং সাধারণ ভোটাররাও স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝেন না এমন জনগোষ্ঠীর মাঝে গণতন্ত্র প্রয়োগ করে সৎ ও যোগ্য শাসক নির্বাচন করা শুধু দুরাশাই নয় অলীক কল্পনা। সিস্টেমটাই এমন যে, ধোকাবাজি, ধান্ধাবাজির মাধ্যমে এখানে ধূর্ত, প্রতারক, মাস্তান, দুর্নীতিবাজ শ্রেণির লোকজনই নেতৃত্বস্থানীয় পর্যায়ে চলে যাবে। যে কারণে ভালো চরিত্রবান লোককে এখন আর রাজনীতিতে আসতে দেখা যায় না। তারা এখানে এসে মন্দলোকদের সাথে পেরে ওঠেন না। হয় তাদের সাথে গা ভাসাতে হয় না হয় খেই হারিয়ে ফেলে রাজনীতি থেকে সটকে পড়েন। এখানে সবার কাছে যেন দেশ ও জাতির স্বার্থ তুচ্ছ, নিজের স্বার্থই মুখ্য।
যেই সময়ে গ্রিসের এথেন্সে গণতন্ত্রের ধারণাটা প্রথম আসে সেই সময়কার দার্শনিক প্লেটো ‘দ্য রিপাবলিক’ বইয়ে লিখেছেন, ‘গণতন্ত্র হল মূর্খ এবং অযোগ্যদের শাসনব্যবস্থা।’ একথা বলার কারণ, একটি সমাজের অধিকাংশ মানুষই মূর্খ হয়ে থাকে। মূর্খদের ভোটে কখনো যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হতে পারে না। তাছাড়া অশিক্ষিত, অসচেতন লোককে নানাভাবে প্রভাবিত করে ধূর্ত-প্রতারক শ্রেণির লোকজন নেতৃত্ব দখল করতে পারেন। আর একটি সমাজের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী যদি অসৎ হয় তাহলে তো কথাই নেই।
প্লেটোর এই কথার প্রমাণ এথেন্সবাসী দিয়েছিল সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে। প্লেটোর গুরু মহামতি সক্রেটিসের মৃত্যু হয় গণতন্ত্রের মতো ভুল সূত্র প্রয়োগের মধ্য দিয়ে। সক্রেটিসের মৃত্যু কার্যকর করা হয় ভোটের মাধ্যমে। অভিযোগের ভিত্তিতে তিন বাদী ও বিবাদী সক্রেটিসের বক্তব্যের শুনে ভোটাধিকার ভিত্তিতে রায় দেওয়া হয়। ৫০০ জন বিচারক এই রায়ে ভোট দেন। তাদের মধ্যে সক্রেটিসের পক্ষে ২২০ জন ও বিপক্ষে ২৮০ জনের ভোট পড়ে। অতএব বিচারে সক্রেটিস দোষী সাব্যস্ত হন।
এদিকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের ২৪১৫ বছর পরে গ্রিসের একটি আদালত জানালেন, সক্রেটিস নির্দোষ ছিলেন। যদিও যারা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তারাও জানতেন তিনি নির্দোষ। সক্রেটিসের আদর্শ দিনকে দিন বিস্তার লাভ করতে থাকায় তাদের ভুল আদর্শ ও ক্ষমতার হারানোর আশঙ্কায়ই তারা সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে রায় দেন। যে সূত্রটিই ভুল সেটা প্রয়োগ করলে কোনো সেক্টরেই এমন মহান সব ভুল হতে বাধ্য।
অধিকাংশ মানুষ একটি ন্যায় কে অন্যায় বললেই সেটা অন্যায় হয়ে যায় না। এখানে অধিকাংশ মানুষ মূর্খ হতে পারে। আর শিক্ষিত হলেও দুর্জন হতে পারে, স্বার্থ জড়িত থাকার কারণে পক্ষপাতিত্ব করতে পারে। পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষও যদি বলে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে তাহলেই এটি সত্য হয়ে যাবে না।
মহান আল্লাহ তাঁর রসুলকে অধিকাংশ লোকের কথা শুনতে নিষেধ করেছেন। কারণ হিসেবে আল্লাহ বলেছেন অধিকাংশ মানুষের আকল নাই।
নিচে এ বিষয়ে কোরআনের কিছু আয়াত দেওয়া হলো-
১। অধিকাংশই বিশ্বাস করে না। (সুরা আল বাক্বারাহ, ১০০)
২। মানুষের মধ্যে অধিকাংশই নাফরমান। (সুরা আল মায়েদা, ৪৯)
৩। তাদের অধিকাংশেরই বিবেক বুদ্ধি নেই। (সুরা মায়েদাহ, ১০৩)
৪। কিন্তু তাদের অধিকাংশই জানে না। (সুরা আল আনআম, ৩৭)
৫। কিন্তু তাদের অধিকাংশই মূর্খ। (সুরা আল আনআম, ১১১)
৭। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। (সুরা আল আ’রাফ, ১৭)
এমন আরো অসংখ্য আয়াত রয়েছে কোরআনে। যা উল্লেখ করে কলেবর আর বাড়াতে চাই না।
শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে গণতন্ত্র কায়েম করলে তা কতটুকু কার্যকর তাও আমরা দেখেছি। গণতন্ত্রের তীর্থভূমি বলা যায় অ্যামেরিকাকে। গণতন্ত্রের রিপ্রেজেন্টেটিভরা কথায় কথায় দৃষ্টান্ত হিসেবে অ্যামেরিকাকেই সামনে আনেন। মানদণ্ড হিসেবে আমেরিকাকে উপস্থাপন করে। অ্যামেরিকার যে নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিরুদ্ধে ৪টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তিনি একটি মামলায় সাজাও পেয়েছেন। বিচারক ইনিয়ে বিনিয়ে বলেন, যেহেতু প্রেসিডেন্ট সেহেতু এখনি কিছু করা যাবে না। পরবর্তীতে বিষয়টা দেখা যাবে। এমন একজন মানুষকে আমেরিকার শিক্ষিত মানুষ নির্বাচিত করেছে। গণতন্ত্রের তীর্থভূমির প্রেসিডেন্ট একজন অপরাধী চিন্তা করা যায়! গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত এসব শাসকরা যে কতটা অমানবিক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাদের সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাম পুরো বিশ্ব দেখেছে। ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে যে ধ্বংসযজ্ঞ তারা চালিয়েছে তা ইতিহাসে বিরল। সম্প্রতি ইউক্রেনকে গাছে উঠিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার ঘটনা অবাক চোখে দেখেছে বিশ্ববাসী। আর ফিলিস্তিন নিয়ে যে নোংরা খেলা তারা খেলেছে এর থেকে মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে না। যে সিস্টেমে অমানবিক, সন্ত্রাসী, অপরাধীগোছের মানুষেরা শাসক নির্বাচিত হয় সেটি কখনোই সুষ্ঠু, নির্ভূল, যৌক্তিক সিস্টেম হতে পারে না। ৮০০ কোটি মানুষ এর পক্ষে ভোট দিলেও না।
গণতন্ত্রের অসাড়তাই একে অজনপ্রিয় করছে:
গণতন্ত্র বর্তমানে সবচেয়ে উপযুক্ত শাসনব্যবস্থা হিসাবে বিবেচিত হলেও এর বেশ কিছু অসুবিধার কথা আলোচনায় আসে। যেমন: সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের অমতে সরকার নির্বাচন: বহুদলীয় গণতন্ত্রে অধিকাংশ জনগণ যে দলটিকে ভোট দেয় না তারাই সরকার গঠন করে। আমাদের দেশে কোনো দল ৪০ শতাংশ ভোট পেলেই সে সরকার গঠন করতে পারে। তাই এতে অধিকাংশ জনগণের মতামত উপেক্ষিতই থাকে।
সেন্টিমেন্টাল জনতার শাসন (Mob Rule): জনগণ প্রায়শই হুজুগ দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই গণতন্ত্র যে কোনো সময় হুজুগে জনতার শাসনে তথা মব রুলে রূপান্তরিত হতে পারে, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠরা সংখ্যালঘুদের উপর তাদের ইচ্ছা চাপিয়ে দেয়, যার পরিণামে স্বভাবতই সংখ্যালঘুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। পাবলিক সেন্টিমেন্ট এর বিবেচনা করে হিন্দু বৌদ্ধদের উপর হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না। ইসলামের বিধান হল, ন্যায়সঙ্গত কথা যদি একজনও বলে তার সেই কথাকেই গ্রহণ করা হবে। ন্যায় অন্যায়ের একমাত্র মানদণ্ড হলেন আল্লাহ।
স্বল্পমেয়াদী ফোকাস (Short-Term Focus): গণতান্ত্রিক সরকারগুলি স্বল্প মেয়াদের জন্য গঠিত হয়। তাই গণতান্ত্রিক দলগুলোর মূল ফোকাস থাকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার দিকে। ফলে তারা সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য স্বল্পমেয়াদী উদ্যোগ নেয়, স্বল্পমেয়াদী নীতিগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। ফলে জাতির দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে কোনো সরকার কাজ করতে আগ্রহী হয় না। আমাদের দেশে এমনকি দেখা যায়, কোনো কোনো উন্নয়ন প্রকল্প পর্যন্ত অর্ধেক করার পর সরকার পাল্টে যাওয়ার কারণে বাকিটা আর সম্পন্ন করা হয় না। এতে অভিজ্ঞতা ও অর্থের অপরিসীম অপচয় হয়। যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা দল হেরে যাওয়ার কারণে জাতির জন্য ভূমিকা রাখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অযোগ্য ও অনভিজ্ঞ ব্যক্তিরা আসন লাভ করে।
জনপ্রিয়তাই মাপকাঠি (পপুলিজম): গণতন্ত্র জনপ্রিয়তাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। একজন ব্যক্তি রাষ্ট্র পরিচালনায় কতটা দক্ষ হবেন সেটা বিবেচনা করার সুযোগ নেই, যুক্তিহীনভাবেই এখানে ইউটিউবার, ক্রিকেট খেলোয়াড়, চলচ্চিত্র অভিনেতারা হঠাৎ করে মনোনয়নপত্র কিনে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রণয়ন ও প্রয়োগের জায়গায় চলে আসেন কেবল জনপ্রিয়তার জোরে। এভাবে জনপ্রিয় নেতারা ও দলগুলো রাজনৈতিক লাভের জন্য সহজেই জনগণের আবেগকে কাজে লাগাতে পারে।
আমলাতন্ত্র: গণতন্ত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত শ্লথগতিসম্পন্ন। যে কোনো বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন শাখার মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজনের কারণে সিদ্ধান্তগ্রহণ ও বাস্তবায়ন পদে পদে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে।
ভোটারদের অজ্ঞতা (Uninformed Voters): সব নাগরিক সমাজ রাজনীতি সচেতন হয় না, সবাই রাষ্ট্রপরিচালনার প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন না কিন্তু সবার ভোটের মূল্য সমান।
অপকৌশল ও অপপ্রচারের ব্যবহার (Manipulation and Propaganda): গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলিকে গোষ্ঠীস্বার্থে প্রভাবিত করার (যেমন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং) সুযোগ থাকে। মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা মেশিন ব্যবহার করে সম্ভাব্য জনমত এবং নির্বাচনের ফলাফলগুলিকে পাল্টে দেওয়া যায়। বহিরাগত বিভিন্ন চাপ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। যেমন বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা, নির্দিষ্ট দলের পক্ষে বৈদেশিক চাপ, ঋণপ্রদানকারী দেশগুলোর অর্থনৈতিক চাপ ইত্যাদি।
সংখ্যাগরিষ্ঠের অত্যাচার (Tyranû of the Majority): গণতান্ত্রিক দেশে এমন একটি উদ্বেগ সব সময় থাকে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ গোষ্ঠীর শাসন সংখ্যালঘুদের অধিকার বা স্বার্থকে দমন করতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিরংকুশ আধিপত্য বিস্তার করতে পারে।
…চলবে