মাননীয় এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নীর লেখা থেকে-
বর্তমানে ইসলাম সম্বন্ধে দু’টি ভুল ধারণা প্রচলিত। একটি হলো মুসলিম বলে পরিচিত জাতিটি যে ধর্মে বিশ্বাস করে, এটিকে বলা হয় ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মকে অন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে আল্লাহ আদম (আ.) থেকে শুরু করে শেষ নবী (দ.) পর্যন্ত যতবার যতভাবে জীবন-বিধান পাঠিয়েছেন সবগুলোরই ঐ একই নাম ইসলাম, শান্তি অর্থাৎ যে জীবন-বিধান অনুসরণ করে চললে মানুষ শান্তিতে সুখে বাস করতে পারবে আর অস্বীকার করলে তার অবধারিত পরিণতি অশান্তি, রক্তারক্তি, অবিচার। রাজনৈতিক আর্থ-সামাজিক অবিচার- যা মালায়েকরা বলেছিলেন (সুরা বাকারা-৩০)।
দ্বিতীয়টি হলো এই ধারণা (আকীদা) যে, আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম। এটাও ভুল। কারণ আল্লাহ ইচ্ছা করলে এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। কোন অবিশ্বাসী, কোন সন্দেহকারী, কোন মোশরেক বা মোনাফেক থাকবে না (সুরা আন’আম ৩৫, সুরা ইউনুস ১০০)। কাজেই তা নয়। আল্লাহ মানুষের মধ্যে তাঁর নিজের আত্মা ফুঁকে দিয়েছেন অর্থ মানুষের মধ্যে যুক্তির শক্তি, বুদ্ধি, জ্ঞান ও সর্বোপরি স্বাধীন ইচ্ছা শক্তি দিয়েছেন, দিয়ে নবী পাঠিয়ে তাকে পথ দেখিয়ে দিয়েছেন, যে পথে চললে সে নিজেদের মধ্যে মারামারি, রক্তারক্তি না করে শান্তিতে থাকে। এরপর তিনি দেখবেন কে বা কারা তাঁর দেখানো পথে চলবে আর কে বা কারা তা চলবে না। কাজেই আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণের নাম ইসলাম নয়। তাঁর দেয়া জীবন-ব্যবস্থাকে গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করার ফল হিসাবে যে শান্তি সেই শান্তির নাম ইসলাম। মানুষ যদি যেসব নিয়ম, আইনের মধ্যে এই জগত সৃষ্টি করা হয়েছে ও চলছে তা সব জানতো তবে হয়তো মানুষই নিজেদের জন্য এমন জীবন-ব্যবস্থা, ধর্ম তৈরি করে নিতে পারতো যা মেনে চললেও ঐ শান্তি ইসলাম আসতে পারতো। কিন্তু মানুষ তা জানে না- তাকে আল্লাহ অতখানি জ্ঞান দেন নি। তাই ¯্রষ্টা তাকে বলে দিয়েছেন কোন পথে চললে, কেমন জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করলে ঐ অভীষ্ট শান্তি, ইসলাম আসবে। বলে দিয়েছেন তার নবীদের মাধ্যমে। কোন প্রাণী হত্যা করব না (বৌদ্ধ ধর্ম), কেউ আমার কোট চুরি করলে তাকে জোব্বাটাও দিয়ে দিবো, একগালে চড় দিলে অন্য গাল পেতে দিব (খ্রিস্ট ধর্ম), এ অর্থে এ ইসলাম নয়। যেসব ধর্ম ঐ শিক্ষা প্রচার করে তারা সংখ্যায় পৃথিবীতে অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশি কিন্তু সমস্ত পৃথিবী আজ ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি অশান্তি আর রক্তারক্তিতে লিপ্ত। শুধু তাই নয় ঐ মতে বিশ্বাসীরা এই শতাব্দীতেই দু’বার নিজেদের মধ্যে মহাযুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রায় পনের কোটি মানুষ হত্যা করেছে, হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর দু’টি কয়েক লক্ষ মানুষসহ ধ্বংস করেছে এবং আজ পারামাণবিক অস্ত্র দিয়ে সম্পূর্ণ মানব জাতিটাকেই ধ্বংস করার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
মানুষকে নিজেদের মধ্যে অশান্তি, অবিচার, মারামারি না করে শান্তিতে, ইসলামে থাকার জন্য জীবন বিধান দিয়ে আল্লাহ যুগে যুগে পৃথিবীর প্রতি স্থানে, প্রতি জনপদে, প্রতি জাতিতে তার প্রেরিতদের, নবীদের পাঠিয়েছেন (সুরা আন নহল ৩৬)। মানুষ জাতির কিছু অংশ তা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠা করেছে, কিছু অংশ করে নি। যারা গ্রহণ করেছে তাদের সমাজের রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি জীবনের সমস্ত কিছুই ঐ ব্যবস্থার নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। তাদের সমাজের আইনের উৎস শুধু ঐ জীবন-বিধান বা ধর্মই ছিলো না ঐ বিধানই আইন ছিলো, ওর বাহিরের কোন আইন সমাজ গ্রহণ করত না। অনেক ধরনের বিকৃতির কারণে আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান বদলিয়ে ফেলে বা ইচ্ছামত তার ভুল ব্যাখ্যা করে তা চালানো হয়েছে। কিন্তু ঐ ভুল ও অন্যায় আইনকেও সেই ধর্ম বা দীনের আইন বলেই চালানো হয়েছে। তার বাহিরের, মানুষের তৈরি বলে চালানো যায় নি।
পৃথিবীর ইতিহাসকে না তলিয়ে, শুধু এক নজরে যারা পড়েছেন তারাও এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে মানব সমাজ চিরদিন শাসিত হয়ে এসেছে ধর্মের আইন দিয়ে। যখন যেখানে যে নবী ধর্ম বা জীবন-বিধান প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেখানে রাজা বা শাসনকর্তা শাসন করেছেন সেই আইন দিয়ে- অন্য কোন কিছু দিয়ে নয়। আইনের নির্দেশ, উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন সমাজের বিজ্ঞেরা, পুরোহিতরা, আর তাকে প্রয়োগ করেছেন রাজারা, শাসকরা। ওর বাইরের কোন আইন, আদেশ চালাবার চেষ্টা করলে সমাজ তা গ্রহণ করতো না, প্রয়োজনে বিদ্রোহ করতো। উদাহরণ হিসাবে পশ্চিম এশিয়া নিন। ইহুদীদের আগে ওখানে ‘আমন’ বা ‘রা’ দেবতা থেকে শুরু করে অনেক রকম দেব-দেবীর ধর্মের আইন চলতো। ওগুলোও পূর্বতন কোন নবীর আনা দীনের বিকৃতির ফল ছিলো। ইব্রাহীম (আ.) আবার আল্লাহর একত্ববাদ, তওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পর ইহুদীরা যতদিন মধ্য এশিয়ায় ছিলো ততদিন ঐ আল্লাহ প্রেরিত দীনই ছিল তাদের জাতির আইন।
ভারতের কথা ধরুন। রামায়ন, মহাভারতসহ ইতিহাস পড়ুন। দেখবেন রাজারা শাসন করেছেন শাস্ত্রানুযায়ী- অর্থাৎ ওটাই ছিলো শাসনতন্ত্র (Constitution)। ঐশ্বরিক বইয়ের (Scripture) উপর ভিত্তি করে শাস্ত্র, সেই শাস্ত্রের বিধান দিতেন ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা এবং বিধান বা আইন জনগণের উপর প্রয়োগ ও তার রক্ষার দায়িত্ব ছিলো ক্ষত্রিয় রাজাদের উপর। এই শাস্ত্রীয় বিধানের বিরুদ্ধে কোন আদেশ, নির্দেশ দেয়া রাজা বা শাসকের সাধ্য ছিলো না। ইউরোপের অবস্থাও তাই ছিলো। পোপের নির্দেশে রাজ্য শাসন করতেন রাজারা। কোন রাজা পোপের নির্দেশ অমান্য করতে পারতেন না- করলে তার দুরাবস্থার সীমা থাকতো না। মোট কথা পৃথিবীর কোথাও আইনের উৎস ধর্ম ছাড়া আর কোন কিছুকে গ্রহণ করা হয় নি।
যে লক্ষ্য অর্জনের জন্য আল্লাহর নির্দেশে তাঁর শেষ রসুল এই জাতিটিকে, এই উম্মাহটি গঠন করেছিলেন, আর সেটি হল জীবন ও সম্পদ দিয়ে সংগ্রাম করে সমস্ত পৃথিবীতে আল্লাহর আইন-কানুন অর্থাৎ দীন প্রতিষ্ঠা ও কার্যকরী করে মানব জাতির ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের সমস্ত অন্যায়, অবিচার, শোষণ, অত্যাচার নিঃশেষ করে দিয়ে ন্যায়, সুবিচার, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আর এই জন্যই এই দীনের নাম ইসলাম, আক্ষরিক অর্থেই শান্তি। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আদম (আ.) থেকে মোহাম্মদ (দ.) পর্যন্ত ঐ একই নাম, ইসলাম বা শান্তি। আজ আমাদের ধর্মীয় ও অধর্মীয় (অর্থাৎ রাজনৈতিক) নেতারা যে অর্থে ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলেন তার ঠিক বিপরীত অর্থ। তারা শান্তির ধর্ম বলতে বোঝেন যে ধর্মের অনুসারীরা হবেন অতি শান্তিপ্রিয়, মৃদুভাষী। কোন অন্যায়ের তারা প্রতিবাদ করবে না, সব অপমান, লাঞ্ছনা, নির্যাতন মুখ বুজে ধৈর্য সহকারে সহ্য করে যাবেন, নির্যাতনকারীকে ক্ষমা করে দিবেন আর ভালাবাসবেন। তারা কোন কিছুর জন্য সংগ্রাম বা যুদ্ধ করবেন না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে একজন মুসলিমের কখনই এরূপ কাপুরুষ হওয়া সম্ভব নয়, যদি হয় তবে তিনি আল্লাহর শেষ রসুলের উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন না। ইসলাম “শান্তিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা” এ কথার প্রকৃত অর্থ হলো- আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে (Consequence) পৃথিবীতে এমন পরিবেশ সৃষ্টি হবে যেখানে কোন মারামারি, কাটাকাটি, অন্যায়, অশান্তি, রক্তপাত, অবিচার থাকবে না, এক কথায় সর্বাঙ্গীন শান্তিময় একটি পরিবেশ বিরাজ করবে, এই অবস্থার নামই হচ্ছে ইসলাম, আক্ষরিক অর্থেই শান্তি।
(সম্পাদনায়: মুস্তাফিজ শিহাব, সহকারী সাহিত্য সম্পাদক, দৈনিক বজ্রশক্তি)