মোহাম্মদ আসাদ আলী:
আজ থেকে ১৪০০ বছর আগে আল্লাহর রসুল যখন পৃথিবীতে ইসলাম প্রচার শুরু করলেন, দেখা গেল আদর্শ হিসেবে ইসলামের স্বরূপ প্রকাশিত হবার সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগল। ইসলামের আদর্শ ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, আফ্রিকা থেকে ইউরোপ, সর্বত্রই ইসলামের একটা জয়জয়কার পড়ে গেল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, মুসলমানদের ঘোর শত্রুও ইসলামের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলে মন্ত্রমুগ্ধের মত এই দ্বীনকে গ্রহণ করে নিচ্ছিল। অল্প দিনের মধ্যে আদর্শ হিসেবে ইসলামের এমন যুগান্তকারী উত্থান ঘটল যার সম্মুখে সমসাময়িক সকল আদর্শ, সকল মতবাদ আবেদন হারিয়ে বর্ণহীন হয়ে গেল।
ইসলামের প্রতি মানুষের এই অভাবনীয় আকর্ষণের প্রধান কারণগুলো হচ্ছে-
১। ইসলাম অনৈক্য-হানাহানিতে লিপ্ত দাঙ্গাবাজ আরবদেরকে ঐক্যবদ্ধ সুশৃঙ্খল সুসভ্য জাতিতে পরিণত করতে পেরেছিল।
২। বংশানুক্রমিক শত্রুতা আর রক্তপাতে নিমজ্জিত আরব জাতিকে একে অপরের ভাই বানিয়ে দিয়েছিল। এই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে পরবর্তীতে অর্ধপৃথিবীকে বেঁধেছিল সেই প্রকৃত ইসলাম।
৩। আরব-অনারব, আশরাফ-আতরাফ, ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-নিরক্ষরের আকাশ-পাতাল মর্যাদার ব্যবধান দূর করতে পেরেছিল।
৪। যে সমাজে দাসদেরকে মানুষ মনে করা হত না, সেই সমাজের ক্রীতদাস বেলালকে (রা.) ক্বাবার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে (মক্কা বিজয়ের পর) আল্লাহর রসুল বুঝিয়ে দিলেন- সবার ঊর্ধ্বে মানুষ, সবার উপরে মানবতার স্থান। আল্লাহর কাছে একজন সত্যনিষ্ঠ মানুষের মূল্য তাঁর ক্বাবার চেয়েও অধিক। ইসলামের এই সাম্যবাদী আদর্শ লক্ষ লক্ষ বেলালদের অন্তরে মুক্তির তুফান সৃষ্টি করেছিল, ইসলামকেই তারা মুক্তির পাথেয় হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
৪। ইসলাম সাম্প্রদায়িক বিভাজনের গালে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করে যা ওই সমকালীন বিশ্বে কল্পনাও করা যেত না। সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-বংশের মানুষ নিয়ে মদীনায় ‘ঐক্যবদ্ধ জাতি’ গঠন করে আল্লাহর রসুল প্রমাণ করে দেন- ‘ইসলামে বিভক্তি নয়, ঐক্যই মূল শিক্ষা। কে কোন ধর্মের, কে কোন বর্ণের, কে কোন গোত্রের- তা দিয়ে মানুষের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পায় না। যে ব্যক্তি ন্যায় ও সত্যকে ধারণ করবে ইসলাম তাকেই আলিঙ্গন করবে।’ ফলে ইসলামের এই সার্বজনীনতার কাছে অন্য সব আদর্শ ম্রীয়মাণ হয়ে পড়ে।
৫। নির্যাতিত, নিপীড়িত, শোষিত মানুষ, যারা বেঁচে থাকত রাজা-বাদশাহ, যাজক-পুরোহিত আর সমাজপতিদের কৃপাগুণে, সমাজে যাদের ন্যূনতম অধিকার ছিল না, সম্মান ছিল না, যাদের মাথাকাটা যাবার জন্য সমাজপতিদের একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট ছিল, সেই মানুষগুলো ইসলামের ন্যায়বিচার দেখে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছে। যে সম্মান তারা কল্পনাও করতে পারত না ইসলাম তাদেরকে তার চেয়েও অধিক সম্মান দিয়েছে। ওই দাসশ্রেণির মানুষই তাদের ‘আমীরুল মু’মিনিনের’ গায়ের জামা কীভাবে বানানো হলো তার কৈফিয়ত চেয়েছে, জনসম্মুখে জবাব দিতে হয়েছে অর্ধ-পৃথিবীর শাসককে। এমন দৃষ্টান্ত আজকের যুগেও কল্পনা করা যায়?
৬। ইসলাম ক্ষুধার্তকে খাদ্য দিয়েছে, বাস্তুহারাকে বাস্তু দিয়েছে। কে কোথায় কী সমস্যায় পড়ে আছে তার সমাধান করার জন্য রাতের আঁধারে রাস্তাঘাটে, অলি-গলিতে হেঁটেছে ইসলামের খলিফা, অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা। ক্ষুধার্ত মানুষের বাড়িতে নিজের কাঁধে করে আটার বস্তা পৌঁছে দিয়েছে।
৭। যখন সারা বিশ্বে শক্তিমানের কথাকেই আইন ভাবা হচ্ছিল, বিরাট-বিরাট অট্টালিকায়, মনি-মুক্তাখচিত রাজপ্রাসাদে অস্বাভাবিক ভোগ-বিলাসিতার মধ্যে বসবাসরত ‘সম্রাট’দের কাছে নিজেদের ফরিয়াদ জানানো তো দূরের কথা, তাদেরকে এক পলক দেখারও সৌভাগ্য ছিল না সাধারণ মানুষের, সেই সময়েই ইসলামী আদর্শ এমন একটি সমাজ নির্মাণ করে, এমন সুবিচার ও স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যে, অর্ধপৃথিবীর শাসনকর্তা একটি খেজুরপাতার ছাউনি দেয়া মসজিদে বসে রাজ্য শাসন করত। যার আবার একটির বেশি জামা ছিল না। যে ব্যক্তি তটস্থ থাকত তার শাসনের অধীনে কেউ কোথাও কষ্ট পাচ্ছে কিনা, একটি কুকুরও না খেয়ে থাকছে কিনা সেই দুশ্চিন্তায়। ঘুম এলে গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়তেন। যার যখন ইচ্ছা খলিফার সাথে দেখা করতে পারত, সমস্যা বলত, সমাধান হয়ে যেত।
মূল কথা হচ্ছে ইসলাম মানুষের ‘বাস্তব সমস্যার’ বাস্তব সমাধান করতে পেরেছিল। যখন মানুষের সমস্যা ছিল অধিকারহীনতা, অন্যায়, অবিচার, নির্যাতন, স্বাধীনতাহরণ, শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র্য; তখন ইসলাম মানুষকে মুক্তির সন্ধান দিতে পেরেছিল। প্রতিষ্ঠা করেছিল ন্যায়, শান্তি, সুবিচার ও নিরাপত্তা। ওই ন্যায় ও শান্তি দেখেই কোটি কোটি মানুষ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পরকালীন মুক্তির ব্যাপারও ছিল, তবে মুখ্য বিষয় ছিল মানুষের পার্থিব মুক্তি। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান করত যে দ্বীন, সেই দ্বীন আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আজ আমাদের ইসলাম অন্য ইসলাম। এই ইসলাম পালন করে মিনিটে মিনিটে লক্ষ-কোটি নেকি কামাই করা যায়, অন্যায়-অবিচারের কষাঘাতে জর্জরিত দুঃখ-কষ্টে ভারাক্রান্ত মানুষকে জান্নাতের আশ্বাস দিয়ে আত্মিক প্রশান্তিও প্রদান করা যায়, কিন্তু যেহেতু এ ইসলাম মানুষের বাস্তব সমস্যার বাস্তব সমাধান করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যেহেতু এ ইসলাম ইহজাগতিক বিষয়কে এড়িয়ে নিছক পারলৌকিক মুক্তির উপায় হিসেবে আবির্ভুত হচ্ছে সুতরাং স্বভাবতই সে তার আকর্ষণক্ষমতা হারিয়েছে। আদর্শ হিসেবে ইসলামের জনপ্রিয়তা ক্ষুণ্ন হবার এটাই প্রধান কারণ। আজকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া ছেলে-মেয়েদেরও ঘোর ইসলামবিদ্বেষী হতে দেখা যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, আমরা কখনও খতিয়ে দেখেছি?
এদিকে সাধারণ মানুষ এখন পশ্চিমা বাদ-মতবাদগুলোকে ভরসা করতে শিখেছে। এসব তন্ত্র-মন্ত্র মানুষের প্রকৃত শান্তি নিশ্চিত করতে পারুক বা না পারুক, এদের কিছু বাণী আছে, কিছু মূল্যবোধ আছে, কিছু আশ্বাস আছে যা মানুষকে মুক্তির মরিচীকা দেখিয়ে টেনে রাখতে পারে। অন্যদিকে ধর্মের অবস্থা বড়ই সঙ্গীন। কারণ, আমাদের আলেমরা, আমাদের ধর্মজ্ঞানী পণ্ডিতরা দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে ভাবনাকে মনে করেন ‘দুনিয়াদারী’। সাধারণ মানুষকেও তাই শেখানো হয়। মানুষকে বোঝানো হয় পৃথিবীর জীবন তুচ্ছ বিষয়, পরকালের জীবনটাই আসল জীবন। ওই জীবনের জন্য রসদ সংগ্রহ কর, যত পার নেকি কামাও, দুনিয়াতে কী হচ্ছে না হচ্ছে ও নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট কর না। দুনিয়া শয়তানের, পরকাল মু’মিনদের। এর ফলে যারা পরকাল নিয়ে ভাবছে, অর্থাৎ ধার্মিক শ্রেণি, তারা পৃথিবীর অন্যায়, অবিচার দেখেও নিশ্চুপ থাকছে। অপরদিকে যারা পৃথিবীর অন্যায়, অবিচার দেখে ব্যথিত হয়, মানুষের মুক্তির জন্য কিছু করতে চায়, তারা ধর্মের প্রতি আকর্ষণ হারাচ্ছে। ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছে।
এই যে আল্লাহ-রসুলের ইহকাল-পরকালের ভারসাম্যপূর্ণ দ্বীনকে ভারসাম্যহীন করে ফেলা এবং তার পরিণতিতে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহ রসুলকে পাঠিয়েছেন, যে উদ্দেশ্যে দ্বীনুল হক্ব পাঠিয়েছেন সেই উদ্দেশ্যই অবাস্তবায়িত থেকে যাওয়া- এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। এখনও যদি আমরা ইসলামের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বুঝতে না পারি, যদি গুরুত্বের অগ্রাধিকার বুঝতে ব্যর্থ হই, আমাদের কৃতকর্মের কারণে দুনিয়াতে ইসলাম কলঙ্কিত হয়, তাহলে হাশরের ময়দানে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কাছে কঠোর জবাবদিহিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদেরকে বুঝতে হবে ইসলামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবজাতিকে পৃথিবীতে ন্যায়, সুবিচার ও শান্তি দেওয়া এবং পরকালে জান্নাত দেওয়া। পৃথিবীকে অন্যায়-অসত্যের হাতে সোপর্দ করে যতই ধর্ম-কর্ম করা হোক তা এই দ্বীনের স্রষ্টার কাছে গৃহীত হবে না।
যোগাযোগ:
০১৭১১০০৫০২৫, ০১৯৩৩৭৬৭৭২৫
০১৭৮২১৮৮২৩৭, ০১৬৭০১৭৪৬৪৩