হেদায়হ (সঠিক পথ নির্দেশনা) ও সত্যদীন দিয়ে আল্লাহ আখেরী নবী বিশ্বনবী মোহাম্মদ (স.) কে পাঠিয়েছেন তিনি যেন এটাকে অন্য সমস্ত দ্বীনের, জীবনব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠা করেন। (তওবা, ৩৩, ফাতাহ ২৮, সফ ৯)। এই হেদায়াহ হলো আল্লাহর তওহীদ, আল্লাহর সাবভৌমত্ব, লা এলাহা এল্লাাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া জীবনের সর্ব অঙ্গনে অন্য কারো হুকুম না মানা। আর দ্বীনুল হক (সত্য জীবনব্যবস্থা) হলো ঐ হেদায়াহর উপর প্রতিষ্ঠিত, আইন, বিধান, হারাম-হালাল, বৈধ-অবৈধ, জায়েজ-নাজায়েজ ইত্যাদি। মানব জাতির সামগ্রিক জীবনে অন্যায়, সুবিচার, এককথায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী তাঁর আসহাবদের নিয়ে সংগ্রাম শুরু করলেন তাঁর জীবদ্দশায় সমস্ত জাজিরাতুল আরবে আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন কায়েম হলো। তিনি এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার পর সংগ্রাম করে এই সত্যদীনকে মানবজীবনে প্রতিষ্ঠা করার দায়িত্ব এসে পড়ল তাঁর উম্মাহর উপর। উম্মতে মোহাম্মদী তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করার জন্য অর্থাৎ আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করার লক্ষ্যে নিজেদের বাড়িঘর, সহায় সম্পত্তি, স্ত্রী-পুত্র, ক্ষেত-খামার ইতাদি বিসর্জন দিয়ে দুনিয়ার দিকে বেরিয়ে পড়ল। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে অর্ধ পৃথিবীতে এই সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করল, মোটামুটি ৬০/৭০ বছর পর্যন্ত চলল এক অখণ্ড জাতি হয়ে মানবজীবন থেকে সর্বরকম অন্যায়, অবিচার দূর করে ন্যায় সুবিচার অর্থাৎ শান্তি প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। এর পরই সংগ্রাম ত্যাগ করা হলো। দীন প্রতিষ্ঠার জেহাদ ত্যাগ করে অন্যান্য রাজা বাদশাহদের মত শান-শওকতের সঙ্গে রাজত্ব করতে আরম্ভ করল। এই সংগ্রাম- যেটা করার জন্যই এই উম্মতে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল এবং যা হচ্ছে রসুলাল্লাহর (দ.) প্রকৃত সুন্নাহ এবং যা ত্যাগ করলে কেউ প্রকৃত উম্মতে মোহাম্মদী থাকেন না। কিন্তু ঐতিহাসিক সত্য হলো এই যে, মহানবীর (দ.) পর ৬০/৭০ বছর পর্য্যন্ত ঐ সংগ্রাম ‘জেহাদ’ চলেছিল এবং তারপর তা বন্ধ করা হয় এবং উমাইয়া খলিফারা নামে খলিফা থেকেও আসলে পৃথিবীর আর দশটা রাজা-বাদশাহর মত শান-শওকতের সঙ্গে রাজত্ব করা আরম্ভ করেন।
যখন মহানবীর আসহাবরা দুনিয়া থেকে চলে গেছেন, প্রকৃত মো’মেনরা চলে গেছেন তখন সেই আরবদের অনেকের মধ্যেই প্রাচীন জাহেলিয়াত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেই মুহূর্তে তাদের হাতে অর্ধ-দুনিয়া, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের আনুগত্য করছে। তারা আবার নিজেদেরকে ধারণা করতে শুরু করেছিল মানুষের মালিক, প্রভু বলে। রসুলাল্লাহ যে জাহেলিয়াতের কবর দিয়েছিলেন, তারা সুযোগ পেয়েই আবার সেই জাহেলিয়াত অর্থাৎ দাসত্বব্যবস্থা, জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে মানুষকে দিয়ে কাজ করানোর প্রবণতা ইত্যাদি ফিরিয়ে আনল। তথাকথিত খেলাফতের সময় তাগুত রাজা-বাদশাহদের মত ভোগবিলাসে মত্ত শাসকেরা যে জাহেলি ব্যবস্থাকে কবর থেকে তুলে এনেছিল, আজও তাদের উত্তরসুরী অহঙ্কারী আরব শেখরা সমগ্র দুনিয়া থেকে শ্রমিক আমদানী করে জোর করে শ্রম আদায় করে সে ব্যবস্থাকে জিইয়ে রেখেছে। তাদের এই শ্রমদাস সরবরাহ করার জন্য তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলিতে ম্যানপাওয়ার ব্যবসা জমজমাট। উপরন্তু কোনো অপরাধ করলে এই শ্রমিকদেরকে পূর্ণ শাস্তি ভোগ করতে হয়, কিন্তু তাদের দেশের প্রভাবশালী, অর্থশালীরা একই অপরাধ করে লঘুদণ্ডে মুক্তি পেয়ে যায়। যখন কোর’আনের অনুবাদ করা শুরু হয় তখন সেই অনুবাদকদের সামনে আল্লাহ রসুলের প্রকৃত ইসলামটি নেই, আছে আরব শেখদের বিকৃত করা শিয়া, সুন্নী আর উমাইয়া আব্বাসীয় মোফাস্সেরদের ইসলাম। সেই বিকৃত ইসলামগুলিই ছিল অনুবাদক-আলেম, মোফাসসেরদের জ্ঞানের পরিসীমা। ফলে তারা যুদ্ধবন্দী, গনিমত, রাকাবাত, মিলকুল আয়মান সব কিছুর একটি অর্থই জানেন, আর সেটা হচ্ছে ‘দাস-দাসী’। অবশ্য উমাইয়া, আব্বাসীয় রাজা বাদশাহরা তাদের অধীনস্থদের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে আল্লাহ-রসুলের বেঁধে দেওয়া সীমানা মেনে চলেন নি। তারা রসুলের জীবনাদর্শ ভুলে যান। সেই অনুবাদকেরা দয়া করে যদি একবার রসুলাল্লাহর জীবনের দিকে তাকান তবে দেখতে পাবেন, আল্লাহর রসুল এই দাসত্ব প্রথাকে নির্মূল করার জন্য আজীবন কী সংগ্রামটাই না করে গেছেন। এই সংগ্রাম কেবল যে কাফেরদের বিরুদ্ধে তা নয়, এটা ছিল বিশ্বময় প্রতিষ্ঠিত একটি সিস্টেম বা ব্যবস্থা বিরুদ্ধে, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের মন মগজে শেকর গেঁড়ে বসে ছিল। তিনি ক্রীতদাস যায়েদকে (রা.) মুক্ত করলেন। যায়েদ মুক্তি পেয়েও তাঁর সাথেই রইলেন। এরপর রসুল যায়েদকে নিজের ছেলে বলে ঘোষণা দিলেন, বললেন যায়েদ (রা.) তাঁর সম্পদের উত্তরাধিকার। এটা ছিল কোরায়েশদের মিথ্যা আভিজাত্যের দেয়ালে এক প্রচণ্ড আঘাত। চারিদিকে ছি ছি পড়ে গেল, কী! গোলামকে ছেলে বলে ঘোষণা দিল মোহাম্মদ! রসুল বিচলিত হলেন না, নিজ সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। এ হলো নবী হওয়ার আগের কথা। নবী হওয়ার পরে তিনি নিজ ফুফাতো বোন জয়নাবের (রা.) সঙ্গে যায়েদকে (রা.) বিয়ে দিলেন। তাদের বিয়ে টিকল না, যার অন্যতম কারণ জয়নাব (রা.) রসুলাল্লাহর ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখিয়ে যায়েদকে (রা.) স্বামী হিসাবে গ্রহণ করলেও তিনি যায়েদের পূর্ব পরিচয় ভুলতে পারেন নি। রসুলাল্লাহ খেয়াল করেছেন যে, তাঁর উম্মাহর মধ্যে অনেকেই যায়েদকে (রা.) তখনও ভিন্নভাবেই দেখে। এরপর রসুল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যায়েদকে (রা.) মু’তার যুদ্ধের সেনাপতি নিয়োগ দিলেন। তাঁর অধীনে যুদ্ধে প্রেরণ করলেন পুরো জাতিকে যার মধ্যে কোরায়েশসহ বড় বড় সম্ভ্রান্ত বংশীয় অনেক সাহাবীই ছিলেন। যায়েদকে (রা.) সেনাপতি নিয়োগ দেওয়ার পর অনেকেই সন্তুষ্টচিত্তে বিষয়টি মেনে নিতে পারল না, বিশেষ করে মোনাফেকরা জাতির ভিতরে জোর তৎপরতা চালাল যে, একজন দাসকে সকলের আমীর করা হলো? এটা কেমন কথা? এসব কথা শুনে রসুলাল্লাহ প্রচণ্ড রাগ করলেন এবং সবাইকে মসজিদে নববীতে ডেকে সাবধান করে দিলেন।
মু’তা যুদ্ধে যায়েদ (রা.) শহীদ হন। রসুলাল্লাহ তাঁর এন্তেকালের স্বল্পকাল আগে সেই যায়েদ (রা.) এর পুত্র ওসামা ইবনে যায়দ এবনে হারিসাকে (রা.) সিরিয়া-ফিলিস্তিনের দারুস ও জর্দানের অন্তর্গত বালকা’ সীমান্ত অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। এটা ছিল রসুলাল্লাহর জীবদ্দশায় সর্বশেষ অভিযান। প্রবীণ মোহাজেরগণের প্রায় সকলেই ওসামা (রা.) এর বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হন। কতিপয় লোক তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে বিরূপ সমালোচনা করেন। তাদের মন্তব্য ছিল, প্রবীণ আনসার ও মোহাজেরদের উপর এত তরুণ একজনকে অধিনায়ক করা হয়েছে। তাদের মূল আপত্তি ছিল, ওসামা একজন ক্রীতদাসের পুত্র। এসব আলোচনা শুনে রসুল মাথায় পট্টি বাঁধা অবস্থায় দু’জনের কাঁধে ভর করে মসজিদে যান এবং সকলকে ডেকে আবারও বলেন, ‘হে সমবেত লোকেরা! তোমরা ওসামার যুদ্ধাভিযান কার্যকর কর। আমার জীবনের শপথ! তোমরা যদি তার নেতৃত্ব নিয়ে কথা বলে থাক, তবে এর আগে তোমরা তার পিতার নেতৃত্বের ব্যাপারে তো কথা তুলেছিলে। অথচ সে নেতৃত্বের যোগ্যই বটে, যেমন তার পিতাও এর যোগ্য ছিল। সে আমার নিকট অধিকতর পছন্দনীয়; আর তার পরে এই ওসামাও আমার নিকট অধিকতর প্রিয়।’ রসুলের এই কথার পর সব গুঞ্জন থেমে যায়।
এভাবে আল্লাহর রসুল একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে উপর্যুপরি আঘাতে চুরমার করে দিয়ে গেছেন। বর্তমান পৃথিবী দাজ্জালের অধীন, পশ্চিমারা এখন বিজয়ী জাতি। যেহেতু বিজয়ীরাই ইতিহাস লেখে তাই যে বিজয়ীদের মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই তাদের লেখা ইতিহাস সব সময় সত্য বলে না। এ কারণেই পাশ্চাত্য দাজ্জালি সভ্যতার অনুসারীরা আমাদেরকে শেখায় যে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাস প্রথার অবসান ঘটান এবং মুক্তি ঘোষণার (Emancipation Proclamation) মাধ্যমে দাসদের চিরস্থায়ীভাবে মুক্ত করে দেন। সেই আব্রাহাম লিঙ্কনের স্বপ্নের গণতন্ত্রই আজ পুঁজিবাদী রূপ নিয়েছে। মানবজাতির মধ্যে সৃষ্টি করেছে বিরাট ভারসাম্যহীনতা। গুটিকয়েক লোক অকল্পনীয় অর্থের মালিক হয়ে জঘন্য ভোগবিলাসে লিপ্ত, অর্থ খরচ করার পথ পাচ্ছে না। অপরদিকে বিরাট জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে জীবন রক্ষার জন্য দাসত্বের অদৃশ্য শৃঙ্খল গলায় পরে আছে। এই দাসত্বের প্রধান একটি রূপ বিশ্বময় ভোগবাদী পণ্যের বাজার সৃষ্টি করার মাধ্যমে চাপিয়ে দেওয়া কর্পোরেট দাসত্ব। নিয়োগকর্তা মালিকপক্ষের অন্যায়, জুলুম, বঞ্চনার বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির ক্ষোভ, অসন্তোষ চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। সুযোগ পেলেই সহিংসতা ও বিক্ষোভের আকারে প্রকাশ ঘটে সেই সঞ্চিত ক্ষোভের। শ্রমিকদের এই বিক্ষোভগুলিকে জোর করে দাবিয়ে রাখা হয়, পেটানো হয়, মেরে ফেলা হয়।
কিন্তু ইসলাম এর ঠিক বিপরীত। স্বেচ্ছায়, উভয়পক্ষের সম্মতিতে, সেবা প্রদানের মানসে শ্রম প্রদানই হচ্ছে ইসলামের নীতি। মানবজাতির রহমতস্বরূপ আবির্ভূত মহানবী নিজের জীবনে বাস্তবে প্রয়োগ করে এবং তাঁর অনুসারীরাও তা বাস্তবায়ন করে কিভাবে দাসপ্রথা (জোরপূর্বক শ্রম আদায়) ব্যবস্থা চিরতরে নির্মূল করলেন তা আর এই জাতিকে জানতে দেওয়া হলো না।