বিগত দুই যুগ ধরে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ইসলাম বিশেষ করে “ইসলামী সন্ত্রাসবাদ”। আফগান-রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে পৃথিবীর অধিকাংশ মুসলিম জনবহুল দেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে এবং হত্যাকাণ্ড, আত্মঘাতী বোমা হামলা, গুপ্তহত্যা, বোমা বিস্ফোরণ, জবাই, পুড়িয়ে মারার মতো বহুবিধ নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়ে তারা মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে একটি ভীতি সৃষ্টি করে দিয়েছে। ইসলাম মানেই বিধর্মীকে হত্যার লাইসেন্স, ইসলাম মানেই বিরুদ্ধমতের উপর চাপাতির আঘাত, ইসলাম মানেই ধর্মান্ধতা, ইসলাম মানেই ধর্মানুভূতির গর্জন ইত্যাদি। ২০১৬ সনে আমাদের দেশে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২০ জন মানুষকে রাতভর জবাই করে হত্যা করে এবং ২ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যা করে। শোলাকিয়ায় দেশের বৃহত্তম ঈদের জামায়াতেও হামলা চালানোর চেষ্টা করে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টিকারী আন্দোলন হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধেও ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীটি বিগত ২৪ বছর হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে নোয়াখালীর সোনাইমুড়িতে মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে ভুল খাতে প্রবাহিত করে গুজব রটিয়ে হেযবুত তওহীদের দুইজন সদস্যকে হাত পায়ের রগ কেটে জবাই করে হত্যা করা হয় এবং গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দিয়ে তাদের নিথর দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। হেযবুত তওহীদের মসজিদ গুড়িয়ে দেওয়া হয়, ঘর-বাড়ি লুট করে অগ্নিসংযোগ করা হয়। গণমাধ্যমসূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি শ্রীলংকার গির্জায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ২৫০ এর অধিক মানুষ হত্যা করা হয়েছে যার দায় স্বীকার করেছে আইএস।
২০১৭ সালে ‘ইসলামী সন্ত্রাসের’ উপর একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ঈইঝ নিউজ। রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে ১২১ টি সন্ত্রাসবাদী দল সক্রিয় রয়েছে যাদের নির্মম সন্ত্রাসের স্বীকার হয়ে ২০১৭ সালে ৮৪ হাজার নিরপরাধ মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৭ সালে সিরিয়ায় ২৯ টি ইসলামী সন্ত্রাসী দল ছিল। সিরিয়ার হামলাগুলোর মধ্যে ৪৪% হামলার জন্য আইসিস দায়ী। বিশ্বের সন্ত্রাসী হামলায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার অর্ধেক মৃত্যু হয়েছে সিরিয়ায়। জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে ইরাক ও সিরিয়ায় সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ আইসিসের ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ হাজার যোদ্ধা সক্রিয় ছিল সেখানে খলিফা প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
এখন প্রশ্ন হলো ইসলাম কি সত্যিই সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয়?
যারা বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হামলা ও আমেরিকার ঈইঝ নিউজসহ জাতিসংঘের তৈরিকৃত রিপোর্টকে কেন্দ্র করে ধারণা করে নিয়েছেন যে ইসলাম সত্যিই সন্ত্রাসবাদের জন্ম দেয় তাদের ধারণা ভুল,ইসলাম কখনোই সন্ত্রাসবাদকে সমর্থন করে না। মূলত এক শ্রেণির লোক ইসলামী সন্ত্রাসবাদের ক্ষেত্রে জেহাদ শব্দটিকে কাজে লাগায়। কিন্তু জেহাদ আর সন্ত্রাসবাদ এক জিনিস নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। জেহাদ শব্দের অর্থ কোন উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা; আর সন্ত্রাস হচ্ছে হিংসাত্মক কাজ করে, বোমা ফাটিয়ে, ধ্বংস করে ভয়-ভীতি সৃষ্টি করা। তাহলে কোথা থেকে এল এই ইসলামী সন্ত্রাসবাদ?
সন্ত্রাসবাদের মূল কারণ-ধর্মবিশ্বাসের অপব্যবহার:
মূলত ইসলামপ্রিয় মানুষের ঈমানকে হাইজ্যাক করে ভুল পথে প্রবাহিত করেই সৃষ্টি করা হয়েছে সন্ত্রাসবাদ। আল্লাহর রসুল (সা.) জেহাদ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন, পবিত্র কোর’আনে জেহাদের হুকুম আছে। তাই ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে জেহাদের ভুল ব্যাখ্যা প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে দিয়ে বহু ধ্বংসাত্মক কাজ করানো সম্ভব। এই পরিস্থিতিতে আমাদের একটা সীমারেখা টানতে হবে, কোনটা ইসলাম আর কোনটা ইসলাম নয়, কোনটা ইসলামের জেহাদ আর কোনটা জেহাদের নামে সন্ত্রাস।
১৪০০ বছর আগে রসুলাল্লাহ অক্লান্ত পরিশ্রম করে আইয়্যামে জাহেলিয়াতে নিমজ্জিত, শতধাবিচ্ছিন্ন বিশৃঙ্খল জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে এমন এক সভ্যতার জন্ম দিলেন যারা চিন্তা-চেতনায়, জ্ঞানে-বিজ্ঞান, প্রযুক্তিতে এক কথায় সর্বদিকে শিক্ষকের আসনে আসীন হয়ে গেল। কিন্তু এরই মাঝে ঘটলো মহাদুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ৬০-৭০ বছর পর জাতি তার আকিদা ভুলে গিয়ে সংগ্রাম ত্যাগ করল। তাদের মধ্যে একটি অংশ দ্বীনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ফতোয়া পাল্টা ফতোয়া দিতে দিতে হাজার রকমের ফতোয়ার ধারা উপধারার পাহাড় তৈরি করল।
অন্যদিকে জাতির মধ্যে জন্ম নিল বিকৃত সুফিবাদ যারা উম্মতে মোহাম্মদীর বহির্মুখী চরিত্রকে পাল্টে দিয়ে অন্তর্মুখী করে দিল। এভাবে ঐক্যহীনতার ফলসরূপ আল্লাহর শাস্তি হিসেবে এই জাতি ইউরোপিয়ানদের গোলামে পরিণত হলো। শুরু হলো ঔপনিবেশিক যুগ, দাসত্বের যুগ।
এরই ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশরা আমাদের চিরকালের জন্য গোলাম বানিয়ে রাখতে একটি চক্রান্ত করল। তারা দুই ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করল- একটি সাধারণ ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা, আরেকটি মাদ্রাসা শিক্ষা। এই দুই বিপরীতমুখী শিক্ষার দ্বারা তারা জাতিটাকে মানসিকভাবে পরিপূর্ণরূপে বিপর্যস্ত করে দিল।
একদিকে সাধারণ শিক্ষায় ধর্মকে বাদ দেয়া হলো অন্যদিকে ২৬ জন খ্রিস্টান অধ্যক্ষের নেতৃত্বে একটি বিকৃত ইসলাম শিক্ষা দিয়ে তা জাতির মন-মগজে গেড়ে দিল। এইবার উভয় শিক্ষায় শিক্ষিতজনেরা একে অপরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুড়িতে লিপ্ত হলো। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে জাতিকে রক্ষা করার পরিবর্তে তারা নিজেরা নিজেরাই মারামারি কাটাকাটিতে লিপ্ত হলো। শুরু হলো ইসলামী সন্ত্রাসবাদের (যদিও এটা প্রকৃত ইসলাম না)। যারা ইসলামবিদ্বেষী তারা এই সুযোগটাকে কাজে লাগালো। ইসলামকে সন্ত্রাসের ধর্ম ও বিশ্বনবী (দ.) কে সন্ত্রাসী বলে প্রোপাগান্ডা চালালো। জঙ্গিবাদীদের পৈশাচিকতা দেখে অনেক চিন্তাশীল মানুষ ইসলাম থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা ভাবছেন যে কোর’আন সন্ত্রাসের শিক্ষা দেয়, বিধর্মীদের হত্যার নির্দেশ দেয় (নাউজুবিল্লাহ)। সন্ত্রাসবাদীদের কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইসলাম।
এর থেকে পরিত্রাণের উপায়?
ইসলামের নামে যে বিকৃত শিক্ষাগুলো দিয়ে, কোর’আনের যে আয়াতগুলোর অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষকে বিভিন্ন ভ্রান্ত পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক লড়াই প্রয়োজন। এই আদর্শিক লড়াইটি করতে হবে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাটি তুলে ধরার মাধ্যমে। মানুষের কাছে এটা সুস্পষ্ট করে দিতে হবে যে, ইসলামের উদ্দেশ্য কী, এটি প্রতিষ্ঠা করার সঠিক পদ্ধতি কী, জঙ্গিবাদ কেন ভ্রান্ত পথ, জঙ্গিবাদকে প্রচার করার জন্য যে আয়াতগুলোকে সামনে আনা হয়, রসুলাল্লাহর জীবনের যে ঘটনা বা হাদিসগুলোকে সামনে আনা হয় সেগুলোর প্রকৃত তাৎপর্য কী। অতঃপর জাতির সবাইকে নিয়ে ন্যায়ের পক্ষে, সর্বপ্রকার অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ন্যায়ের পক্ষে জাতীয় ঐক্যের চেয়ে শক্তিশালী আর কিছু হতে পারে না। ন্যায়ের পক্ষে একতাবদ্ধ হওয়াই হচ্ছে ইসলামের ভিত্তি তওহীদের মর্মবাণী।