মানবজাতিকে আল্লাহ সামাজিক জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। নারী হোক বা পুরুষ হোক- মানুষ হিসাবে তার মূল দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে এই পৃথিবীতে শাসনকার্য পরিচালনা করা, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা। তবে শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে নারী-পুরুষ উভয়েরই স্রষ্টা কর্তৃক সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। সেই দায়িত্ব সুস্পষ্টরূপে অনুধাবন করাই হলো কাঙ্ক্ষিত মানবসমাজ গঠনের পূর্বশর্ত।
একটি মূলনীতি তাদের সমাজগঠনের শুরুতেই মগজে গেড়ে নেওয়া উচিত যে, একটি পরিবারের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে বিধানটি প্রযোজ্য তা দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না, আবার রাষ্ট্রের আইন দিয়ে পরিবার চলতে পারে না। তাই জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনের জন্য ভিন্নরকম ব্যবস্থা থাকতে হয়। সেই ব্যবস্থাগুলি আল্লাহ তাঁর প্রেরিতদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানবজাতিকে দান করেছেন। আল্লাহপ্রদত্ত এই ব্যবস্থার অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর ভারসাম্য। আত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিধানের বিস্ময়কর ভারসাম্যে রচিত এই শ্বাশ্বত দীন। মানবসমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ইবলিস প্ররোচনা দিয়ে জীবনের সেই ভারসাম্য বিনষ্ট করেছে। ফলে মানুষ ভুলে গেছে কার কী কর্তব্য। যে কোনো কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট না থাকলে বিশৃঙ্খলা হতে বাধ্য। একজনের কাজ আরেকজন করতে গেলে বিপর্যয় অনিবার্য। এমন পরিস্থিতি হলে আল্লাহ আবার কোন নবী রসুল পাঠিয়ে সেই হারানো ভারসাম্যকে ফিরিয়ে এনেছেন। এভাবেই মানবজাতি একটার পর একটা যুগ অতিক্রম করে শেষযুগে উপনীত হয়েছে। বর্তমানের ইহুদি-খ্রিষ্টান বস্তুবাদী সভ্যতা (দাজ্জাল) মানুষের জীবন থেকে সর্বপ্রকার নৈতিকতার শিক্ষাকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে এবং স্রষ্টা ও আখেরাতের ধারণাকে অমূলক বলে ঘোষণা করেছে। সেই সঙ্গে সমাজে নারী ও পুরুষের কার কী অবস্থান, কার কী দায়িত্ব ও কর্তব্য তা মানুষ একেবারেই ভুলে গেছে। সকল ধর্ম বিকৃত হয়ে যাওয়ার কারণে এ বিষয়ে স্রষ্টার দেয়া মানদণ্ডও দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে। বর্তমানে ইসলামের যে রূপটি আমাদের সমাজে চালু আছে সেটাও তেরশ বছর ধরে বিকৃত হতে হতে একেবারে বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। আল্লাহ যে নীতি ও মানদণ্ডগুলো দিয়েছেন বিকৃত ও বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। প্রচলিত বিকৃত ইসলামে নারী পুরুষের সঠিক অবস্থান নিয়ে বিস্তর মতভেদ আছে। তবে সকল আলেমই “সুরা নেসার ৩৪ নং আয়াত”কে ভিত্তি হিসাবে উপস্থাপন করেন।
“আর-রিজালু কাওয়্যামুনা আলান্নিসায়ী” – এ আয়াতটিকে ইসলামবিদ্বেষীরাও অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। পুরো আয়াতটির অনুবাদ করা হয়, “পুরুষেরা নারীদের উপর কৃর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, পুরুষেরা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেককার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগতা এবং আল্লাহ যা হেফাযতযোগ্য করে দিয়েছেন লোকচক্ষুর অন্তরালেও তার হেফাযত করে (সুরা নিসা: ৩৪)।”
এই আয়াতের উদ্ধৃত্তি দিয়ে ইসলামকে নারীবিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ইত্যাদি বলে গালি দিতে দিতে নারীবাদীরা মাইক্রোফোন সিক্ত করে ফেলেন। অপরদিকে বিকৃত ইসলামের ধ্বজাধারীরাও নারীদেরকে অবদমিত করে রাখার নিমিত্তে আশ্রয় নেয় এ আয়াতটির। আসুন আমরা নারীনেতৃত্ব নিয়ে এই সহস্রবর্ষী বিতর্কের শেষে একটি বিরাম চিহ্ন টানি।
নারী-পুরুষের মূলকাজ তাদের প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিশীল
পরিবার হচ্ছে সমাজের ক্ষুদ্রতম সংগঠন। যে কোনো সংগঠনেই একজন নেতা থাকতে হয়। না হলে বিশৃঙ্খলা অনিবার্য। পরিবার নামক সংগঠনটিতে কে নেতৃত্ব দিবে? এ আয়াতে পরিবারে নারী-পুরুষের কার কী অবস্থান, অধিকার ও কর্তব্য সে সম্পর্কে একটি মূলনীতি ঘোষিত হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে নারী ভোগ্যবস্তু নয়, দাসীও নয়। এ আয়াতে আল্লাহ পুরুষের ক্ষেত্রে বিশেষণ ব্যবহার করেছেন ‘কাওয়্যামুনা’। শাসক, কর্তৃত্বের অধিকারী, আদেশদাতা, ক্ষমতাশালী, নেতৃত্বের অধিকারী, Authority Power ইত্যাদি বোঝাতে আরবিতে আমীর, সাইয়্যেদ, এমাম, সুলতান, হাকীম, মালিক ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়। এখন আসুন দেখি আল্লাহ এসব কোন শব্দ ব্যবহার না করে ‘পুরুষ নারীর কর্তা’ বোঝানোর জন্য আল্লাহ ‘কাওয়্যামুনা’ শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন। আল্লাহ কোন যুক্তিতে এবং কোন ক্ষেত্রে পুরুষকে নারীর উপরে কর্তৃত্বশীল করেছেন তা এর অর্থের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। কাউয়ামুনা শব্দের অর্থ হচ্ছে সুঠাম ও সুডৌল দেহবিশিষ্ট, মানুষের গঠন কাঠামো, ঠেক্না, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক, অভিভাবক, শাসক, নেতা (আরবি-বাংলা অভিধান ২য় খণ্ড, পৃ ৫৩১- ই.ফা.বা.)। সুতরাং এই আয়াতের মর্মার্থ হচ্ছে, পুরুষ শারীরিক দিক থেকে নারীর চেয়ে শক্তিশালী, তার পেশী, বাহু, হাড়ের গঠন, মেরুদণ্ড এক কথায় তার দেহকাঠামো নারীর তুলনায় অধিক পরিশ্রমের উপযোগী, আল্লাহই তাকে রুক্ষ পরিবেশে কাজ করে উপার্জন করার সামর্থ্য বেশি দান করেছেন, তাই পুরুষের দায়িত্ব হলো সে পুরুষ শক্তি সামর্থ্য প্রয়োগ করে, কঠোর পরিশ্রম করে রোজগার করবে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ভূমি কর্ষণ করে ফসল ফলিয়ে, শিল্পকারখানায় কাজ করে উপার্জন করবে এবং পরিবারের ভরণপোষণ করবে। এই শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই পুরুষকে আল্লাহ নারীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়েছেন, নারীর অভিভাবক করেছেন। এটা মানব সমাজে বিশেষ করে পরিবারে পুরুষের বুনিয়াদি দায়িত্ব।
অপরদিকে নারীদেরকে আল্লাহ সন্তান ধারণের উপযোগী শরীর দান করেছেন, সন্তানবাৎসল্য ও সেবাপরায়নতা দান করেছেন। তাই প্রকৃতিগতভাবেই তাদের মূল কাজ হচ্ছে সন্তানধারণ করা, তাদের লালন-পালন করা, রান্নাবান্না করা এক কথায় গৃহকর্ম করা। তওরাতেও নারী ও পুরুষের প্রকৃত কর্মক্ষেত্র সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। আদম (আ.) ও হাওয়া আল্লাহর অবাধ্য হওয়ায় আল্লাহ তাদের উভয়কে শাস্তিস্বরূপ পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন। তওরাতের বর্ণনা: “আল্লাহ সেই স্ত্রীলোকটিকে বললেন, “আমি তোমার গর্ভকালীন অবস্থায় তোমার কষ্ট অনেক বাড়িয়ে দেব। তুমি যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে সন্তান প্রসব করবে। স্বামীর জন্য তোমার খুব কামনা হবে, আর সে তোমার উপর কর্তৃত্ব করবে।” তারপর তিনি আদমকে বললেন, “যে গাছের ফল খেতে আমি নিষেধ করেছিলাম তুমি তোমার স্ত্রীর কথা শুনে তা খেয়েছ। তাই তোমার দরুন মাটি অভিশপ্ত হল। সারা জীবন ভীষণ পরিশ্রম করে তবে তুমি মাটির ফসল খাবে। তোমার জন্য মাটিতে কাঁটাগাছ ও শিয়ালকাঁটা গজাবে, কিন্তু তোমার খাবার হবে ক্ষেতের ফসল। যে মাটি থেকে তোমাকে তৈরি করা হয়েছিল সেই মাটিতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোমাকে খেতে হবে। তোমার এই ধূলার দেহ ধূলাতেই ফিরে যাবে। (তওরাত: জেনেসিস: ১৬-১৯)।”
সংসদ বাঙ্গালা অভিধানে ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে পতি, ভর্তা, প্রভু, মনিব, অধিপতি, মালিক। আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম হচ্ছে রাব্বুল আলামীন বা বিশ্বজগতের প্রতিপালক। আল্লাহ প্রাণী সৃষ্টি করার আগেই তার জীবনোপকরণের বন্দোবস্ত করে রাখেন। তিনিই মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীকে অস্তিত্ব প্রদান করেন, প্রাণদান করেন, প্রতি নিঃশ্বাসে তাকে অক্সিজেন সরবরাহ করে যান, আলো, পানি, বায়ু সবকিছুই তিনি বাধ্য-অবাধ্য নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে অকৃপণহাতে প্রদান করেন। বিশ্বজগতের প্রতিপালক হিসাবে আল্লাহর যে ভূমিকা, একটি পরিবারে আল্লাহরই প্রতিভূ (খলিফা) হিসাবে পুরুষেরও অনেকটা সেই ভূমিকা। পুরুষও একজন প্রতিপালক কিন্তু অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে। তাই সে তার স্ত্রীসহ পরিবারের জাগতিক প্রয়োজনসমূহ পুরণ করবে, তাদের খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলি যোগান দেবে- এটা তার স্রষ্টা কর্তৃক নির্ধারিত প্রকৃতিগত দায়িত্ব।
প্রথম সারি-দ্বিতীয় সারি (Front Line-Second Line)
যেহেতু উপার্জন করা পুরুষের কাজ, তাই বলা যায় জীবিকার যুদ্ধক্ষেত্রে মেয়েরা দ্বিতীয় সারির সৈনিক। কিন্তু অবস্থার প্রয়োজনে নারীকে যদি জীবিকার লড়াইতে অবতীর্ণ হতে হয় সে সুযোগ আল্লাহ রেখেছেন। অনেক নারী সাহাবি পরিবারে পুরুষ সদস্য না থাকায় বা পুরুষ সদস্যরা জেহাদে অধিক ব্যস্ত থাকায় নিজেরাই ব্যবসা, কৃষি বা কুটির শিল্পের মাধ্যমে উপার্জন করতেন।
আর সত্যিকার যুদ্ধের ময়দানেও প্রথম সারিতে থেকে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেওয়ার দায়িত্ব পুরুষদের। এখানেও কারণ পুরুষের শারীরিক বৈশিষ্ট্য, শক্তি, সামর্থ্য, কষ্টসহিষ্ণুতা ইত্যাদি। জেহাদে নারীর স্বাভাবিক অবস্থান দ্বিতীয় সারিতে। দ্বিতীয় সারির প্রধান কাজ হচ্ছে রসদ সরবরাহ। যুদ্ধে রসদ সরবরাহ হলো যুদ্ধের অর্ধেক। সৈনিকদের খাদ্য, পানি, যুদ্ধাস্ত্র, আহতদেরকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া, সেবা করা, নিহতদেরকে দাফন করা ইত্যাদি সবই দ্বিতীয় সারির কাজ। রসুলাল্লাহর সময় নারীরা প্রায় সকল যুদ্ধেই এসব কাজ করেছেন। আবার যখন এমন পরিস্থিতি এসেছে যে তাদেরকেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হয়েছে।
নারীর নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতাকে ইসলাম মোটেও অস্বীকার করে না। নারী যদি তার জ্ঞান, প্রতিভা, যোগ্যতা, দক্ষতা, সামর্থ্যবলে সামাজিক-সামরিক বা জাতীয় কর্মকাণ্ডের যে কোনো অঙ্গনে নেতৃত্বদানের উপযুক্ত হন, সেক্ষেত্রে অবশ্যই তিনি বহু পুরুষের উপরও নেত্রী হিসাবে নিয়োজিত হতে পারবেন। উটের যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন উম্মুল মো’মেনীন আয়েশা (রা.)। যুদ্ধটির বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে কিন্তু কোনো সাহাবি ঐ সময় “ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম” বলে তাঁর নেতৃত্বদানের বিরুদ্ধে যুক্তি উপস্থাপন করেছেন বলে ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
আল্লাহর বিধানমতে কেবল একটি পদ নারীকে দেওয়া বৈধ নয়, সেটি হলো- উম্মতে মোহাম্মদী নামক মহাজাতির এমামের পদ। আল্লাহ নারী ও পুরুষের দেহ ও আত্মার স্রষ্টা, মনের স্রষ্টা। এদের উভয়ের দুর্বলতা সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো জানেন তিনি। তিনি জানেন যে নারীর শারীরিক গঠন যেমন পুরুষের তুলনায় কোমল, তার হৃদয়ও পুরুষের তুলনায় সংবেদনশীল। সহজেই তার চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে। তার স্থৈর্য্য, দূরদর্শীতা, জ্ঞানের গভীরতা (Wisdom) পুরুষের চেয়ে কম, তাকে প্রভাবিত করা সহজতর। ইবলিস নারীকেই প্রথম আল্লাহর হুকুম থেকে সরিয়েছিল। এ কারণেই আল্লাহর অগণ্য নবী-রসুলের মধ্যে একজনও নারী নেই। সুতরাং পৃথিবীময় উম্মতে মোহাম্মদী নামক যে মহাজাতি হবে সেই মহাজাতির এমাম কেবল নারী হতে পারবেন না, স্বীয় যোগ্যতাবলে অন্যান্য যে কোন পর্যায়ের আমীর বা নেতা সে হতে পারবে। শুধু নারী হওয়ার কারণে সর্বপ্রকার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেউ নেতৃত্ব দিতে পারবে না এমন মূর্খতা ও অন্ধত্বকে ইসলাম কখনও স্বীকার করে না।
বিকৃত ইসলামে নারীর চরম অবমূল্যায়ন
আজকের বিকৃত ইসলামের কূপমণ্ডূক ধর্মজীবী আলেমরা (সুরা নিসার, ৩৪) নম্বর আয়াত উল্লেখ করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই নারীকে পুরুষের অধীন করে রাখার পক্ষে ফতোয়া দিয়ে থাকেন। তারা এটা বুঝতে সক্ষম নন যে, একটি পারিবারিক বিধান দিয়ে সমগ্র জীবন চলে না। জীবনের অন্যান্য অঙ্গনে যার যোগ্যতা বেশি সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক, তাকেই নেতা মনোনীত করা যাবে। একটি প্রতিষ্ঠানের একশ জন কর্মকর্তা, কর্মচারীর মধ্যে যদি জ্ঞান, যোগ্যতা, দক্ষতায় কোনো নারী সবার থেকে এগিয়ে থাকেন তাহলে প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য পূরণের জন্য তাকেই পরিচালক হিসাবে মেনে নিতে বাধা কোথায়? সে হিসাবে একজন নারী কোন এলাকার গভর্নরও হতে পারেন।
আজকের বিকৃত ইসলাম নতমস্তক নারীদের গায়ে বোরকা চাপিয়ে দিয়েছে, অপরদিকে পুরুষকে দিয়েছে স্বৈরশাসকের অধিকার। এই বিকৃত ধ্যানধারণার প্রচারকরা একবারও ভাবেন না যে, তাবুসদৃশ বোরকা গায়ে দিয়ে কি যুদ্ধ করা যায়? ঘোড়ায় চড়া যায়? যদি না-ই যায় তাহলে নারী সাহাবিরা কী করে ঘোড়া ছুটিয়ে যুদ্ধ করলেন? আর আজকে নারীর দিকে তাকানোও কবিরা গোনাহ! এসব মনগড়া, বুদ্ধিহীন, জাতিধ্বংসকারী বানোয়াট শরিয়তকে তারা ইসলামের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে এবং এগুলির অনুকূলে হাজার হাজার বই লিখেছে, হাজার হাজার মাসলা মাসায়েল বের করেছে, এসব নিয়েই শত শত বছর চর্চা, গবেষণা, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চালিয়ে গেছে। এই যুক্তিহীন মূর্খতা ও অন্ধত্ব আজ সমগ্র জাতির উপর জগদ্দল পাথর হয়ে চেপে বসেছে। যারা চিন্তাশীল মানুষ তারাও ধর্মের নামে চলা এই সব মূঢ়তা দেখে ধর্মবিদ্বেষী হয়ে যাচ্ছেন। তারা পাশ্চাত্য সভ্যতার উলঙ্গপনায় আকৃষ্ট, সেটাকে তারা নারী অধিকার ও স্বাধীনতা বলে প্রচার করছেন। পাশ্চাত্য মোহে অন্ধ হয়ে তাদেরও আসল আর নকল ইসলামের মধ্যে প্রভেদ করার জ্ঞান লুপ্ত হয়ে গেছে। ওদিকে নারীবাদীরা হিংস্র মুখভঙ্গি করে বলছেন, নারীকে সর্বক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার দিতে হবে। প্রতিটি বাক্যবাণে তারা ধর্মকেই জর্জরিত করতে সচেষ্ট। তারা জানেন না যে প্রকৃত ইসলাম নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার তো দিয়েছেই, উপরন্তু নারীদেরকে এমন সম্মানিত করেছে যে অপর কোন জীবনব্যবস্থাতে এর ভগ্নাংশও দেওয়া হয় নি। পশ্চিমা সভ্যতা বরং নারীর দেহকে প্রদর্শনীর বস্তু হিসাবেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। তাকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করে বাণিজ্য করছে।
ইসলাম বলে দিচ্ছে প্রকৃতিগতভাবে নারী ও পুরুষের মধ্যে কার কাজের ক্ষেত্র কোনটি। গৃহস্থালী কর্মকাণ্ড ও সন্তান মানুষ করাও জাতির জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নতুন প্রজন্মকে যদি সুশিক্ষিত করে না গড়ে তোলা হয় তবে সেই জাতির ভবিষ্যত অন্ধকার। নারী-পুরুষ উভয়েই যদি জীবিকা অন্বেষণকে সমান অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্র বলে ধরে নেন তাহলে নতুন প্রজন্মকে লালন পালন করবে কে? আজকের জীবনযাত্রা এমন ব্যয়বহুল করে ফেলা হয়েছে যে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উপার্জন করতে হয় আর সন্তান পালন করে কাজের লোক। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়। সন্তান যায় বখে। পারিবারিক বন্ধন বলে কিছুই সৃষ্টি হয় না। সন্তান বাবা-মাকে শ্রদ্ধা করতে শেখে না, ভালোও বাসে না। তাই প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়ে পৃথিবীর তাবৎ নারীকূল যদি জীবিকার সংগ্রামে নামে তাহলে সমাজের মৌলিক সংগঠন পরিবারব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে, ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হবে, সন্তানগুলো অযত্নে, অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাবে। যে পরিবারে উভয়ে রোজগার করে সেখানে কেউ কারো কথাই মানতে বাধ্য থাকে না। তাই শিক্ষিত ও উপার্জনক্ষম নারীদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদের হার সবচেয়ে বেশি। পাশ্চাত্যে তো কথায় কথায় বিবাহবিচ্ছেদ। সেখানকার অনেকদেশে বিবাহবন্ধন অকেজো হয়ে যাচ্ছে লিভটুগেদারের মোকাবেলায়। তাদের কারো সময় নেই সন্তানদের দিকে চেয়ে দেখার। ফলে সন্তানরাও শৈশব না পেরোতেই ব্যভিচারে আর মাদকে আসক্ত। এভাবেই আধুনিকতার নামে মানুষ আবার পশুর সমাজ কায়েম করে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। তারা ভোগ, মাদক, অবাধ যৌনতার মধ্যে তৃপ্তি খুঁজছে কিন্তু শান্তি পাচ্ছে না। দিনকেদিন বাড়ছে হতাশা, বাড়ছে বঞ্চনা। তাই ধনী রাষ্ট্রগুলোর নাগরিকরা আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে প্রথম দিকেই থাকেন। আমাদের প্রগতিবাদী ও নারীবাদীরা সম-অধিকারের নামে আসলে এই নরকটাই কায়েম করতে চান। প্রকৃত ইসলাম একে সমর্থন করে না, কারণ এর ফল অশান্তিময়। মানবজাতি যদি সত্যিই শান্তি চায়, তাদেরকে বর্তমানে প্রচলিত ভারসাম্যহীন বিকৃত ইসলাম এবং ভারসাম্যহীন পশ্চিমা জীবনব্যবস্থা দুটো থেকেই বেরিয়ে আসতে হবে।