ইসলাম আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট যারা জানেন তাদের এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, আল্লাহর রসুল (সা.) যে সমাজে আসলেন সেটা ছিল আইয়্যামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকারের যুগ। সে সমাজে ছিল না কোন ন্যায়, সুবিচার, শান্তি, নিরাপত্তা। সর্বদা চলত এক গোত্রের সাথে আরেক গোত্রের দ্বন্দ, মারামারি, হত্যা, গুম, লুটতরাজ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, হানাহানি। সেখানে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতিতে শাসন চলত। নারীদের কোন সম্মান ছিল না, ইজ্জত ছিল না, জীবন্ত মেয়ে মানুষ কবর দিত। ধর্মীয় গোঁড়ামী ও অপসংস্কৃতির চর্চায় মানুষ বেহায়াপনায় নিমজ্জিত ছিল। সর্বদিক থেকে অবজ্ঞাত, অশিক্ষিত, মূর্খ, পরনির্ভরশীল জাতিতে নিমজ্জিত ছিল আরব সমাজ।
সেই সমাজে আল্লাহর রসুল (সা.) আসলেন। রসুলের সমগ্র জীবনকে একনজরে দেখলে আমরা পাই তাঁর তেইশ বছরের নব্যুয়তি জীবন, যার তের বছর মক্কায় কেটেছে এবং বাকি দশ বছর মদিনায়। মক্কার তের বছর তাঁকে অবর্ণনীয় কষ্ট, নির্যাতন, আঘাত সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু মদিনার দশ বছর ছিল শাসনের, কর্তৃত্বের, খেলাফতের। একইভাবে মক্কার দশ বছর তিনি শুধুই তওহীদের প্রতি, কলেমার প্রতি, ঈমানের প্রতি মানুষকে আহ্বান করেছেন। একটি একক জাতিসত্তা গঠনের তাগিদ দিয়েছেন। যারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিল তাঁরা হয়েছিল মুসলিম। জাহিলিয়াত থেকে মুখ ঘুরিয়ে আল্লাহর সত্যদীন তসলিম বা গ্রহণ করে নিয়েছিল। একটা সময় তাঁরা আল্লাহর নির্দেশে মদিনায় হেযরত করেন। তিনি তাঁর নবগঠিত জাতিটির মধ্যে থেকে একটি উম্মাহ গঠন করেন, যার নাম ‘উম্মতে মোহাম্মদী’। অবশ্য একে একটি জাতি না বলে সামরিক জাতি বললেই সমীচীন হয়। যে জাতির লক্ষ্য স্থির করে দিলেন স্বয়ং রসুলাল্লাহ (সা.) যেটা হলো, সমগ্র পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করে ন্যায়, সুবিচার, সাম্য এক কথায় শান্তিময় সমাজ নির্মাণ করা। এটি করতে গেলে যে সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবে তা নবী জানতেন। তাই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাকে অবশ্য পালনীয় নির্ধারণ করেছেন (সুরা বাকারা: ২১৪)। এজন্যই নবুয়ত পাওয়ার পর থেকে রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর অনুসারীদের নিয়ে একটি উম্মাহ গঠনের কাজে হাত দিলেন। তাঁর সেই উম্মাহর মধ্যে থেকে তৈরি হয়েছিল আলি, আবু উবায়দা, সাদ বিন আবি ওয়াক্কাস, যায়েদ বিন হারেস, আমর ইবনুল আস, খালিদ বিন ওয়ালিদের (রা.) মতো বীর যোদ্ধারা, যারা তাঁর অন্তর্ধানের পর বাকি পৃথিবীতে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
প্রিয় নবী জেহাদ অর্থাৎ সর্বাত্মক সংগ্রামকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন তা বোঝা যায় তাঁর জীবনের কয়েকটি উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনা থেকে। ওহুদ যুদ্ধে রসুল (সা.) কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে যেয়ে পবিত্র রক্ত ঝরিয়েছেন ও দন্ত মোবারক হারিয়েছেন। ইতিহাসবিদদের মতে রসুল (সা.) তাঁর সমগ্র জীবন বা শেষ নয় বছরে ৭৮টি ছোট-বড় অভিযান ও যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে ২৭টি যুদ্ধে তিনি সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। যেসব যুদ্ধ রসুল (সা.) সক্রিয় থেকে পরিচালনা করেছেন সেগুলোকে ‘গাজওয়া’ ও যেগুলো সাহাবীদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছে কিন্তু পরোক্ষভাবে রসুল (সা.) দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলোকে ‘সারিয়া’ বলে।
একজন মানুষ কোন কাজটিকে তার জাতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন এটা বোঝা যায় অন্তিম সময়ে তার নির্দেশিত আদেশসমূহে। রসুলাল্লাহর (সা.) জীবনের সবশেষ অভিযান ছিল তাবুকের অভিযান। এরপর তিনি তাঁর সমগ্র বাহিনীকে পালিতপুত্র যায়েদের (রা.) ছেলে ১৭ বছর বয়সী ওসামা বিন যায়েদের (রা.) নেতৃত্বে মুতার প্রান্তরে পাঠান। রসুল (সা.) নিজে তাঁর মাথায় যুদ্ধের আমামা বেঁধে দিয়ে হাতে যুদ্ধের পতাকা দিয়ে বলেন, “ওহে ওসামা! যাও সেই মুতার প্রান্তরে যেখানে তোমার বাবাকে শহীদ করা হয়েছে”। ওসামা (রা.) তাঁর বাহিনী নিয়ে যুদ্ধের জন্য মুতার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পথিমধ্যে খবর পেলেন শুনলেন রসুলাল্লাহ (সা.) এন্তেকাল করেছেন। সাথে সাথে তিনি মদিনায় ফিরে আসেন। রসুলের দাফনের পর নব-খলিফা আবু বকর (রা.) প্রথম ভাষণেই বলেন, “হে মুসলিম উম্মাহ। তোমরা সংগ্রাম ত্যাগ করো না, যে জাতি সংগ্রাম ত্যাগ করে আল্লাহ তাদের অপমানিত লাঞ্ছিত না করে ছাড়েন না”। এজন্য শোকের ছায়া কাটতে না কাটতেই তিনি আবার ওসামার বাহিনীকে রসুলের শেষ নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য মুতার যুদ্ধে প্রেরণ করেন।
রসুলাল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় নয় বছরে ৭৮টি যুদ্ধের মাধ্যমে সমগ্র আরব উপদ্বীপ বা জাজিরাতুল আরবে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেলেন। বাকি দুনিয়ায় ইসলাম, ন্যায়, শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তাঁর গঠিত বাহিনী উম্মতে মোহাম্মদীর ওপর। উম্মতে মোহাম্মদীও তাঁর নেতার কথামতো সংসার, পরিবার, স্ত্রী-পুত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজত্ব সবকিছু ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল বাকি পৃথিবীর উদ্দেশে। তাঁরাও তাদের এক জীবনে যতটুকু সম্ভব অর্ধ-পৃথিবীতে সত্যদীন প্রতিষ্ঠা করলেন। তৎকালীন দুই দু’টি সুপার পাওয়ার বা বিশ^শক্তি রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে একই সাথে তুলোর মতো উড়িয়ে দিলেন। এটা কোন রূপকথা নয়। হঠাৎ মরুর বুক চিরে একটি বাহিনী উদ্ভূত হয়ে হাজার বছরের সাম্রাজ্য, যাদের রয়েছে বিপুল সমরাস্ত্র, অগণিত সৈন্য, অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, যাদের একজন সাধারণ যোদ্ধাকে দশজন আরব যোদ্ধার সমতুল্য মনে করা হতো, তাদেরকে একই সাথে পরাজিত করেছে। এটা ইতিহাস উম্মতে মোহাম্মদীরা যাদের সাথে যুদ্ধে লড়েছিল তারা ছিল প্রতিটি যুদ্ধে আরব যোদ্ধাদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সংখ্যক ও শক্তিশালী। এত স্বল্প সময়ে বিরাট একটি অঞ্চলে সামরিকভাবে পদানত করা পৃথিবীর কোন বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হয় নি। এটাই ছিল উম্মতে মোহাম্মদী জাতির বৈশিষ্ট্য- তারা ছিল মোহাম্মদের (সা.) উম্মত, অপরাজেয়, দুর্বার, অপ্রতিরোধ্য একটি জাতি।
এরপর ঘটল মহাদুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। জাতি ভুলে গেল কী তাদের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আকিদা। কেন উম্মতে মোহাম্মদীকে সৃষ্টি করা হয়েছিল? অর্ধ-পৃথিবীর সম্পদ, রাজত্ব পেয়ে ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দিল। সংগ্রাম ত্যাগ করল। পরিণতিতে তাই ঘটল যা আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জেহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহর হুশিয়ারি ছিল, “যদি তোমরা জেহাদে, অভিযানে বের না হও তবে তোমাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিব এবং অন্য জাতিকে তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিব। তোমরা তাঁর কোন ক্ষতিই করতে পারবে না” (সুরা তওবা: ৩৯)। এটি শুধু আল্লাহর সর্তকবার্তা ছিল না, বরং লা’নতের পূর্বাভাসও ছিল। এজন্যই আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছিলেন, “আমার উম্মাহর আয়ু হবে ৬০/৭০ বছর” [হাদীস: আবু হোরায়রা (রা.) থেকে তিরমিজি, ইবনে মাজাহ]।
ইতিহাসেও তাই পাই ৬০-৭০ বছর পর্যন্ত উম্মতে মোহাম্মদী জাতিগতভাবে জেহাদ টিকিয়ে রেখেছিল। এ সময়ের মধ্যেই তারা দখল করে নিয়েছিল আটলান্টিকের তীর থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত তৎকালীন অর্ধ-পৃথিবী। যখনই সংগ্রাম ত্যাগ করল মুসলিমদের দখলে আর রাজ্য বিস্তার হতে পারল না অর্থাৎ ইসলামেরও বিস্তৃতি থমকে গেল। প্রচণ্ড গতিশীল একটি ঘোড়া যেন হঠাৎ স্থবির হয়ে গেল, বসে পড়ল, আস্তে আস্তে শুয়ে পড়ল আর উঠে দাঁড়াতে পারল না।
সময়টা ছিল ৭১২ খ্রি. উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের শাসনামল। এসময় তাঁর গুরুত্বপূর্ণ দুটি সিদ্ধান্ত ইসলামের ভূখণ্ডবিস্তারে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। একটি হচ্ছে ১৭ বছর বয়সী তরুণ মুহাম্মদ বিন কাশিমকে সিন্ধু বিজয়ের জন্য প্রেরণ এবং তারিক বিন জিয়াদকে স্পেন জয়ের জন্য প্রেরণ। এর সূদুরপ্রসারী ফল হলো- এই প্রথম ইসলাম মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও এশিয়া পার হয়ে নতুন কোন অঞ্চলে প্রবেশ করছিল। ইউরোপে ইসলামের ঝাণ্ডা উড্ডীন হয় এবং ভারতবর্ষে ইসলামের শুভাগমন ঘটে। তাঁদের বীরত্বব্যঞ্জক সেনাপতিত্বে দুর্ধর্ষ উম্মতে মোহাম্মদী দুটো বড় রাজ্যই জয় করে নেয়। এরপর সেনাপতি তারিক ও মুহাম্মদ বিন কাশিম সামনে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি চাইলে খলিফা অনুমতি দেন।
খলিফা ওয়ালিদ বিন আব্দুল মালিকের সাথে খেলাফতের দ্বন্দ্ব ছিল তাঁর সহোদর সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের সাথে। ৭১৫ খ্রি. যখন খলিফা ওয়ালিদ মারা যান তখন খেলাফতের চেয়ারে আরোহণ করে সুলায়মান বিন আব্দুল মালিক। পূর্বের খলিফার সাথে যেহেতু শত্রুতা ছিল তাই সুলায়মান ওয়ালিদের ঘনিষ্ঠ সকলকে হত্যা করলেন যেন তার ক্ষমতায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে না পারে। তিনি সিন্ধু থেকে মুহাম্মদ বিন কাশেমকে ডেকে এনে হত্যা করেন। থেমে যায় ভারতবর্ষের বৃহৎ ভূখণ্ডে ইসলামের বিস্তার। এতেও তিনি ক্ষান্ত হন না। স্পেন বিজয়ী তারিক বিন যিয়াদ ও সেনাপতি মুসা বিন নুসায়েরকে ঠুনকো অজুহাতে কেন্দ্রে ডেকে পাঠান ও অতিরিক্ত অর্থ জরিমানা করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। ব্যাস সমগ্র ইউরোপ ইসলামের ছায়াতলে আসার সকল পথই বন্ধ হয়ে যায়। এরপরের ইতিহাসে আর তেমন একটা জাতিগত জেহাদের ঘটনা পাওয়া যায় না। না পাওয়ারই কথা। এরই মধ্যে জাল হাদিসের বিস্তার ঘটে আর জাতির মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ‘নফসের বিরুদ্ধে জেহাদই বড় জেহাদ’। কে আর ঘরে বসে বড় জেহাদ বাদ দিয়ে ছোট জেহাদ করতে রণাঙ্গনে গিয়ে নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি ডেকে আনবে?
রসুলের (সা.) এন্তেকালের পর থেকে ৬৩৩ খ্রি. থেকে ৭১৫ খ্রি. পর্যন্ত সময়ের পার্থক্য প্রায় ৮০ বছর। অর্থাৎ আখেরী নবীর (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী একদম মিলে গেল। জাতির আয়ু এখানে শেষ হয়ে গেল। এরপরের মুসলিমদের ইতিহাস খুব একটা গৌরবদীপ্ত নয়। হালাকু খানের আক্রমণ, স্পেন থেকে বিতাড়িত হওয়া, ক্রুসেডারদের হাতে পতন ও সর্বশেষ ইউরোপিয়ানদের হাতে সমগ্র মুসলিম জাতি পদানত হওয়ার মাধ্যমে জাতির অভিশপ্ত দাসত্ব ও শত শত বছরের গোলামির জীবন পাকাপোক্ত হয়ে গেল। এরপর আর এ জাতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে নি। এখনও ১৬০ কোটির মুসলিম দাবিদার প্রায় ৫৫টি ভৌগোলিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের গোলামি করে যাচ্ছে।