প্রিয় নবীজীর ডাকে সর্বপ্রথম যাঁরা সাড়া দেন, পাশে এসে দাঁড়ান, জীবন-সম্পদ সঁপে দেন সত্যের জন্য তাঁদেরই অন্যতম আবু বকর, বেলাল, খাব্বাব, সুহাইব, আম্মার ও সুমাইয়্যা (রা.)! সে ছিল এক ভয়ঙ্কর পরীক্ষাকাল।
ভাগ্যবানদের ইসলাম গ্রহণের এক একটি সংবাদ বিষাক্ত তীর হয়ে বিদ্ধ হতো বেঈমান আবু জেহেলদের আত্মায়। তারা ক্ষুব্ধ হতো। হিংস্রতায় ফেটে পড়তো। সেই ক্ষোভ, ক্রোধ ও হিংস্রতা এক সময় চরম পাশবিক রূপ নিল। তারা জোর করে ইসলামকে প্রতিহত করবে ভাবল। সত্যের যে প্রদীপ জ্বেলেছেন স্বয়ং প্রভু তারা সেই প্রদীপ নিভিয়ে দিতে চাইল।
মো’মেনদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন বেশ শক্তিশালী। বংশের শক্তি, বিত্তের বল সবই ছিল তাদের। যেমন আবু বকর (রা.)! কিন্তু অনেকেই ছিলেন এমন যাদের কোন শক্তি ছিল না। বংশেরও না, বিত্তেরও না! বেলাল, সুহাইব, আম্মার, ইয়াসির ও সুমাইয়্যা (রা.) তাঁদেরই মধ্যে।
আম্মার (রা.)-এর মা সুমাইয়া! বাবা ইয়াসির! বাবা ইয়াসির ছিলেন মূলত কহতানের অধিবাসী। হারানো ভাইয়ের সন্ধানে এসেছিলেন মক্কায়। তারপর থেকে যান এখনেই স্থায়ীভাবে। চুক্তি ও সন্ধিবদ্ধ হন মক্কায় আবু হুযাইফার সাথে। অবশেষে আবু হুয়াইফার দাসী সুমাইয়্যাকে বিয়ে করেন। এ ছিল ইসলামের পূর্বের ঘটনা। অতঃপর এ যুগল থেকেই জন্ম নেন আম্মার (র.)। তাই মক্কায় আম্মার পরিবারের কোন শক্ত খুটি ছিল না। আর খুঁটি ছিল না বলেই মক্কার কাফেরদের রক্তচক্ষুর প্রধান টার্গেট ছিল এই আম্মার পরিবার। নির্যাতনের তাপিত প্রান্তরে ছিল সুমাইয়্যা ইয়াসির ও আম্মারের বাস। প্রচণ্ড গরমকালে মক্কার বালুকাময় প্রান্তরের প্রতিটি বালুকণা জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো দাউ দাউ করতো। তার উপর দিয়ে ভর দুপুরে কেউ হেঁটে যাওয়ার সাহস করতো না। পায়ে ফোসকা পড়ে যেত। তাপিত এই জ্বলন্ত বালুর উপর তাদেরকে শুইয়ে রাখা হতো। অবাধ্য জানেয়ারকে যেভাবে পেটানো হয় সেভাবে পেটানো হতো তাঁদের। তাদের একটাই অন্যায়, তারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, তারা মো’মেন হয়েছেন। হাতের তৈরি মূর্তিগুলোকে এখন আর ভাগ্যবিধাতা, প্রভু মানে না। তারা প্রভু, হুকুমদাতা মানে আল্লাহকেই। প্রহারে প্রহারে বেহুঁশ করে ফেলা হতো তাঁদেরকে।
কখনো বা শাস্তির ধরন বদল করতো তারা গরম পানির মধ্যে চেপে ধরতো মাঝে মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। শরীরের চর্বিগুলো গলে পানি হয়ে পড়তো। আর তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে ডাকতো কেবলই আল্লাহকে। করণ, এক আল্লাহ ছাড়া তাঁদের আর কোন সহায় ছিল না।
তাছাড়া সুমাইয়্যা আর ইয়াসির (রা.) ছিলেন বয়সের ভারে দুর্বল। গায়ে শক্তি নেই। তবে হৃদয়ে বিশ্বাসের বল ছিল। আর সে বলেই লড়ে যাচ্ছিলেন তাঁর সময়ের ফেরাউনদের বিরুদ্ধে। প্রচণ্ড নির্যাতনে আর দাবানলের ভেতরে থেকেও কেবল ‘আহাদ-আহাদ’ ধ্বনিতে জাগিয়ে রাখতেন প্রতিটি রক্তকণাকে।
মাঝে মধ্যে রসুল (সা.) তাঁদের পাশে দিয়ে যেতেন। দেখতেন জ্বলন্ত অঙ্গারে পুড়ে মরছে আল্লাহর সৈনিকেরা। বুড়ো মা-বাবা সঙ্গে কচি আম্মার। নবীজী কখনো বা আম্মারের মাথায় হাত রেখে বলতেন:
“হে আগুন! ইবরাহীম (আ.)-এর জন্যে যেমন শান্তিদায়ক শীতল হয়ে গিয়েছিলে আম্মারের জন্যও তেমনি হয়ে যাও!”
সুমাইয়্যা ও ইয়াসিরকে (রা.) যখন নির্যাতিত হতে দেখতেন তখন বলতেন: ইয়াসির পরিবার ধৈর্যে ধর! কখনো বা বেদনার ভার সইতে না পেরে প্রিয়তম প্রভুর দরবারে এই বলে প্রার্থনা করতেন: হে আল্লাহ! তুমি ইয়াসিরের পরিবারকে ক্ষমা কর! কখনো বা বলতেন: ইয়াসির পরিবার! সুসংবাদ শোন, বেহেশত তোমাদের অপেক্ষায় অধীর! নবীজীর আর কী-ই বা করার ছিল। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরই চোখের সামনে কোনো অন্যায় ছাড়াই এভাবে নির্যাতিত হচ্ছে এঁরা। তাও সুমাইয়ার মত একজন নিরপরাধ ক্রীতদাসী। এত নির্যাতন এত শাস্তি ও এত অত্যাচারের পরও সত্যের পথে অবিচল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি পরম বিশ্বাস ও ভালোবাসায় নমিত- নিবেদিত। নমরূদের অগ্নিকুণ্ডে যেমনটি ছিলেন ইবরাহীম (আ.)!
কোরায়েশদের নির্মমতা মাঝে মধ্যে সীমা ছাড়িয়ে যেত। তখন আর তারা মানুুষ থাকতো না। বন্য হায়েনাদেরকেও হার মানাতো তারা তখন এই অসহায় দুর্বল নিরপরাধ মানুষগুলোকে লোহার পোশাক পরিয়ে জ্বলন্ত বালুর উপর দাঁড় করিয়ে রাখতো। মাথার উপর থেকে সূর্য ভারি বর্ষার মতো তাপ ঢালতো, বাতাস বয়ে আনতো তপ্ত দাবদাহ আর পায়ের তালার বালুরাশি তুষের আগুনের মত সেদ্ধ করে তুলত দুটো পা! অসহায় সুমাইয়্যা, অসহায় ইয়াসির আর অসহায় আম্মার দগ্ধ হতে থাকতেন সে ভয়ঙ্কর অগ্নিজ্বালায়। ঈমানের সে অগ্নিপরীক্ষা ভাষায় বর্ণনাতীত। এভাবেই একদিন ঘনিয়ে আসে আল্লাহর নির্ধারিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, সুমাইয়্যার (রা.) চূড়ান্ত সফলতার দিন, তাঁর অমরত্ব লাভের লগ্ন।
আর সব দিনের মতো সেদিনও ভয়ঙ্কর মরুভূমির অগ্নিসম উত্তাপে দগ্ধ হচ্ছেন সুমাইয়্যা (রা.)! তার সামনে দিয়েই যাচ্ছিল বেঈমান আবু জেহেল। সুমাইয়্যা (রা.) কে দেখে তার ভেতরটা জ্বলে ওঠল। জ্বলে উঠল নিজেদের পরাজয়ের কথা ভেবে। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ থেকে যেন ধিক্কার বাণে জর্জবিত হচ্ছিল আবু জেহেল। ভাবছিল, ওরা দুর্বল! ক্রীতদাস ওরা, আর এই সুমাইয়্যা! একজন অসহায় বুড়ি। অথচ কত শাস্তি দিলাম! কিন্তু একটুও নরম হলো না। মাথা নোয়াবার কোন লক্ষণ নেই। এত অত্যাচারের ভেতরও সেই ‘আহাদ আহাদ’ রব। ‘এক আল্লাহ এক আল্লাহ’ ধ্বনি।
আবু জেহেল ঠিক থাকতে পারল না। পাপের হাওয়া তার ভেতরে মহা তুফান সৃষ্টি করল। হাতে ছিল একটি বিষাক্ত বর্শা। ছুঁড়ে মারল সুমাইয়্যা (রা.)-এর লজ্জাস্থানে! ভাগ্যবতী মহান জান্নাতী নারী তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলেন। ক্ষণকাল পরেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করে ঘুমিয়ে পড়লেন মরুর বালুতে। ইসলামের চির সবুজ শান্তিবৃক্ষ সিক্ত হলো সর্বপ্রথম এই জান্নাতী নারীর পবিত্র রক্তে।
পৃথিবীর সমগ্র নারী জাতির জন্য এ এক বিস্ময়কর গৌরব। আল্লাহর দীনকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রক্ত দিয়েছেন তো অনেক ভাগ্যবানই। নবীজীর (সা.) প্রিয়তম চাচা হামযা, হানযালা, সাদ, আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ, খুযাইমা (রা.) থেকে শুরু করে কত ভাগ্যবানই তো জীবন দিয়েছেন আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু সর্বপ্রথম খোদার রাহে জীবন বিলাবার গৌরব সে সুমাইয়্যা (রা.)-এর, একজন নারীর। তিনি ইসলামের ইতিহাসে প্রথম শহীদ।
এরপর তাঁর স্বামী ইয়াসিরকেও (রা.) মক্কার কাফেররা নির্যাতন করে শহীদ করে দেয়। বেঁচে থাকেন তাদের হৃদয়ের ধন আম্মার (রা.)! তারও অনেক পর যখন আল্লাহ মো’মেনদেরকে মদীনায় প্রতিষ্ঠিত করেন তখন তাঁরা ঘুরে দাঁড়ান। সত্যদীনকে প্রতিষ্ঠা করে মানবজীবন থেকে সকল অন্যায় অবিচার অশান্তি বিলুপ্ত করার অবিনাশী প্রেরণায় উজ্জীবিত নবীর সঙ্গীগণ শুরু করেন জীবনের অন্য পর্ব- শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। তাঁরা রুখে দাঁড়ান সন্ত্রাসী কাফেরদের বিরুদ্ধে। সংঘটিত হয় ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ, সত্য-মিথ্যা আলাদা হয়ে ওঠার যুদ্ধে। আল্লাহর সৈনিকেরা ঝাঁপিয়ে পড়েন রণাঙ্গনে- সত্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে। আল্লাহ বিজয় দান করেন মো’মেনদেরকে। এমনকি মক্কার সবচেয়ে’ বড় কাফের আবু জেহেলও মারা যায় এই যুদ্ধে।
নবীজীর (সা.) পাশে তখন আম্মার। শহীদ জননীর বীর পুত্র আম্মার। সামনে হতভাগা আবু জেহেলের লাশ। অসহায় বৃদ্ধা মায়ের রক্তমাখা বদনখানি যেন স্বরূপে ভেসে ওঠল আম্মারের সামনে। নবীজী তখন সান্ত্বনার সুরে বললেন: “আল্লাহ তোমার মায়ের হত্যাকারীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন।” [সূত্র: সীরাতুল মুসতাফা-১:২২৫-২২৭ পৃ.]
[মুহাম্মদ যাইনুল আবিদীন বিরচিত “ভূবনজয়ী নারী” গ্রন্থ থেকে ঈষৎ সম্পাদিত। সম্পাদনায় আনিসুর রহমান]