হেযবুত তওহীদ

মানবতার কল্যাণে নিবেদিত

ইসলামের দৃষ্টিতে মোরাল পুলিশিং ও মব জাস্টিস

সুয়াইবুল বান্না:
ধর্মীয় বিধান দিয়ে পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সাধারণত ধর্মতন্ত্র বা মোল্লাতন্ত্র (Theocrac) বলা হয়। ইসলামের নামে পরিচালিত মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় নৈতিক পুলিশ, শরিয়াহ পুলিশ নামে একটি বিশেষ বাহিনীর কার্যক্রম দেখা যায় যাদের কাজ ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা। বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশে ও অঞ্চলে ‘শরিয়াহ আইন’ বলবৎ রয়েছে। এসব দেশে শরিয়াহ আইন বলতে যে আইনগুলোর চর্চা হয়ে থাকে সেগুলো মূলত বিগত এক হাজার বছরে লিখিত বিভিন্ন ফিকাহ ও মাস’আলা-মাসায়েলের গ্রন্থাদি থেকে উৎসারিত। শরিয়াহ রাষ্ট্রের (Sharia-Based State) অনেক আইন নিয়ে ইসলামের বিভিন্ন মাজহাবের ফকিহদের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য রয়েছে। আর কোর’আন ও রসুলাল্লাহর সুন্নাহর সঙ্গেও রয়েছে এসব শরিয়াহ রাষ্ট্রের চারিত্রিক বৈপরীত্য। তাই যেসব এলাকায় কথিত ‘শরিয়াহ আইন’ প্রতিষ্ঠিত আছে, সেসব এলাকায় ইসলামের প্রাথমিক যুগের সেই অনাবিল সৌন্দর্য প্রকাশিত হওয়ার বদলে শরিয়াহ আইনের বিরুদ্ধে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। এর কারণ কী? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে ‘শরিয়াহ পুলিশ’ বা মোরাল পুলিশ নামক বিশেষ পুলিশিং ব্যবস্থা।

এই নৈতিক পুলিশ বাহিনীর কাজ হচ্ছে কে কতটুকু ‘রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত ধর্মীয় বিধিনিষেধ’ পালন করল সেটা তদারকি করা- যেমন কোনো নারীর হেজাব ঠিক আছে কিনা, তাদের চুল দেখা যাচ্ছে কিনা, কোনো মেয়ে আঁটশাট পোশাক পরল কিনা, কোনো পুরুষ দাড়ি কামালো কিনা, কেউ হাফপ্যান্ট বা পশ্চিমা স্টাইলের পোশাক পরল কিনা, নামাজের সময় কেউ দোকান খোলা রাখল কিনা, কেউ মসজিদে না গিয়ে ঘোরাফেরা করছে কিনা, রমজানে কোনো খাবার দোকান খোলা রেখেছে কিনা, কেউ রোজা না রেখে বাড়ির বাইরে খাওয়া দাওয়া করছে কিনা, অবিবাহিত কোনো যুগলকে একসাথে দেখা গেল কিনা, কোনো স্থানে নারী পুরুষ একত্রে কাজ করছে কিনা, কেউ জোরে গান বাজাচ্ছে কিনা ইত্যাদি তদারকি করা।

দেশভেদে এসব ‘অপরাধের’ ভিন্ন ভিন্ন সাজা রয়েছে, যেমন গ্রেপ্তার, জেল, জরিমানা, উপদেশ, সফর নিষেধাজ্ঞা, প্রকাশ্যে অপমান, লাঠি দিয়ে বেধড়ক মার, সংশোধনমূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়া ইত্যাদি। নৈতিক পুলিশের ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে জানার জন্য কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি যেগুলো ঘটার পর বিশ্বে এই বাহিনী ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে।

ইরান: ইরানের নৈতিক পুলিশ বাহিনীর নাম গাশতে ইরশাদ। নৈতিক পুলিশ প্রসঙ্গে বলতে গেলে মাহসা আমিনির প্রসঙ্গ এসেই যায়। ২০২২ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ২২ বছরের কুর্দী তরুণী মাহসা আমিনি তার পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে তেহরানে নৈতিক পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, তিনি হিজাব সঠিকভাবে পরেননি, ফলে তার কিছু চুল বেরিয়েছিল। পুলিশ তাকে ডিটেনশনে নিয়ে যায় এবং মানসিক ও শারীরিকভাবে নির্যাতন চালায়। তাদের নির্যাতনের সময় মাহসা পুলিশি হেফাজতেই সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন এবং তিন দিন কোমায় থাকার পর হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। এই নির্মম ঘটনায় ইরানজুড়ে তীব্র জনরোষ ছড়িয়ে পড়ে এবং নারীর অধিকারের দাবিতে সেটা এক ঐতিহাসিক আন্দোলনে রূপ নেয়। হাজার হাজার নারী তাদের হেজাব পুড়িয়ে, চুল কেটে ক্ষোভ প্রকাশ করে। সরকার এ আন্দোলন দমনে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। আন্দোলনকারীদের উপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলি চালায়, অসংখ্য মানুষকে গ্রেপ্তার করে এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। নিরপেক্ষ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে ৫৩৭ জন মানুষকে হত্যা করা হয়, ১৯,২৬২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। হতাহতের মধ্যে প্রচুর নারী ও শিশুও রয়েছে।

সৌদি আরব: ২০০২ সালের ১৪ মার্চ মক্কার মোহাম্মদিয়া গার্লস স্কুলে ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। সেদিন যে কোনোভাবেই হোক স্কুলে আগুন লাগে। তখন আতঙ্কিত হয়ে ছাত্রীরা প্রাণ বাঁচাতে স্কুল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু সে জরুরি অবস্থাতেও আরবের নৈতিক পুলিশ (মাতাব) ছাত্রীদেরকে স্কুল থেকে বের হতে দেয়নি, কারণ সে সময় নাকি ছাত্রীদের হিজাব সঠিকভাবে পরা ছিল না। ফলে ১৫ জন ছাত্রী অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যায়, অনেকেই আহত হয়। এই ঘটনায় সৌদি আরবের প্রধান পত্রিকা আল ওয়াতান-এ খবর প্রকাশিত হয়। আশ্চর্যজনক বিষয় হল, এই অমানবিক ঘটনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ব্যাপক সমালোচনা করলেও সৌদি আরবে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ বা বিক্ষোভ সমাবেশ হতে দেখা যায়নি।

আফগাস্তিান: ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আফগানিস্তানে দ্বিতীয়বার তালেবান শাসন প্রতিষ্ঠার পর তাদের নৈতিক পুলিশ (বাইরাত) জনগণকে শাস্তি দিতে তৎপর হয়ে ওঠে। সেখানে নারীদেরকে বিশেষ এক প্রকার বোরখা দিয়ে তাদের পুরো শরীর এমনকি চোখ পর্যন্ত ঢেকে রাখতে হয়। কেউ যদি কোনো শিথিলতা দেখায় তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে, যেমন তাদেরকে প্রকাশ্যে বেত্রাঘাত করার ঘটনা গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া মেয়েরা মেকআপ বা প্রসাধনী ব্যবহার করলেও শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং কাউকে কাজ করতে দেখলে তাকে পেটানো হয়েছে। একাধিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, পথচলায় শাস্তির মুখে পড়ে কিছু মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। যেমন একটি ঘটনায় জানা যায়, কাবুলের উত্তরে এক নারী সঠিকভাবে হিজাব না করে রাস্তায় বের হওয়ার কারণে নৈতিক পুলিশ তাকে প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়। শাস্তির পর সেই নারী গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যু হয়।

এভাবে পৃথিবীর যতগুলো জায়গায় ‘শরিয়াহ আইন’ চালু করা হয়েছে, সব জায়গায় জনগণের মধ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতা জারি রাখার নাম করে এই নৈতিক পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হয়েছে। অথচ আল্লাহর রসুল ও খলিফাদের যুগে এ জাতীয় কোনো নৈতিক পুলিশ বাহিনীর অস্তিত্ব ছিল না। যেখানে আল্লাহর তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে ইসলামের সকল নৈতিক ও সামাজিক বিধি-নিষেধ জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হত। সমাজের সবাই যেন এই বিধি-বিধানগুলো জানতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য রসুলাল্লাহ মদিনায় ‘হিসবা’ নামে একটি সরকারি দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমাজের প্রত্যেক মানুষের উপর সৎ কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করার দায়িত্ব আল্লাহর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে (সুরা ইমরান ৩:১১০)। ‘হিসবা’ নামক প্রতিষ্ঠানটি এই দায়িত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির কাজ করত। কোনো পুলিশি নিপীড়নের দায়িত্ব তাদের ছিল না, তারা কেবল তদারকি করত। জনগণও তাদেরকে এ সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য প্রদান করতে পারত।

ইসলামে সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধাদান (তা’মুরুনা বিল মারুফ ওয়া তানাহাউনা আনিল মুনকার) জীবনব্যবস্থার একটি মৌলিক দিক, যা সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে। এর মাধ্যমেই মূলত সমাজে নৈতিকতা, সততা এবং ইসলামী মূল্যবোধের অনুসরণ নিশ্চিত হয়, ফলে আলাদা করে নৈতিক পুলিশের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু প্রত্যেক মো’মেন অন্যায়কে প্রতিহত করবে তারও তো একটা সঠিক নির্দেশনা বা রূপরেখা থাকতে হবে। বর্তমানে আমরা দেখি জনগণ মোরাল পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। দুজন তরুণী চায়ের দোকানের সামনে ধূমপান করছে, অমনি শুরু হয়ে গেল মোরাল পুলিশিং। তাদেরকে অকথ্যভাষায় গালিগালাজ আরম্ভ করা হলো, শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত অপমানিত করা হলো (বিডিনিউজ২৪.কম-২ মার্চ ২০২৫)। এই সংস্কৃতিকে বলা হচ্ছে মব জাস্টিস বা বিশৃঙ্খল ও উত্তেজিত জনতার বিচার। এই উত্তেজিত জনতা মার্চ ২০২৫ এর মাঝামাঝি সময়ে ১০/১১ বছরের একটি ছেলেকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করল যার মর্মান্তিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। সম্প্রতি এরকম পিটিয়ে মানুষ মারা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, মাজার ভাঙার শত শত ঘটনা ঘটে গেছে, প্রতিদিন ঘটে চলেছে। ৫ মার্চ ২০২৫ এর দৈনিক প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমান অন্তর্র্বতী সরকারের সাত মাসে দেশে অন্তত ১১৪টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এতে ১১৯ জন নিহত এবং ৭৪ জন আহত হয়েছেন। এভাবে গত ১০ বছরে গণপিটুনিতে মারা গেছেন কমপক্ষে ৭৯২ জন। আহত হয়েছেন ৭৬৫ জন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) এসব তথ্য জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ইজাজুল ইসলাম বলেন, “রাজনৈতিক ক্ষোভের কারণে প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে অনেকে গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। আবার চুরি, ছিনতাই, ধর্ষণ, ডাকাতি বৃদ্ধি পাওয়ায় জনমনে ক্ষোভের কারণে অনেকে সন্দেহ করে গণপিটুনির ঘটনা ঘটাচ্ছে। গণপিটুনি একটি দণ্ডনীয় অপরাধ ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু গণপিটুনির ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির নজির তেমন নেই, তাই অনেকেই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে।” উল্লেখ না করলেই নয়, গত ছয়মাসে (মার্চ ২০২৫) পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে মোট ২২৫টি। একই সময় সারাদেশে ৮০টি মাজার ও দরবারে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। একদল আরেক দলকে ভণ্ড, বাতিল আখ্যা দিয়ে ‘তওহীদী জনতা’ নামের আড়ালে ধর্মীয় শুদ্ধতা প্রতিষ্ঠার দাবিতে হামলা চালাচ্ছে।

একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী ইসলামের মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার নাম করে এই ‘মোরাল পুলিশিং’ এর কাজ করে যাচ্ছে। তাদের দাবি হচ্ছে তারা জেহাদ করছে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে যা প্রত্যেক মো’মেনের অবশ্য কর্তব্য। কিন্তু আসলেই কি তাই? তারা যা করছে তাকে কি ইসলামের পরিভাষায় ‘অন্যায়ের প্রতিরোধ- তানাহাউনা আনিল মুনকার’ বলা যাবে? অবশ্যই নয়। এটা ইসলামের আইন নয়, এটা জঙ্গলের আইন। ইসলাম একটি সভ্যতার নাম। ইসলামের সভ্যতা অনুসারে অন্যায়ের বাধাদান কীভাবে তার রূপরেখা সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কোনো স্থানে অন্যায় সংঘটিত হতে দেখলে মো’মেনদের করণীয় হবে অন্যায়কারীকে অন্যায় থেকে বিরত হওয়ার জন্য আদেশ করা। আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করেছেন ‘আমর’ যার অর্থ আদেশ। যদি সে অন্যায় থেকে বিরত না হয় তাহলে তাকে আটক করার অধিকারও জনগণের রয়েছে। কিন্তু আটক করে মারধোর করা, আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাকে শাস্তি দেওয়ার কোনো অধিকার জনগণের নেই, মো’মেনদেরও নেই। এমনকি তার অপরাধ সম্পর্কে প্রচার করারও কোনো অধিকার তাদের নেই। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে ঘটনাটি কর্তৃপক্ষের গোচরে আনা বা আটক ব্যক্তিকে কর্তৃপক্ষের সম্মুখে হাজির করা। লোকটিকে তার অপরাধের দণ্ড দেওয়ার কাজ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের। এ বিষয়ে আল্লাহ পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, “যখন তাদের কাছে কোনো শান্তি-সংক্রান্ত বা ভীতিকর সংবাদ পৌঁছে, তখন তারা সেগুলোকে রটিয়ে দেয়। বরং তারা যদি সেগুলো পৌঁছে দিত রসুল পর্যন্ত কিংবা তাদের শাসকদের কাছে, তখন সেগুলো সম্পর্কে তদন্ত ও অনুসন্ধান করে দেখা যেত।” (সুরা নিসা ৪:৮৩)।

উত্তেজিত জনতার বিচার কখনও সঠিক হতে পারে না। উত্তেজিত অবস্থায় বিচার করাই ইসলামে নিষিদ্ধ (সুনান আত-তিরমিজি: ১৩৩১)। ন্যায়বিচার একমাত্র সম্ভব আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুসারে বিচার করা হলে। জনগণ যখন নিজের হাতে বিচারের ভার তুলে নেয় তখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অন্যায়ের তুলনায় বহুগুণ কঠোর শাস্তি দিয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় নিয়ে অত্যাচার নির্যাতন করে নৃশংসভাবে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে, অনেক সময় তাদের চোখ তুলে নেয়, জিহ্বা কেটে দেয়, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়। এতে করে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের বা সংশোধনের কোনো সুযোগ থাকে না। অনেক সময় নির্দোষ মানুষও সন্দেহ ও গুজবের শিকার হয়ে এমন ভয়ংকর পরিস্থিতির কবলে পড়ে। এমন ঘটনা বাংলাদেশে অনেকবার ঘটেছে। ছেলেধরা সন্দেহে, ডাকাত সন্দেহে বহু নির্দোষ মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এমনকি মানসিক ভারসাম্যহীন লোকেরাও মব জাস্টিসের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বিনা বিচারে একজন মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। বিচার প্রক্রিয়ার ত্রুটির কারণে অনেক সময় ভুলবশত নির্দোষ মানুষের মৃত্যুদণ্ড হয়ে যায়। পরবর্তীতে যখন প্রমাণিত হয় যে, সেটি মিথ্যা মামলা ছিল, তখন আর কিছু করার থাকে না। এমন ঘটনা ঘটার কারণে অনেক দেশেই এখন মৃত্যুদণ্ডের আইন রহিত করা হয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সব দেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এবং লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশসহ প্রায় ১৪০টিরও বেশি দেশ পুরোপুরি বা আংশিকভাবে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে। সেখানে যেখানে সেখানে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার মত বর্বরতা কোনো সভ্য সমাজে চলতে পারে না। সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, ধর্মের নামেই এই অধর্মের চর্চা হয় সবচেয়ে বেশি। তাই এতে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় ধর্মের। ধর্মবিদ্বেষী গোষ্ঠী খোদ ধর্মকেই সকল অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, যুক্তিহীনতা, কূপমণ্ডূকতা ও নিষ্ঠুরতার কারণ বলে প্রচার করার সুযোগ পায়, আল্লাহ-রসুলকে গালি দেওয়ার সুযোগ পায়। এতে ইসলামের তো কোনো লাভ হয়ই না, বরং মানুষ ইসলাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

অপরাধীকে বিনা বিচারে ঘটনাস্থলে পিটিয়ে মেরে ফেলার মত ঘটনা আল্লাহর রসুলের সময় একটিও ঘটতে দেখা যায়নি। ইসলামে মদ্যপান নিষিদ্ধ এবং প্রকাশ্যে মদ্যপানের জন্য শাস্তির বিধানও রয়েছে। জানা যায়, রসুলাল্লাহ (সা.) মদ্যপানের কারণে ৪০টি বেত্রাঘাত করতেন। আবু বকর (রা.)-ও একইভাবে ৪০টি বেত্রাঘাত করতেন। কিন্তু উমর (রা.) যখন খলিফা হলেন, তখন তিনি জনগণের মধ্যে মদ্যপানের বৃদ্ধি লক্ষ্য করে ৮০ বেত্রাঘাত নির্ধারণ করেন।” (আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে সহিহ মুসলিম: ১৭০৬, সহিহ বুখারি: ৬৭৭৯)। একদিন একজন লোক মদ খেয়ে মাতাল হয়ে রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল। লোকজন তাকে ধরে মহানবীর (দ.) দরবারে নিয়ে যাবার জন্য রওয়ানা হল। পথে ইবনে আব্বাসের (রা.) বাড়ি পড়ে। লোকজন ইবনে আব্বাসের বাড়ির কাছে আসতেই লোকটি হঠাৎ সবার হাত ছাড়িয়ে দৌঁড়ে ইবনে আব্বাসের (রা.) বাড়িতে ঢুকে ত^াকে জড়িয়ে ধরল। লোকজন তাকে তার কাছে থেকে ছাড়াতে না পেরে আল্লাহর রসুলের (দ.) কাছে যেয়ে ঘটনা বলল। রসুলাল্লাহ (দ.) ঘটনা শুনে হেসে ফেললেন এবং বললেন “সে তাই করেছে নাকি?” বিশ্বনবী (দ.) কোনো শাস্তির কথা বললেন না। বোঝা গেল যে তিনি অপরাধীর প্রতি কতটা সহানুভূতিশীল ছিলেন। আবার দেখুন মাতাল লোকটিকে রাস্তায় গড়াগড়ি করতে দেখে লোকজন কিন্তু তাকে মারধোর করেনি। তারা তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিল রসুল অর্থাৎ শাসকের কাছে। পথিমধ্যে লোকটি যখন ইবনে আব্বাসের (রা.) কাছে আশ্রয় নিল, তখনও লোকগুলো চাইলে জোর করে ইবনে আব্বাসের কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিতে পারত। কিন্তু সেটাও তারা করেনি। তারা রসুলকে গিয়ে ঘটনাটি অবগত করেছে। আর রসুলও আর তাকে জোর করে ধরে আনার জন্য বলেননি। এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায় জনগণ কীভাবে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিল। দীনের মাসআলা-মাসায়েল সম্পর্কে অন্যতম অভিজ্ঞ সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.) স্বয়ং সেই অপরাধী ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, কারণ কৃত অপরাধের জন্য লোকটি ক্ষমা চেয়েছিল।

বনী আসলাম গোত্রের এক ব্যক্তি নবী করীম (সা.) এর নিকট এসে ব্যভিচারের স্বীকারোক্তি করলো। রসুলাল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাকে পাগলামীতে পায়নি তো? সে জবাব দিলো, না। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি বিবাহিত? সে বললো, হ্যাঁ। তখন নবী করীম (সা.) এর নির্দেশে তাকে জানাযার স্থানে পাথর নিক্ষেপে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। যখন পাথর নিক্ষেপের ফলে দিক্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে দৌড়ে পালাতে লাগলো, তখন তাকে ধরে এনে আবার পাথর নিক্ষেপ করা হলো, যতক্ষণ না সে মৃত্যুবরণ করলো। নবী করীম (সা.) ঘটনা শুনে বললেন, ‘লোকটাকে তোমরা যেতে দিলে না কেন?’ রসুলাল্লাহ তার সম্পর্কে ভালো কথা বললেন এবং তার নামাযে জানাযা পড়ালেন। আবু দাউদে অতিরিক্ত আছে, নবী করিম (সা.) বললেন ‘যার হাতে আমার প্রাণ তাঁর শপথ করে বলছি, অবশ্যই সে এখন জান্নাতের ঝরনাধারায় অবগাহন করছে।’ (বোখারি, মিশকাত, ইবনে মাজাহ-২৫৫৪ ও আবু দাউদ- ৪৪০৫ ও ৪৪০৬)।

লক্ষ করুন, লোকটিকে কেউ তার অপরাধের জন্য ধরে নিয়ে আসেনি। সে নিজে তার অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হয়ে প্রায়শ্চিত্য লাভের জন্য মৃতুদণ্ডগ্রহণ করতে এসেছে। কতটুকু আত্মিক পরিশুদ্ধি এলে একজন মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব? এটা উপলব্ধি করে আল্লাহর রসুল তাকে শাস্তি না দেওয়ার জন্য যতরকম উপায় সম্ভব অনুসন্ধান করেছেন। যখন বুঝতে পেরেছেন যে লোকটি চাওয়া অনেক উচ্চ তখন তাকে দণ্ড দিয়েছেন। সেখান থেকেও যখন লোকটি এক পর্যায়ে শাস্তি সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যাচ্ছিল তখন লোকেরা তাকে ধরে নিয়ে এসে হত্যা করে। লোকজনের এই হস্তক্ষেপ রসুল পছন্দ করেননি। তিনি চেয়েছিলেন লোকটা যখন চলে যেতে চেয়েছে সে চলে যাক। সুতরাং জনগণের দ্বারা মোরাল পুলিশিং ইসলামে নেই। তওহীদভিত্তিক রাষ্ট্রে মো’মেনও একজন ব্যক্তি, সে কর্তৃপক্ষ নয়। তবে মো’মেনদের যে জাতি অর্থাৎ উম্মাহ, তার একটি কর্তৃপক্ষ আছে। উম্মাহর একটি সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো, বিচারব্যবস্থা, শাসনব্যবস্থা ইত্যাদি থাকবে। মো’মেনের কাজ কেবল কর্তৃপক্ষকে জানানো, সম্ভব হলে অপরাধীকে ধরে কর্তৃপক্ষের মুখোমুখী দাঁড় করানো।
মোট কথা হচ্ছে, শরিয়াহ আইন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে যে ভীতি রয়েছে সেটা প্রকৃত ইসলামের যুগে ছিল না। বিগত ১৪০০ বছরে ইসলাম বহুভাবে বিকৃত হয়ে বর্তমানে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে গেছে। বহুভাবে ইসলামের ব্যাখ্যা করা হচ্ছে, কোনো ব্যাখ্যা কট্টরপন্থী, কোনো ব্যাখ্যা উদারপন্থী। শরিয়াহ আইন যারা প্রতিষ্ঠা করেছে তারা সেসব জায়গায় জবরদস্তিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে যা ইসলামের মূলনীতির সম্পূর্ণ বিপরীত (সুরা বাকারা ২:২৫৬)। প্রকৃত ইসলামকে মানুষ আলিঙ্গন করে নেয়, আর কট্টরপন্থী মোল্লাতান্ত্রিক ইসলামকে মানুষের উপর জোর করে চাপিয়ে দিতে হয়। কারণ তা অপ্রাকৃতিক ও কঠিন, তাতে দীনের প্রতিটি ক্ষেত্র নিয়ে বাড়াবাড়ি করে মানুষের জন্য ভয়ানক বানিয়ে ফেলা হয়েছে। তাই তাদের চর্চিত শরিয়াহ আইন, মোরাল পুলিশিং ও বর্তমানে চলমান মব সংস্কৃতি দেখে ইসলাম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করা হবে অমূলক, কারণ প্রকৃত ইসলাম এমন নয়। রসুল ও তাঁর উম্মাহর প্রতিষ্ঠিত ইসলামের সোনালি সভ্যতাই তার ঐতিহাসিক প্রমাণ। [লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট; যোগাযোগ: ০১৭১১০০৫০২৫, ০১৭১১৫৭১৫৮১, ০১৭১১২৩০৯৭৫]

সার্চ করুন

যুক্ত হোন আমাদের ফেসবুক পেজের সাথে...