এম আমিনুল ইসলাম
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আদম তথা আমাদেরকে সৃষ্টি করে তাঁর নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিলেন। যে কারণে আল্লাহর সমস্ত মহৎ গুণাবলী আমাদের ভিতরে চলে এসেছে যদিও খুবই সামান্য পরিমাণে। আল্লাহর অন্যতম একটি সিফতী নাম ওহাব অর্থাৎ মহা-দাতা। এই মহাসৃষ্টির প্রত্যেকটি অণু পরমাণু আল্লাহর দানেরই ফসল। যে কারণে স্বভাবগতভাবে মানুষ দানশীল হওয়া বাঞ্ছনীয়। তাছাড়াও দানের উদ্দেশ্য আকিদা ও গুরুত্বের বর্ণনার পাশাপাশি দান করার জন্য আল্লাহ সরাসরি হুকুম দিয়েছেন (সুরা নাহল- ৯০), যার মাধ্যমে দান করা মুমিনের জন্য ফরদ হয়ে যায়। রসুলাল্লাহ দানের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করছেন যে, “আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, আমি তোমাকে দান করব [আবু হুরায়রাহ (রা:) থেকে বোখারী ও মুসলিম]।” হাদীসে আরও উল্লিখিত যে, হাশরের মাঠে দান মুমিনের জন্য ছায়াস্বরূপ হবে। এ ছাড়া দান আল্লাহর দেওয়া জীবন ব্যবস্থার অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
দানের সংজ্ঞা: দান মানেই মানুষের কল্যাণার্থে কোনো কিছু বিনাশর্তে প্রদান করা, যা কখনোই ফেরত যোগ্য নয়। যদিও আল্লাহ তাঁর নিজ অনুগ্রহে বান্দার এই দানকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেন। শুধু নগদ অর্থ নয়, নিজের অধিকারভ্ক্তূ যেকোন কিছুই দানের বিষয়-বস্তু হতে পারে। রসুলাল্লাহর হাদিস মোতাবেক নিজের পোষ্যদের জন্য ব্যয় করা, আত্মীয়তা রক্ষার জন্য ব্যয় করা, মানুষকে বিপদে আশ্রয় দেওয়া, কারো জন্য দোয়া করা, কোনো ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাদ্য দেওয়া, পথ-সন্ধানীকে পথ দেখিয়ে দেওয়া, পতিত জমিতে আবাদ করা, কোনো মুমিন ভাইয়ের প্রতি হাস্যমুখ করা, কাউকে সৎ কাজের উপদেশ দেওয়া, অসৎ কাজ হতে নিষেধ করাও দান, পথের থেকে কাঁটা সরিয়ে দেওয়াও একটি দান। এককথায় বলতে গেলে, প্রত্যেক পুণ্য কাজই মুমিনের জন্য এক একটি দান যদি সেই কাজে আল্লাহর কোনো সৃষ্টি উপকৃত হয়।
দানের প্রতিদান: মানব জাতি তথা আল্লাহর সৃষ্টির কল্যাণ সাধনে প্রত্যেকটি কাজেরই আল্লাহ প্রতিদান দিয়ে থাকেন, এটা দুনিয়াতেও আখেরাতেও। দান যেহেতু আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা এবং জারি রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে সেহেতু দানের প্রতিদান আল্লাহ দিবেন এটা সহজ কথা। আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামে দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন এবং দানকারীকে দানের চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিমাণে প্রতিদান দেওয়ার ওয়াদা দিয়েছেন (সুরা বাকারা- ২৪৫, হাদীদ- ১১)। তাছাড়া দানকারী পুরুষ ও নারীদেরকে বহুগণ বেশি ছাড়াও সম্মানজনক পুরস্কার প্রদান ও ক্ষমার আশ্বাস দিয়েছেন (সুরা হাদীদ ১৮, তাগাবুন- ১৭)। পক্ষান্তরে দানের বিপরীতে যারা নিজে কৃপণতা করে এবং অন্যকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় তাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, আল্লাহ অভাবমুক্ত (সুরা হাদীদ- ২৪), আল্লাহ তাদের জন্য লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত রেখেছেন (সুরা নেসা- ৩৭), আর লোক দেখানো দানকারীকে আল্লাহ ভালোবাসেন না এবং শয়তানের সঙ্গী হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা নেসা- ৩৮)। পাশাপাশি এটাও জানিয়েছেন যে, যারা আল্লাহর পথে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে, দানের কথা বলে বেড়ায় না এবং দান গ্রহণকারীকে খোটাও দেয় না তাদের পুরস্কারতো আছেই, তাদের কোনো ভয় নাই এবং তারা দুঃখিতও হবে না (সুরা বাকারা- ২৬২, ২৭৪)। যারা দানের কথা বলে বেড়ায় এবং দানগ্রহণকারীকে কষ্ট দেয় তাদের দানকে আল্লাহ নিষ্ফল করে দেন এবং লোক দেখানো দান বলে অখ্যায়িত করেছেন এমনকি আল্লাহ তাদেরকে মুমিন হিসাবেও স্বীকৃতি দেন নি। আর তাদের উপমা দিয়েছেন একটি মসৃণ পাথরের সাথে যার উপর কিছু মাটি থাকে; অতপর প্রবল বৃষ্টিপাতে উক্ত পাথরকে পরিষ্কার করে ফেলে, ফলে দানের কারণে তারা যা কিছু অর্জন করেছিল তা নিষ্ফল হয়ে যায় (সুরা বাকারা- ২৬৪)।
দানের উপকারিতা: দানের কারণে দৃশ্যমানভাবে সমাজের অস্বচ্ছল দরিদ্রশ্রেণি যেমন উপকৃত হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে তেমনি অদৃশ্য অনেক উপকারিতাও আছে যা মুমিন মাত্রই বুঝতে সক্ষম। যেমন দানের কারণে আল্লাহ পাপ মোচন করেন (সুরা বাকারা- ২৭১), আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ হয়, দানকারীর আত্মা বলিষ্ঠ হয় (সুরা বাকারা- ২৬৫)। দানকারীদেরকে আল্লাহ মোত্তাকী এবং তাদের এই কাজকে সৎকর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন (সুরা এমরান- ১৩৩, ১৩৪)। দানকে আল্লাহর সান্নিধ্য ও রসুলের দোয়া লাভের উপায় হিসাবেও সাব্যস্ত করেছেন (সুরা তওবা- ৯৯)। আত্মশুদ্ধির জন্য দানকারীদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে দূরে রাখার ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের ঘোষণা দিয়েছেন (সুরা লাইল- ১৭-২১)। দানের উপকারিতা প্রসঙ্গে হুজুর (সা.) বলছেন, “দাতা ব্যক্তি আল্লাহর কাছে, জান্নাতের কাছে, মানুষেরও কাছে অথচ জাহান্নাম হতে দূরে এবং কৃপণ ব্যক্তি আল্লাহ হতে দূরে, জান্নাত হতেও দূরে, মানুষ হতেও দূরে অথচ জাহান্নামের অতি কাছে। নিশ্চয় মূর্খ দাতা কৃপণ সাধক অপেক্ষা আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় (আবু হুরায়রাহ থেকে তিরমিযি)। দান আল্লাহ পাকের রোষ প্রশমিত করে এবং মন্দ মৃত্যু রোধ করে (আনাস রা. থেকে তিরমিযী)।”
উৎকৃষ্ট বস্তু দান করা: মহান আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে মানুষকে অকৃতজ্ঞ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ, মানুষের প্রতি আল্লাহ যে অফুরন্ত রহমত, বরকত, দয়া, করুণা বর্ষিত হয় সে মোতাবেক সে অল্পই আল্লাহকে স্মরণ করে। মানুষের অধিকারে থাকা প্রত্যেকটি সম্পদই আল্লাহর দান কিন্তু যখনই আল্লাহর পথে ব্যয় করার ডাক আসে তখন মানুষ তার সম্পদের নিকৃষ্টতম বস্তুটিই দান করতে এগিয়ে আসে। সে জন্য আল্লাহ উৎকৃষ্ট বস্তুই দান করতে এবং নিকৃষ্ট বস্তু দান করার সংকল্প করা থেকেও দূরে থাকতে (সুরা বাকারা- ২৬৭) এবং নিজেদের প্রিয় জিনিস দান করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন (সুরা আলে এমরান- ৯২)। যে জিনিস নিজে গ্রহণ করবে না, বা ইতস্তত করবে সেটা দান করা থেকে বিরত থাকাই বাঞ্ছনীয়। রসুলাল্লাহও এক মুমিনের প্রতি আরেক মুমিনের অধিকার বর্ণনা করতে যেয়ে নিজের জন্য যা পছন্দ করবে অপরের জন্যও তা-ই পছন্দ করার তাগিদ দিয়েছেন।
দান করার নীতি: মহান আল্লাহ আমাদেরকে ভারসাম্যপূর্ণ জাতি হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সৃষ্টির প্রত্যেকটি বিষয়বস্তুই ভারসাম্যপূর্ণ, প্রাকৃতিক। এই ভারসাম্য একদিকে নষ্ট হলে অপরদিকেও আঘাত করবে এবং আল্লাহর সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটাবে। এ কারণে আল্লাহ দান করার ক্ষেত্রেও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলেছেন, “তুমি তোমার হস্ত তোমার গ্রীবায় আবদ্ধ করে রেখো না এবং তা সম্পূর্ণ প্রসারিতও করো না। তাহলে তুমি তিরষ্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে পড়বে (সুরা বনী ইসরাইল- ২৯)।” আবার একেবারে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব করেও দান করতে রসুল নিষেধ করছেন, “দান করতে থাকবে এবং হিসাব করবে না যাতে আল্লাহ তোমাকে দান করতে হিসাব না করেন। ধরে রাখবে না যাতে আল্লাহ তোমার ব্যাপারে ধরে না রাখেন। তোমার সামর্থ্য অনুসারে সামান্য হলেও দান করবে (আসমা বিনতে আবু বকর থেকে বোখারী ও মুসলিম)।” আবার নগণ্য উসিলায় যেন দান করা থেকে বিরত না থাকে সেজন্য রসুলাল্লাহ বলছেন, “হে নারী সমাজ! তোমরা দান কর যদি তোমাদের গহনা হতেও হয় (যয়নব রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”
সম্পদ জমা করার প্রতিফল: ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। অর্থনীতি হলো জীবনব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ। ইসলামী অর্থনীতির মূল কথা হলো সম্পদ জমা করা নয়, খরচ করা, ব্যয় করা। কারণ, একটা সম্পদ যত বেশি লোকের হাতে যাবে ঐ সম্পদ দিয়ে ততবেশি লোক উপকৃত হবে। একারণে, ব্যয় না করে যারা জমা করে তাদের জন্য আল্লাহর কঠোর সতর্কবাণী যে, “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও। যেদিন জাহান্নামের অগ্নিতে তা উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাহাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেওয়া হবে, সেদিন বলা হবে, এটাই হচ্ছে তা যা তোমরা নিজেদের জন্য পুঞ্জিভূত করতে। সুতরাং তোমরা যা পুঞ্জীভূত করেছিলে তা এবার আস্বাদন কর (সুরা তাওবা- ৩৪, ৩৫)। দুর্ভোগ প্রত্যেকের, যে পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে, যে অর্থ জমায় ও তা বার বার গণনা করে, সে ধারণা করে যে, তাহার অর্থ তাহাকে অমর করে রাখিবে, কখনও না, সে অবশ্যই নিক্ষিপ্ত হবে হুতামায় (সুরা হুমাযা- ১-৪)।”
যারা কৃপণতা করে তাদের পরিণাম: আল্লাহ মানুষকে তাঁর রঙে রঙিন হতে বলেছেন তার মানে তাকে দয়া, মায়া, মমত্ববোধ, উদারতা, মহানুভবতা, দানশীলতা ইত্যাদি আল্লাহর গুণাবলীতে নিজেকে গুণান্বিত করতে হবে। তেমনি কৃপণতা, দারিদ্র্যের ভয়, হতাশা এগুলো হলো এবলিসের গুণ। যে কারণেই হোক, যারা কৃপণতা করবে তারা এবলিসের অনুসারী, তারা আল্লাহর লানতের পাত্র হবে। তাদের প্রতি আল্লাহ হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন যে, “তোমরাই তো তারা যাদেরকে আল্লাহর পথে ব্যয় করতে বলা হয়েছে অথচ তোমাদের অনেকে কৃপণতা কোরছ। যারা কার্পণ্য করে তারা তো কার্পণ্য করে নিজেদের প্রতি। আল্লাহ অভাবমুক্ত এবং তোমরাই অভাবগ্রস্ত। যদি তোমরা বিমুখ হও, তিনি অন্য জাতিকে তোমাদের স্থলবর্তী করবেন, তারা তোমাদের মতো হবে না (সুরা মুহাম্মদ- ৩৮)।” কৃপণতাকে ধিক্কার দিয়ে রসুলাল্লাহ বলেছেন, “তোমরা কৃপণতা হতে বেঁচে থাকবে, কেননা, কৃপণতা ধ্বংস করেছে তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে। কৃপণতা তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে রক্তপাতের প্রতি এবং হারামকে হালাল করার প্রতি, তারা দুনিয়া ও আখেরাত উভয়লোকে ধ্বংস হয়েছে (যাবের ইবনে আবদুল্লাহ থেকে মুসলিম)।”
সব দান সমান নয়: কারও দুঃসময়ে দান আর সুসময়ে দান এক নয়। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আল্লাহর পথে কেন ব্যয় করবে না? আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর মালিকানাতো আল্লাহরই। তোমাদের মধ্যে যারা মক্কা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে তারা এবং পরবর্তীরা সমান নয়। তারা মর্যাদায় তাদের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ যারা পরবর্তীকালে ব্যয় করেছে ও যুদ্ধ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়ের কল্যাণের প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন (সুরা হাদীদ- ১০)।”
দানকারীর প্রতিদান ও কৃপণের সর্বনাশ: রসুলাল্লাহ বলেছেন, “যখনই আল্লাহর বান্দাগণ ভোরে জাগ্রত হয় তখন আকাশ হতে দুজন মালায়েক অবতীর্ণ হন। তাদের একজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি দাতাকে প্রতিদান দাও এবং অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! তুমি কৃপণকে সর্বনাশ দাও (আবু হুরায়রাহ (রা:) থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”
কৃপণতা মুমিনের স্বভাব নয়: মর্যাদাবান প্রত্যেকটি বিষয়ের সাথে আল্লাহ এবং তাঁর রসুল যেমন সম্পর্কিত তেমনি আল্লাহর মুমিন বান্দাও সম্পর্কিত। কৃপণতা আল্লাহর স্বভাব নয়, রসুলের স্বভাব নয় তেমনি আল্লাহ ও রসুলের অনুগত কোনো মুমিনেরও স্বভাব নয়। তাই রসুলাল্লাহ বলছেন, “এ দু’টি স্বভাব মুমিনের মধ্যে একত্রিত হতে পারে না, কৃপণতা ও দুর্ব্যবহার (আবু সাইদ খুদরী থেকে তিরমিযি)। আমি কি তোমাদের বলব না সর্বপেক্ষা মন্দস্তরের ব্যক্তি কে? সে ব্যক্তি যার কাছে আল্লাহর নামে কিছু চাওয়া হয় আর সে তাঁর নামে কিছু দেয় না (ইবনে আব্বাস রা. থেকে আহমদ)।”
দান কাকে করবে: দানের মধ্যে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যয়কৃত দানকেই আল্লাহ ও তাঁর রসুল সর্বত্তোম দান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন এবং এই দানকে আল্লাহ করযে হাসানা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই দানকারীকেই আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি করা, পাপ মোচন করা, আল্লাহর সান্নিধ্য ও সন্তুষ্টি অর্জন করা, আল্লাহর ক্ষমা ও মহাপুরস্কার প্রদানের ওয়াদা দিয়েছেন। কারণ, এই দানের কারণে আল্লাহ এবলিসের চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হন, আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, আল্লাহর মহা-পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়, সর্বোপরি আল্লাহর অতি আদরের সৃষ্টি মানুষ সুখে শান্তিতে নিরাপত্তায় বসবাস করতে পারে। একারণে আল্লাহ দান পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, যিনি আল্লাহর পথে সংগ্রামে সার্বক্ষণিক নিয়োজিত, আয় রোজগার করার সুযোগ নেই এবং মানুষের কাছে ভিক্ষাও করে না, আল্লাহর ভাষায়, “ইহা প্রাপ্য অভাবগ্রস্ত লোকদের; যারা আল্লাহর পথে এমনভাবে ব্যাপৃত যে, দেশময় ঘোরাফেরা করতে পারে না। যাঞ্চা না করার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদেরকে অভাবমুক্ত বলিয়া মনে করে। তুমি তাহাদের লক্ষণ দেখিয়া চিনিতে পারিবে। তারা মানুষের নিকট নাছোড় হয়ে যাঞ্চা করে না (সুরা বাকারা- ২৭৩)।”
রসুলাল্লাহ এবং তাঁর আসহাবদের উল্লেখযোগ্য দান: মানব জাতির দুনিয়াতে শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য আল্লাহ যে বিধান দিয়েছেন রসুলাল্লাহ সেটিই তাঁর নিজের ও আসহাবদের সামগ্রিক জীবনে প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে, ইসলাম এটা, ইসলামের এই কাজ এভাবে করতে হয়। রসুলাল্লাহ একজন উৎকৃষ্ট দানশীল ছিলেন এ কথাটা অন্যভাবে বললে বলতে হয়, রসুলাল্লাহর মাধ্যমে তাঁর জাতি দানশীলতা দেখতে পেয়েছে এবং এই বিরল গুণটা অর্জন করতে পেরেছে। যিনি নিজের অর্জিত সহায় সম্পত্তি, তাঁর প্রথম স্ত্রী উম্মুল মুমিনিন খাদিজা (রা:) এর সম্পত্তি, নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য, ইজ্জত, সম্মান, গুরুত্বপূর্ণ সময়, অক্লান্ত পরিশ্রম, অপরিসীম মেধা, আল্লাহর থেকে দেয়া যুদ্ধলব্ধ সম্পদ, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে পবিত্র দেহের রক্ত ঝরানোসহ সকলকিছু দান করে গেছেন মানবতার কল্যাণের জন্য, মুক্তির জন্য, শান্তির জন্য। তাঁর পৃথিবী থেকে চলে যাবার সময়ে নয়টি তরবারিসহ কয়েকটি যুদ্ধের উপকরণ ছাড়া পার্থিব কোনো সম্পদ তিনি রেখে যান নি। দানের ক্ষেত্রে এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যারা আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ রসুলের সাহাবী হয়েছেন তাদের চরিত্রেও একই ধারা প্রবাহিত হয়েছে বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। যেমন, রসুলের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিযান হয়েছে তাবুক অভিযান। এই অভিযানে রসুলাল্লাহ তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর রাস্তায় পূর্ণভাবে জান মাল দিয়ে অংশগ্রহণ করার প্রস্তাব দিলেন। সাহাবীদের সকলেই যথাসাধ্য রসুলাল্লাহর প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছেন কিন্তু আবু বকর (রা:) রসুলাল্লাহর এই প্রস্তাবে সাড়া দিলেন ভিন্ন আঙ্গিকে যা পরবর্তীদের জন্য একটি কালজয়ী উদাহরণ হয়ে থাকলো। তিনি ঘরে ব্যবহার্য পার্থিব যে সম্পদ ছিল (কয়েকটি হাড়ি পাতিল, থালা-বাসন ইত্যাদি) সবগুলো নিয়ে রসুলাল্লাহর দরবারে হাজির হলেন এবং বললেন যে, ঘরে আল্লাহ এবং তাঁর রসুলকে রেখে এসেছেন। যার আর্থিক মূল্যমান ছিল নগণ্য কিন্তু আত্মিক মূল্যমান ছিল বিশাল। এই দানের প্রকৃত মূল্য বুঝতে পেরেছিলেন রসুলাল্লাহ। যে কারণে অন্যান্য সাহাবীরা অনেক বেশি সম্পদ দিলেও দানে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আবু বকর (রা:)। অথচ আমাদের সমাজে যারা রসুলের উত্তরসূরী (ওরাসাতুল আম্বিয়া) দাবী করেন, তাদের স্থাবর অস্থাবর অন্যান্য সম্পদের হিসাব যাই হউক না কেন শুধু শরীরে জড়িয়ে থাকা জামা কাপড়ের দামই কয়েক হাজার টাকা, তবুও তারা দান গ্রহণ করেন।
দান ব্যবসা-ধর্মব্যসার একটি শাখা: এখন যদি কোনো মানুষকে দানের মহিমা বোঝানো হয় তাহলে প্রথমেই সে চিন্তা করবে কোথায় দান করা যায়। এর জন্য তার সামনে যে বিকল্পগুলি দেখবে সেগুলি হচ্ছে, মসজিদ, এতিমখানা, মাদ্রাসায় ইত্যাদি। বর্তমানে ইসলাম ধর্মের পুরোহিতরা এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে দানের খাত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। কিন্তু এগুলি আসলে তাদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এখানে দান করলে আল্লাহর দরবারে যায় না, যায় ধর্মজীবীদের পেটে। কিন্তু ইসলাম কোনো ব্যবসায়িক পণ্য নয়, কোর’আন হাদীসের কোনো একটা শব্দের বিনিময়েও দুনিয়াবী কোনো স্বার্থ হাসিল করা নিষিদ্ধ, হারাম। যারা এই গর্হিত কাজ করবে তাদের জন্য আল্লাহ কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন (সুরা বাকারা- ১৭৪, ১৭৫সহ বহু আয়াত ও হাদিস)। মসজিদ নির্মাণের জন্য এক মুষ্টি বালুর টাকা, একটি ইটের টাকা দিয়ে আখেরাতে জান্নাত লাভের প্রতিশ্রুতি দিতে দেখা যায় রাস্তার মোড়ে মোড়ে। এই অর্থ যুগ যুগ ধরে তোলা হয়, মসজিদ আর হয় না। একইভাবে এতিমখানা, হেফজখানার নামেও চলে ভিক্ষাবৃত্তি। রমজান মাস বা কোরবানীর ঈদ যেন ধর্মব্যবসায়ীদেরই মৌসুম। ভিক্ষা করা হারাম, এক ভিক্ষুককে রসুলাল্লাহ কম্বল বিক্রি করিয়ে কুঠার কিনে কাঠ কাঠতে পাঠিয়েছেন, এই ঘটনা তারাই বর্ণনা করেও ধর্মজীবীরা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেন। আজকের সমাজে যারা হাজারো অপকর্ম করে, সুদের কারবার করে সমাজে প্রভাবশালী হন তারাই এই ধর্মব্যবসায়ীদের পোষক। কিন্তু এদের অপকর্মের ব্যাপারে কিন্তু ধর্মব্যবসায়ীরা নিশ্চুপ বরং পার্থিব সুবিধার (যেমন দাওয়াত খাওয়া) আশায় তাদের জন্য এরা দোয়াও করে। এই সকল ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি কথা যে, আপনারা নিজের হাতকে উপরে স্থাপন করুন, রসুলাল্লাহর আসহাবদের মতো শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুন। কেননা, একদিন রসুলাল্লাহ বলেন, “উপরের হাত নীচের হাত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ (ইবনে ওমর রা. থেকে বোখারী ও মুসলিম)।”