রিয়াদুল হাসান:
ইসলামের নীতিমালাগুলো পবিত্র কোর’আনে সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহ বর্ণনা করেছেন। নীতি বা নির্দেশ যদি অস্পষ্ট হয় সেই নীতি অনুসরণ ও নির্দেশ পালনের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এজন্য তিনি এই সুস্পষ্টতার উপর অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আর পবিত্র কোর’আনের এই বৈশিষ্ট্যের কারণে এই মহাগ্রন্থকে তিনি কোর’আনুম মুবিন বা সুস্পষ্ট কোর’আন বলে আখ্যায়িত করেছেন (সুরা ইয়াসীন ৬৯)।
তবে কোর’আনের মধ্যে কিছু আয়াত আছে অস্পষ্ট যেগুলোকে আল্লাহ মোতাশাবিহ আয়াত বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলোর গূঢ় অর্থ ও তাৎপর্য আল্লাহই ভালো জানেন এবং যদি তিনি কোনো সময় কাউকে বোঝার তওফিক দেন তিনি জানবেন। এই আয়াতগুলোতে কোনো আদেশ নিষেধ বা নির্দেশনা থাকে না। যেমন আলিফ-লাম-মিম। এর অর্থ কতজনে যে কতরকম করতে পারে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এমন কি লালনভক্তদের অনেকের মতে এর অর্থ আল্লাহ-লালন-মোহাম্মদ। এখন আপনি কী বলবেন?
আল্লাহ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন, তোমরা এই মুতাশাবিহ বা দুর্বোধ্য আয়াতগুলোর পেছনে পড়ে থেকো না। এগুলো নিয়ে তারাই পড়ে থাকে যাদের অন্তরে কূটিলতা আছে। তারা এগুলোর নিজস্ব ব্যাখ্যা জাহির করে ফেতনা বা অশান্তি বাঁধাতে চায়। আল্লাহ বলেই দিয়েছেন, কোর’আনের কিছু আয়াত আছে সুস্পষ্ট, সেগুলোই কিতাবের আসল অংশ (সুরা ইমরান ৭)। এই সুস্পষ্ট আয়াতগুলোকে বলা হয় মুহকাম অর্থাৎ এই আয়াতে হুকুম-বিধানগুলো রয়েছে। হুকুম তো স্পষ্ট হতেই হবে, নাহলে অনর্থ হবে।
সুরা নূর এমন একটি সুস্পষ্ট ও বিধি-বিধানের আয়াতবিশিষ্ট সুরা। তাই এর প্রথম আয়াতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন, “এটি একটি সূরা, এটি আমি অবতীর্ণ করেছি এবং এর বিধানকে অবশ্য পালনীয় করেছি, এতে আমি অবতীর্ণ করেছি সুস্পষ্ট আয়াতসমূহ যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর।” এই সুরায় তিনি নারী-পুরুষের হেজাব, শালীনতা, সীমারেখা ইত্যাদি নিয়ে সুস্পষ্ট বিধান দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের দীনের পণ্ডিতদের চিন্তাভাবনা হলো এমন যে তারা কোনো কিছুই সহজ-সরল রাখতে রাজি নন। ইসলাম অনেক কঠিন এটা তাদের প্রমাণ করতেই হবে। তাই তারা এই আয়াতগুলো থেকেও জটিল, কঠিন মাসলা-মাসায়েল আবিষ্কার করেছেন, মেয়েদেরকে আপাদমস্তক আবৃত করেছেন, প্রয়োজনে শরিয়াহ পুলিশ দিয়ে বেত মেরে হলেও তাদের ধারণা মোতাবেক মেয়েদেরকে চলতে বাধ্য করবেন।
সব আলেম কিন্তু এমন কট্টরপন্থী না। মেয়েদের শরীরের কতটুকু ঢাকতে হবে তা নিয়ে একেক মাজহাবের একেক ফতোয়া। তাহলে প্রশ্ন জাগে, আল্লাহ যে সুরার প্রথম আয়াতেই বলে দিলেন এর আয়াতগুলো সব সুস্পষ্ট- সেটার কী হবে? সুস্পষ্ট আয়াতকে দুর্বোধ্য বানালো তারা কারা? তারা অতি পণ্ডিত, তারা ইন্টেলেকচুয়াল। কোর’আন কেবল তাদের জন্যই নাজিল হয়েছে, নাকি সব মানুষের বোধগম্য কেতাব এই কোর’আন। আল্লাহ তো তেমনটাই বলেছেন।
তিনি বলেন, আল্লাহ তোমাদের দীনের মধ্যে কোনোরূপ সংকীর্ণতা রাখেন নি (সুরা হজ্ব ৭৮)। অথচ বর্তমানে ইসলামকে এতটাই সংকীর্ণ বানিয়ে ফেলা হয়েছে যে, ইসলাম মেনে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাই অসম্ভব। মেয়ে মানুষের চেহারা দূরে থাক একটা চুলও বের হওয়া যাবে না, বের হলে সাপ হয়ে কামড়াবে। গান গাওয়া যাবে না, ওটা শয়তানের কাজ। বাজনা হলো শয়তানের সুর। খেলাধুলা করা যাবে না- হারাম। ছবি আঁকা যাবে না, হারাম। টিভি দেখা যাবে না- হারাম। প্যান্ট নেমেছে টাখনুর নিচে- সর্বনাশ, টাখনুর নিচের অংশ চলে গেছে জাহান্নামে। এমন কি মন খুলে হাসাও যাবে না। অন্য ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা যাবে না।
তাদের যুক্তিহীনতা, অন্ধত্ব, মনগড়া ও কোর’আনের নীতিবিরোধী ফতোয়ার বিপরীত কোনো মতও প্রকাশ করা যাবে না, করলেই কাফের, নাস্তিক, মুর্তাদ, হত্যা ওয়াজিব। ধর্মের সীমানায় ঢুকলেই চারদিকে এত এত ‘না’ এসে চারিপাশে ভয় দেখাতে থাকে। তাহলে কী করে আল্লাহ বললেন, তিনি এই দীনে কোনো সংকীর্ণতা রাখেন নি? কী করে বললেন, আল্লাহ চান তোমাদের জন্য দীনকে সহজ করতে, তিনি তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না (সুরা বাকারা ১৮৫)। একদিন আল্লাহর রসুল কিছু শিশুকে খেলতে দেখে বললেন, “তোমরা খেলাধুলা করতে থাকো। কারণ, তোমাদের দীনে কঠোরতা প্রকাশ পাক সেটা আমি পছন্দ করি না”। (বোখারী শরীফ) তিনি বহুবার দীনকে কঠোর, কঠিন করার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কেউ অধিক সওয়াবের আশায় কঠিন আমলের পথে হাঁটলে রসুলাল্লাহ রেগে লাল হয়ে গেছেন।
প্রাচীনকালের চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলেছিলেন, ‘জীবন প্রকৃতপক্ষে সরল। কিন্তু এটাকে কঠিন করে তোলার ওপর জোর দিই।’ তেমনিভাবে নানা ধরনের বিধিনিষেধের কড়াকড়ির দরুন তারা ভীত হয়ে অনেক সময় মানুষ ইসলামের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে ইসলাম থেকে দূরে সরে যায়। কিন্তু তাদের ভেবে দেখা দরকার, ইসলামের নামে যেটা চলছে সেটা কি সত্যিই কোর’আন ও রসুলের সুন্নাহ থেকে উৎসারিত? নাকি এমন কোনো প্রথা বা রেওয়াজ আমরা অনুসরণ করছি, যার উৎস জানা নেই।
প্রকৃত সত্য হলো, বর্তমানে যে ইসলামটা আমাদের সমাজে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটা আল্লাহর দেওয়া সেই ইসলাম নয়। বিগত ১৪০০ বছরের কাল পরিক্রমায় বহু পণ্ডিত, মুফাসসির, মুহাদ্দিস, মুফতি, মওলানার হাত ঘুরে যে ইসলাম আমার আপনার হাতে এসে পড়েছে, সেটা আর আল্লাহ-রসুলের ইসলামের মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। এই মধ্যবর্তী ব্যক্তিগণ নিজেদেরকে ইসলামের কর্তৃপক্ষ বলে মনে করেন বলে একে নিজেদের পছন্দমত ব্যাখ্যা করেছেন। সেই ব্যাখ্যা অন্য মাজহাবের পণ্ডিতের সঙ্গে মেলেনি। তাতে কী? এটাও ইসলাম আবার ওটাও ইসলাম। শত শত রকম ইসলাম আজ আমাদের চারপাশে। একেক দেশে একেক ইসলাম। আবার একই দেশেও বহু ইসলাম। কোনোটা হানাফি, কোনেটা হাম্বলি, ওহাবি, কোনোটা আলিয়া, কোনোটা সুন্নী, কোনোটা শিয়া, কোনোটা নকশবন্দী, কোনোটা কাদেরিয়া, কোনোটা মাজারকেন্দ্রিক ইসলাম, কোনোটা মাজারভাঙার ইসলাম, কোনোটা জঙ্গি ইসলাম, কোনোটা মডারেট ইসলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। বস্তুত ওগুলোর কোনোটাই আল্লাহ-রসুলের ইসলাম নয়। ফল-ই তার প্রমাণ, মানুষকে এক জাতিতে পরিণত করতে, মানুষের যাবতীয় মানবাধিকার রক্ষা করতে, শান্তি, ন্যায়বিচার, নিরাপত্তাপূর্ণ জীবন উপহার দিতে সকলেই ব্যর্থ, যেজন্য ইসলাম পৃথিবীতে এসেছিল।
তারা এই কাজটা কীভাবে করলেন? করলেন দীনের অতি বিশ্লেষণ করে। খুঁটিনাটি নিয়ে পড়ে থাকলে আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যায়। তাদের সেটাই হয়েছে। আল্লাহ বলেছিলেন, দীন নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। (সুরা নিসা ১৭১, সুরা মায়েদা ৭৭)। কিন্তু তারা এতই বাড়াবাড়ি করলেন যে, মতভেদ করে করে তারা একজাতিকে হাজার হাজার ভাগে টুকরো টুকরো করে ফেললেন। তাদের সামনে থেকে উম্মতে মোহাম্মদী জাতির সৃষ্টির লক্ষ্যটাই হারিয়ে গেল। যার পরিণামে শত শত বছর ধরে এ জনগোষ্ঠী পরাজয়, অপমান ও লাঞ্ছনার জিন্দেগি বয়ে বেড়াচ্ছে। কোর’আনে বর্ণিত সেই সহজ সরল ইসলাম তাদের দৃষ্টি সম্মুখ থেকে হারিয়ে গেছে। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে মতভেদ করার কারণে তারা আর কোনোভাবেই একজাতি হতে পারছে না।
অথচ তারা একটি সরল বাক্য, এক আল্লাহ ছাড়া আর কোনো হুকুমদাতা বা এলাহ নেই, মোহাম্মদ সা. আল্লাহর প্রেরত রসুল, এই সরল বাক্যটির উপর সকলেই একমত হয়ে এক জাতিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারত। এই বাক্যটিই তো ইসলামের ভিত্তি, এই তওহীদের বাণী নিয়েই তো লক্ষাধিক নবী-রসুল এই পৃথিবীতে এসেছেন। তাহলে কীসে তাদেরকে এই কলেমা তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে দিচ্ছে না। দিচ্ছে না কেবল ধর্মীয় পণ্ডিতদের তৈরি করা শরিয়াহ নিয়ে মতভিন্নতা। সেই সব অবান্তর বিষয় নিয়ে মতভেদ যদি ছুঁড়ে ফেলা যায় তাহলেই সম্ভব সরল ইসলামে ফিরে আসা।