মো. আবু ফাহাদ
(পূর্ব প্রকাশের পর) আল্লাহ ও তাঁর রসুলের পক্ষ থেকে কোনোরূপ বাধ্যবাধকতা নেই যে পুরুষদেরকে আরবীয় জোব্বা পরিধান করতে হবে, মেয়েদেরকে আপাদমস্তক ঢাকা বোরকা পরিধান করতে হবে। পৃথিবীর একেক অঞ্চলের মানুষ একেক ধরনের পোশাক পরে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থা, জলবায়ু, ঐতিহাসিক পটভূমি ইত্যাদি একটি এলাকার মানুষের পোশাক নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অথচ আজকে এক শ্রেণির নায়েবী নবীর দাবিদার বা আমাদের তথাকথিত আলেমরা এই পোশাক নিয়ে বাড়াবাড়ি করে থাকেন। ইসলাম যেহেতু সমগ্র পৃথিবীর জন্য এসেছে তাই এর কোনো নির্দিষ্ট পোশাক থাকা সম্ভবও নয়। শুধু একটি মাত্র শর্ত আল্লাহ দিয়েছেন তা হলো- পোশাক যেন শালীনতা পরিপন্থী না হয়। অশালীন পোশাক পরিধান করা নিশ্চয় কোনো ধর্মমতেই অনুমোদিত নয়, কোনো সভ্য সমাজেই অশালীন পরিধানের ফলে মানুষের যে নৈতিক অবনতি হয়, এই সরল সত্যটি বুঝতে পেরে অনেকেই তাদের দেশের স্কুল কলেজে অশালীন পোশাক (যেমন মিনিস্কার্ট ইত্যাদি) পরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে।
উম্মতে মোহাম্মদী যত যুদ্ধ করেছিল সেগুলির উদ্দেশ্য ছিল অত্যাচারী অপশক্তির হাত থেকে নিরীহ নির্যাতিত মানুষকে মুক্ত করা এবং আল্লাহর বিধান জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে সমাজে ন্যায়, শান্তি ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু তারা ব্যক্তিগতভাবে একটি মানুষকেও তার ধর্ম ত্যাগ করে এই দ্বীন গ্রহণে বাধ্য করেন নি। শুধু তাই নয়, যেখানেই তারা আল্লাহর হুকুম প্রতিষ্ঠা করেছেন সেখানেই অন্য ধর্মের চার্চ, সিনাগগ, মন্দির ও প্যাগোডা রক্ষার দায়িত্ব তো নিয়েছেনই তার উপর ঐ সব ধর্মের লোকজনের যার যার ধর্ম পালনে কেউ যেন কোনো অসুবিধা পর্যন্ত না করতে পারে সে দায়িত্বও তারা নিয়েছেন। অন্যান্য ধর্মের লোকজনের নিরাপত্তার যে ইতিহাস এই জাতি সৃষ্টি করেছে তা মানব জাতির ইতিহাসে অনন্য, একক, পৃথিবীর কোনো জাতি তা করতে পারে নি। মানুষের সামষ্টিক জীবনের সুখ-শান্তি নিরাপত্তা নির্ভর করে সর্বক্ষেত্রে সঠিক আইন ও তার প্রয়োগের উপর। সুতরাং মানুষের ব্যক্তিগত ধর্ম পরিবর্তন করা ইসলামের উদ্দেশ্য নয়, ইসলামের মূল উদ্দেশ্য সামষ্টিক জীবনে ন্যায়-সুবিচার-শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এরপর ইসলামের ফল দেখে, সৌন্দর্য দেখে যারা তাদের ব্যক্তিগত ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলাম গ্রহণ করতে চায় করবে, এটা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার উপরে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এটাই আল্লাহর সত্যদীনের চিরন্তন নীতি। এর অকাট্য প্রমাণ ভারতবর্ষে প্রায় এক হাজার বছর মুসলিম শাসকরা শাসন করেছেন। যদি হিন্দুদেরকে ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা হতো, ভারতবর্ষে একটি হিন্দু পরিবারেরও থাকার কথা ছিল না। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই? ভারতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা মুসলিমের বহুগুণ বেশি। ইসলামের স্বর্ণযুগে মধ্যপ্রাচ্যসহ অর্ধ-পৃথিবী জুড়ে মুসলিম শাসিত এলাকায় ইহুদী-খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ধর্মের লক্ষ লক্ষ মানুষের বাস ছিল। যদি মুসলিমরা কাউকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য বাধ্য করতো, তবে আজকের ইসরাইলে, সিরিয়া, লেবানন, মিশরে, উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে অন্যধর্মের কোনো লোকই থাকত না।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, মানবজাতির আত্মা বহু আগেই অধঃপতিত, কলুষিত হয়ে গেছে, বলা যায় প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সততা, সত্যবাদিতা, নিষ্ঠা, ত্যাগ, সচ্চরিত্র ইত্যাদি গুণাবলী পাশ্চাত্য বস্তুবাদী জীবনব্যবস্থার প্রভাবে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সৎ মানুষ এ যুগে অচল পয়সার মতো, এন্টিক মূল্য থাকলেও ব্যবহারিক মূল্য নেই। এ হলো মানবজাতির চারিত্রিক অধঃপতনের দিক। আর বাহ্যিকভাবে যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, হানাহানি, হিংসা, রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়ে মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকির বিষয়টি বিবেচনায় আনলে মানুষ ধ্বংসের একেবারে প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই আল্লাহর প্রদত্ত সত্য জীবনব্যবস্থার সেই রূপরেখা মানুষের কাছে তুলে ধরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করছি।
যে ইসলাম আজকে ধর্মব্যবসায়ী মোল্লা পুরোহিতদের কাছে সবাই দেখছেন আমি কিন্তু সেই ইসলামের কথা বলছি না। ইসলামের সত্যরূপ তাদের কাছে নেই। তারা কেউ হানাফি, কেউ হাম্বলি, কেউ শিয়া, কেউ সুন্নী, কেউ ওহাবী, কেউ সালাফি, কেউ বাহায়ী। তারা এই বিকৃত এবং অনেকাংশে মনগড়া ইসলামগুলি শিক্ষা করেছেন ব্রিটিশ খ্রিস্টানদের প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলি থেকে। সুতরাং তাদের কাছে যে ইসলাম আছে সেটা দিয়ে অমন শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করার চিন্তাও হাস্যকর। এখানে বলা হচ্ছে আল্লাহর সত্যদীন ইসলামের কথা।
আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তায় বা তাঁর অসীম জ্ঞানের সম্বন্ধে যারা বিশ্বাসী নন তারা যুক্তি উত্থাপন করতে পারেন যে, চৌদ্দশ’ বছর আগে মানুষ সমাজের যে অবস্থা ছিল সেখানে হয়তো এই জীবনব্যবস্থা কার্যকরী হয়েছিল এবং ঐ অকল্পনীয় ফল দেখা গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে বিজ্ঞানের, প্রযুক্তির যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে জীবনে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে এখন ঐ পুরনো ব্যবস্থা আর সেরূপ ফল দেখাতে পারবে না; এখন মানুষকেই চিন্তা-ভাবনা করে তার জীবনব্যবস্থা তৈরি করে নিতে হবে এবং আমরা তা-ই নিচ্ছি। এ কথায় আমাদের জবাব হচ্ছে, অবস্থার পারিপার্শ্বিকতায় বহু বিষয় বদলে যায়। অনেক বিষয় অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। কিন্তু অনেক বিষয় আছে যা চিরন্তন, অপরিবর্তনীয়, শাশ্বত, এর কোনো পরিবর্তন হয় না। যেমন: একটি মানুষের নাকে সজোরে ঘুষি মারলে তার নাক দিয়ে রক্ত বের হবে, লক্ষ বছর আগে এই ঘুষি মারলে তখনও রক্ত বের হতো, আজও বেরোয়, লক্ষ বছর পরেও মানুষের নাকে ঘুষি মারলে রক্ত বেরোবে। এর কোনো পরিবর্তন নেই। জীবনের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুদভিত্তিক পূঁজিবাদ মনুষ্য সমাজে যে ক্ষতি করে, ধনী-দরিদ্রের যে বৈষম্য বৃদ্ধি করে তা লক্ষ বছর আগেও করতো, এখনও করছে এবং আজ থেকে লক্ষ বছর পরেও এই সুদভিত্তিক অর্থনীতি মানবজীবনে প্রয়োগ করলে একই বিষময় ফল সৃষ্টি করবে। আগুনের পোড়াবার শক্তি লক্ষ বছর আগে যা ছিল, আজও তাই আছে এবং লক্ষ বছর পরেও অপরিবর্তনীয়ভাবে তা-ই থাকবে।
এমনি বহু জিনিস আছে যা শাশ্বত অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়ম। সর্বজ্ঞানী আল্লাহ এই শেষ জীবনবিধান (দ্বীন) তেমনি সেইসব অপরিবর্তনীয় শাশ্বত সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন যা পৃথিবীর বাকী আয়ুষ্কালের মধ্যে পরিবর্তন হবে না। এই জন্য এই দ্বীনের এক নাম দ্বীনুল ফেতরাহ্ বা প্রাকৃতিক দ্বীন (সূরা রূম ৩০)। এই জীবনব্যবস্থার প্রতিটি আইন-কানুন, আদেশ-নিষেধ তিনি অতি সতর্কতার সঙ্গে ঐ সব অপরিবর্তনীয় প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যাতে মানবজাতির বাকি আয়ুষ্কালের মধ্যে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন না থাকে। স্থান, কাল ও পাত্রভেদে পরিবর্তনীয় যা কিছু ইতোপূর্বে প্রেরিত জীবনব্যবস্থাগুলোতে ছিল তার কোনোটিই এতে স্থান পায় নি, এতে শুধু অপরিবর্তনীয় শাশ্বত প্রাকৃতিক নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত বিষয়গুলোই স্থান পেয়েছে। কাজেই চৌদ্দশ’ বছর আগে এই জীবনব্যবস্থা মানুষের জীবনে প্রয়োগে যে ফল হয়েছিল, বর্তমানে প্রয়োগ করলেও সেই একই ফল হবে এবং লক্ষ বছর পরে প্রয়োগ করলেও সেই অকল্পনীয় ফলই হবে।
আখেরী নবী মোহাম্মদ (স.) এর উপর অবতীর্ণ এই সত্যদ্বীন আল্লাহর সৃষ্টিজগতের মতোই নিখুঁত ও অবিকৃত। আল্লাহর সৃষ্টি কেমন নিখুঁত, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, তিনি সপ্ত আকাশ স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন। তুমি করুণাময় আল্লাহ তা’আলার সৃষ্টিতে কোনো ত্রুটি দেখতে পাবে না। আবার দৃষ্টি ফেরাও; কোনো খুঁত দেখতে পাও কি? অতঃপর তুমি বার বার তাকিয়ে দেখ- তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও পরিশ্রান্ত হয়ে তোমার দিকে ফিরে আসবে (সূরা মুলক ৩/৪)। আল্লাহর দেওয়া সত্যদ্বীনও এমনই নিখুঁত। এখন সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব মানুষের, তারা কি এভাবেই তাদের জীবন কাটিয়ে যাবে, এমন একটি নারকীয় পরিবেশে তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে রেখে যাবে নাকি তাদেরকে একটি স্বর্গীয় জীবন উপহার দিয়ে যাবে।
আসুন, আমরা সবাই মিলে এই নারকীয় সিস্টেমটাকে পাল্টাই। আল্লাহ-রসুলের দেওয়া প্রকৃত, সত্য জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করি। অশান্তিময় জীবনকে শান্তিময় করি। এমন একটি জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম কায়েম করি যেখানে সুখ, শান্তি আর নিরাপত্তায় আনন্দময় জীবনযাপন করবে মানবজাতি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এই সুখ-শান্তি কেবল পার্থিব জীবনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তা প্রলম্বিত হবে পরকাল পর্যন্ত সেখানে তারা লাভ করবে অনন্ত জান্নাত। পুরো মানবজাতি যদি এভাবে আল্লাহর সত্যদ্বীনকে তাদের জীবনব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসাবে বরণ করে নেয়, তবে তাদের জীবন থেকেও সর্বপ্রকার অন্যায়, অপরাধ এবং অশান্তি নির্মূল হয়ে যাবে ইনশা’আল্লাহ। (সমাপ্ত)