আবু ফাহাদ
(২য় পর্বের পর) সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ফলে আজ মানুষের সাথে মানুষের, এক রাষ্ট্রের সঙ্গে আরেক রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক বৈষম্য আকাশ পাতাল। কিছু মানুষ রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে জীবনযাপন করে, ডাস্টবিনে কুকুরের সঙ্গে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করে, আবার কিছু মানুষ পাহাড় পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে অকল্পনীয় ভোগ বিলাসে জীবন অতিবাহিত করে। এদিকে অর্থনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়াব্যাপী চলছে দাঙ্গা, বিক্ষোভ, সহিংসতা। এই হচ্ছে এক নজরে বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক অবস্থার চিত্র। পক্ষান্তরে আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার ফলে আজ থেকে ১৪০০ বছর আগের আরব সমাজে এমন অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল যে, অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিটি মানুষ স্বচ্ছল হয়ে গিয়েছিল। এই স্বচ্ছলতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মানুষ যাকাত ও সদকা দেওয়ার জন্য টাকা পয়সা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো কিন্তু সেই টাকা গ্রহণ করার মতো লোক পাওয়া যেত না। শহরে নগরে লোক না পেয়ে মানুষ মরুভূমির অভ্যন্তরে যাকাত দেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াতো। এটি ইতিহাস। মানবরচিত কোনো জীবনব্যবস্থাই এর একটি ভগ্নাংশও মানবজাতিকে উপহার দিতে পারে নি। সুতরাং বর্তমান মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য যত প্রকল্পই হাতে নেওয়া হোক যতদিন সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু থাকবে ততদিন কেউ এই দারিদ্র্য এবং অর্থনীতিক অবিচার দূর করতে পারবে না।
মানুষ জন্তু-জানোয়ারের মতো কেবল দেহসর্বস্ব, ভোগসর্বস্ব প্রাণী নয়। তার ভিতরে আছে আল্লাহর রূহ, আল্লাহর আত্মা, এজন্যই মানুষ সর্বশ্রেষ্ঠ জীব। যখন আল্লাহর ইসলাম অর্ধ-পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত ছিল, সমাজের প্রতিটি মানুষ আল্লাহকে ভয় পেত। ওয়াদারক্ষা, সত্যবাদিতা, আমানতদারি, পরোপকার, মেহমানদারি, উদারতা, ত্যাগ, দানশীলতা ইত্যাদি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে মানুষের চরিত্র পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। এটা হয়েছিল আল্লাহর দেওয়া সিস্টেমের কারণে। কেননা আল্লাহর সিস্টেম কেবল মানবসমাজের বাহিরের দিকগুলি (অর্থনীতি, দ-বিধি, প্রশাসন ইত্যাদি) নিয়েই কাজ করে না, এটি মানুষের চরিত্রকেও গড়ে তোলে আল্লাহর গুণাবলীর আলোকে। ফলে প্রতিটি মানুষ হয়ে যায় সত্যের প্রতিমূর্তি। খাদ্যে ভেজাল দিতে তাদের আত্মা কাঁপতো, অন্যের সম্পদে হাত দিতে প্রভুর ভয়ে তটস্থ থাকতো।
পক্ষান্তরে মানবসৃষ্ট আল্লাহহীন জীবনব্যবস্থাগুলো মানুষের কেবল বাহ্যিক দিকগুলো নিয়ে কাজ করে। ফলে মানুষ হয়ে যায় আত্মাহীন জানোয়ার। সে পশুর মতই কেবল আহার-বিহার-সম্ভোগে লিপ্ত থাকে, আরও বেশি অর্থ উপার্জন এবং আরও বেশী ভোগ করাকেই মানবজন্মের উদ্দেশ্য, স্বার্থকতা ও পরম প্রাপ্তি বলে মনে করে। এই সিস্টেমগুলি মানুষের সকল সদগুণাবলীকে অসদগুণাবলী দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। প্রকৃতপক্ষে মানবসৃষ্ট সিস্টেমগুলিতে নৈতিকতার কোনোরূপ শিক্ষা নেই, তাই স্বভাবতই এটি মানুষকে নৈতিকতা বিবর্জিত করে ফেলে। সাধারণ মানুষের কথা বাদ দিলাম, যারা ধর্মগুরু তাদের নৈতিক অধঃপতন জাতির জন্য চূড়ান্ত অশনি সঙ্কেত। যে খ্রিস্টানরা সামরিক শক্তিবলে দুনিয়া দখল করে এখন মানবজাতিকে ‘সভ্য’ করার ঠিকাদারি গ্রহণ করেছে, সেই খ্রিস্টানদের ধর্মগুরুদের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। যে অভিযোগটি খ্রিস্টানদের উচ্চমার্গের ধর্মনেতা যথা কার্ডিনাল, বিশপদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে উত্থাপিত হয়ে থাকে তা হলো শিশুদের উপর যৌন নিপীড়ন (Child Molestation) ও সমকামিতা। যারা বিশ্বের কিছুমাত্র খবরও রাখেন তাদের কাছে এ সংবাদ অতি পরিচিত। অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলির যাজক, পুরোহিত সম্প্রদায়ও এ জাতীয় অপরাধ থেকে মুক্ত নন। তবে সবচেয়ে ঘৃণ্য অবস্থা এই মুসলিম বলে পরিচিত জনসংখ্যার আলেমদের। নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতাসীনের বিরোধী শক্তির সন্তুষ্টি বিধানের জন্য তারা মুহূর্তে মুহূর্তে ধর্মীয় সিদ্ধান্ত বা ফতোয়া পরিবর্তন করেন। ধর্মকে বিক্রি করে টাকা উপার্জন করেন, অথচ ধর্মব্যবসা সকল ধর্মেই নিষিদ্ধ। টাকার জন্য হালালকে হারাম- হারামকে হালাল করতে এইসব ধর্মজীবী আলেম ওলামাদের এক মুহূর্তও দেরি হয় না। আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠিত হলে আবার আত্মাহীন বস্তুবাদী মানুষগুলির মধ্যে নৈতিকতার বোধ সঞ্চারিত হবে, কেউ নিজের স্বার্থোদ্ধারের জন্য অন্যের বিন্দুমাত্রও ক্ষতি করবে না।
¯্রষ্টা প্রাকৃতিক নিয়মে ঠিক করেছেন যে, ঐক্য অনৈক্যের উপরে জয়ী হবে। দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশত জন ঐক্যহীন লোকের তুলনায় শক্তিশালী হবে, তাদের উপরে বিজয়ী হবে। তাই প্রকৃত ইসলামের যারা অনুসারী তারা নিজ জাতির ঐক্য রক্ষাকে সর্বপ্রথম কর্তব্য বলে মনে করবে। ঐক্য নষ্ট হয় এমন কথা বা কাজ তাদের কারো দ্বারা হবে না। কারণ মহানবী (দ:) বলেছেন, ঐক্য নষ্ট করা কুফর অর্থাৎ ঐক্য নষ্টকারী উম্মাহ্ থেকেই বহিষ্কার। কারো পেছনে কেউ গিবত করবে না, কেউ ভুল করলে তার সামনে তাকে (সংশোধনের জন্য) বলা হবে।
অথচ গত কয়েক শতাব্দী ধরে এই জাতি কেবলমাত্র বিভক্তই নয়, নিজেরা নিজেরা দাঙ্গা হাঙ্গামায় লিপ্ত রয়েছে। এই কাজ করে তারা ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত তো হয়েছেই, পুরো জাতিটিকে অন্য জাতির গোলামে পরিণত করেছে। কারণ ঐ প্রাকৃতিক নিয়ম-United we stand, divided we fall. সেই গোলামী আজও চলছে। আজ এই জাতির যাবতীয় অনগ্রসরতার, পশ্চাদপদতার, হীনম্মন্যতার, দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ এই অনৈক্য। এককালে যারা সমগ্র পৃথিবীতে একক সামরিক পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের আসন, শিক্ষকের আসন অধিকার করেছিল সেই মুসলিম জাতিটি আজ দুনিয়ার অন্যান্য পরাশক্তিগুলির করুণার পাত্র। আল্লাহর দেওয়া দ্বীন প্রাকৃতিক আর প্রাকৃতিক নিয়মগুলির কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই আজও যদি এই জাতিকে হারানো গৌরব ফিরে পেতে হয়, তাদেরকে সেই প্রাকৃতিক নিয়মটিই কাজে লাগাতে হবে। তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, ‘আল্লাহর হুকুম ছাড়া আর কারও হুকুম মানবো না’ এই কথার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
বর্তমানের মানবরচিত প্রতিটি সিস্টেমেই জাতির ঐক্যের সকল পথ একটা একটা করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যেমন গণতান্ত্রিক অধিকাংশ দেশেই সরকারী দল-বিরোধী দল পরস্পর যুদ্ধংদেহী অবস্থানে থাকে। কোনো বিষয়েই তারা একমত হন না। একে অপরের চরিত্রহনন ও মু-ুপাতকেই একমাত্র দায়িত্ব বলে মনে করেন। গণতন্ত্র আছে বহুরকম, সমাজতন্ত্রও আছে অনেক প্রকারের। প্রতিটি মতবাদের সমর্থনে আছে বহুসংখ্যক রাজনৈতিক দল। এই সব দলের মধ্যেও থাকে নেতৃত্বের কোন্দল নিয়ে সৃষ্টি হওয়া উপদল। ধর্মকে ব্যবহার করে যারা প্রচলিত সিস্টেমের রাজনীতি করে তাদের অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। জাতীয় পর্যায়ে দলগুলির হানাহানি সঞ্চারিত হয় গ্রামাঞ্চলে, ফলে বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে শহরে যেমন ছড়িয়ে পড়ে দাঙ্গা তেমন অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে গ্রামে গ্রামে শুরু হয় দাঙ্গা, সংঘর্ষ। এটা বর্তমান রাজনৈতিক দলাদলির একটা ফল মাত্র। সুতরাং চলমান সিস্টেমে বিভক্তি, দ্বন্দ্ব একটি আবশ্যিক বিষয়। কিন্তু ইসলামে জাতি ছিল ইস্পাতের মতো কঠিন ঐক্যবদ্ধ। সমগ্র জাতি ছিল একটি জাতি, তাদের নেতা (এমাম) ছিলেন একজন, দ্বীন (জীবনব্যবস্থা) ছিল একটি- আল্লাহর দেওয়া সত্যদীন। একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো জাতির একজন অবিসংবাদিত নেতা থাকবেন যিনি আল্লাহর প্রতিটি হুকুম বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, অনড়। সেই নেতার আদেশ জাতি বিনা প্রশ্নে, বিনা দ্বিধায় পালন করবে। তখন প্রাকৃতিকভাবেই সে জাতি শক্তিশালী হবে এবং সর্বত্র বিরাজ করবে শান্তি। (চলবে…)